কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় : এক অচলায়তন ভাঙা কবি

সুমন ব্যানার্জি on

kobi-subhash-mukhopadhbyay

১.

জীবনানন্দ-উত্তর বাংলা কবিতার একটি মহীরূহ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অতি-ব্যবহারে ধ্বস্ত কাব্যভাষা বা ডিকশান থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করেন তিনি। ভাষার মধ্যে তিনি ফিরিয়ে এনে ছিলেন এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ। তাঁর সৃষ্টিতে শব্দ হয়ে উঠেছে উচ্ছ্বল ও প্রাণবন্ত।যুগ চেতনা অনেক সময় কবিকে গড়েপিটে নেয় যেমনটা হয়েছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। বুদ্ধদেব বসু যথার্থই লিখেছিলেন যে : “তিনি বোধহয় প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্য জীবন আরম্ভ করলেন না। এমনকি প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাও লিখলেন না; কোন অস্পষ্ট মধুর সৌরভ তাঁর কবিতায় নেই, যা সমর সেনেরও প্রথম কবিতাগুলিতে লক্ষণীয় ছিল। দ্বিতীয়ত, কলাকৌশলে তাঁর দখল এতই অসামান্য যে কাব্য রচনায় তাঁর চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষণীয় বস্তু আছে বলে মনে করি।”

স্বপ্ন মদির কাব্য-কূজন, রোম্যান্টিক আবেগের বাহুল্য পরিহার করে তিনি কবিতায় তুলে আনলেন পরিবর্তমান সমাজ ও রাজনীতির দিকচিহ্নগুলিকে। ছন্দ ও শব্দ নিয়ে নানা মাত্রায় তিনি পরীক্ষা চালিয়েছেন আমৃত্যু। বাংলা কবিতার জগতে এক দুর্মর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। এক যাত্রার সূচনা হল বাংলা কবিতায়। তাঁর ”পদাতিক”, “অগ্নিকোণ”, “চিরকুট” এবং পরবর্তীতে “ফুল ফুটুক” পর্ব থেকে তাঁর কাব্য ভাবনার যে বিবর্তন লক্ষিত হয়েছিল সেটাই আমরা আলোচনার কেন্দ্রে রাখব।

২.

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের “পদাতিক” কাব্যের একটি কবিতাংশ উদ্ধৃত করা যাক –

“শ্রদ্ধানন্দ পার্কে সভা; লেনিন দিবস;লাল পাগড়ি মোতায়েন;

আতঙ্কিত অন্তরাত্মা;ইষ্টনাম জপে রক্তচক্ষু মাড়োয়ারি;

নির্ভীক মিছিল শুধু পুরোভাগে পেতে চায় নির্ভুল গায়েন;…”

তাঁর কবিতার প্রধান অবলম্বন আটপৌরে গদ্যভাষা। প্রথমেই তাঁর কবিতায় কিন্তু তা এত উচ্ছ্বলভাবে ধরা দেয়নি। সেটা হয়েছে “অগ্নিকোণ” পর্ব থেকে ধাপে ধাপে । কবি জয় গোস্বামী তাঁর ‘পদাতিকের যাত্রাপথ’ শীর্ষক প্রবন্ধে কাব্যভাষার এই বিবর্তনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন। তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের কবিতার অনুবাদের পরই তাঁর কবিতা এই রকম মোড় নেয়। তাঁর “অগ্নিকোণ” ও “চিরকূট” দু’টি কবিতাংশ উদ্ধৃত করা যাক-

১.

“দিন এসে গেছে,ভাই রে –

বিদেশিরাজের প্রাণ-ভোমরাকে

নখে নখে টিপে মারবার।

দিন এসে গেছে

লাঙলের ফালে আগাছা উপড়ে

ফেলবার।

দিন আসে ভাই –

কাস্তের মুখে নতুন ফসল

তুলবার।”

২.

“সীমান্তে উদ্যত খড়গ

নিরস্ত্র দেশের বুকে চৌকিদেয় প্রভুত্বের মদমত্ত বুট।

ঐক্যবদ্ধ জনতার হুংকৃত জোয়ারে

চোখের পলকে ভেসে যাবে

অহংকৃত মুখের চুরুট।”

ভাষার মধ্যে রয়েছে একটা আড়ষ্টতা এবং আবেগের একটা চোরা উদ্দামতা। তবে তিনি যে তাঁর কাব্যভাষার স্বাতন্ত্র্যকে সন্ধান ও প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন সেটা স্পষ্ট। এর অব্যবহিত পরই প্রকাশিত হয় তাঁর নাজিম হিকমতের কবিতার অনুবাদ। তাঁর অনূদিত “জেলখানার চিঠি”র একটি দৃষ্টান্ত দেখা যাক –

“প্রিয়তমা আমার

তোমার শেষ চিঠিতে

তুমি লিখেছ

মাথা আমার ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে

দিশেহারা আমার হৃদয়

তুমি লিখেছ

যদি ওরা তোমাকে ফাঁসি দেয়

তোমাকে যদি হারাই

আমি বাঁচব না।”

কোন অলঙ্কৃত কাব্যিক শব্দ নেই। অথচ আবেদন কত গভীর, ভাষা কত স্বচ্ছ। তাঁর প্রথম প্রাতিস্বিক কাব্য হল “ফুল ফুটুক”। যার দু’টি কবিতাংশ উদ্ধৃত করে আমরা ভাষিক বিবর্তনটিকে বোঝার চেষ্টা করব –


১)

“পাগল বাবরালির চোখের মতো আকাশ।

তার নিচে পাঁচ ইষ্টিশান পেরোনো মিছিলে

বারবার পিছিয়ে পড়ে

বাবরালির মেয়ে সালেমন

খুঁজছে তার মাকে।…”

২)

“জলের কলে টিপ টিপ

টিপ টিপ

এখুনি

বাসন-ধোয়া জলে

নিজের মুখ দেখবে

ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার আরো একটি সকাল…”

এই ভাষা একেবারে কথ্য, লৌকিক জীবন থেকে আহৃত। কোথাও উচ্চকিত স্বরে কথা বলছেন না, একদম অকাব্যিক প্রবচন ও বাক্-প্রতিমার বলেই তিনি সমগ্র বাংলা কবিতাকে নতুন আলোকে ধৌত করেছেন। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।

৩.

বাংলার লোকায়ত জীবন ছিল কবিতার ধৃতিকেন্দ্রে। ‘আটপৌরে জীবনের চিত্রশালা’ থেকেই তাঁর কবিতার ভুবনটিকে গড়েছেন। তাঁর “যত দূরে যাই” কাব্যের দু’টি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করব –

১)

“আমি যত দূরেই যাই

আমার সঙ্গে যায়

ঢেউয়ের মালা-গাঁথা

এক নদীর নাম…আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে

নিকোনো উঠোনে

সারি সারি

লক্ষ্মীর পা…”

২)

“বলল:যাও,ঠুকরে দাও।

আমি ঘাড় নাড়তে নাড়তে

ঠুকরে দিয়ে এলাম…

মাটির ওপর সামনে ধুলো উড়িয়ে

আমি নাচতে লাগলাম

ঝটপট ঝটপট।

সব তাঁরই ইচ্ছেয়।।”

(‘তাঁর ইচ্ছেয়’)

কাব্য সম্বন্ধীয় সমস্ত পূর্ব ধারণাকে ভেঙে তিনি বাংলা কবিতায় তৈরি করতে চাইছেন একটি নতুন পরিসর। অন্য জল হাওয়া,অন্য আলোর নিরন্তর এক সন্ধানে ব্রতী তিনি। প্রত্যহিক জীবনচর্যা থেকেই তিনি তুলে এনেছেন কবিতা:শব্দ নিয়ে যিনি অনিঃশেষ পরীক্ষা চালিয়েছেন আমৃত্যু। তাঁর একটি কবিতা আরম্ভ হচ্ছে এইভাবে-

“থু
থু
থু…
এই একটি শব্দে
গলা চিরে
এবার আমি আগুন ওগরাবো…”

এমনভাবেও একটি কবিতা লেখা যায় এই ভাবনা কি কারুর মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছিল? তিনি কি বহু বছরের সংস্কার নির্দিষ্ট রুচিবোধ ও শালীনতার দর্শনকেও প্রশ্ন করলেন না এর মধ্যে দিয়ে? কিন্তু এসবের জন্য কোন স্বঘোষিত বিপ্লব, আস্ফালন তাঁকে করতে হয়নি। নিঃশব্দেই তিনি আঘাত করেছেন অচলায়তনকে –

“বীজ তো নয়

জলের মধ্যে

আমি পুঁতে ছিলাম আগুন।

আগুন নয় –

রক্ত।

হ্যাঁ,মনে পড়েছে –

পুঁতেছিলাম রক্তবীজ।।”

তিনি বাংলা কবিতার এই চিরায়ত গীতল, পেলব জমিতে রোপণ করতে চেয়েছিলেন শুধু বীজ নয়,’রক্তবীজ’। এই শব্দবন্ধের মধ্যেই নিহিত সমাজ-বাস্তবতা ও রাজনৈতিকতার তীব্র ব্যঞ্জানা। স্বাধীনতা আন্দোলন ও তারপর একের পর কমিউনিস্ট গণ- আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।আধিপত্যকামী সাম্রাজ্যবাদী শাসকের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যখন প্রগতিশীল আন্দোলনের ছাতার তলায় একত্রিত হচ্ছে শ্রমিক, কৃষক, প্রান্তিক মানুষ তখন তার বৌদ্ধিক প্রেরণা এসেছিল শিল্পী-সাহিত্যিকদের থেকেই। যার পুরোভাগে ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে যুগচেতনা একজন কবির মনোলোককে কীভাবে নির্মাণ করে দেয়। যে কোন স্রষ্টার মধ্যেই থাকে রাজনৈতিক ভাবনা কিন্তু মহৎ স্রষ্টাদের এর সঙ্গেই লগ্ন থাকে সর্বজনীন মূল্যবোধ যা দলীয় রাজনীতির পরিমিতি দিয়ে মাপা অসম্ভব। সুভাষ মুখোপাধ্যায় সেই দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত।

৪.

কবিকে এমন বিশ্বাসকে বুকে লালন করেন যার অগ্রে ও অন্তে মানুষ, কোন দল বা মতবাদ নয়। ৭০র দশক ছিল বাংলার রাজনীতির এক ক্রান্তিলগ্ন। এই সময়ই গড়ে ওঠে নকশাল বাড়ি আন্দোলন। যার অভিঘাতে উত্তাল হয়েছিল গোটা বাংলা। বামপন্থী দলগুলি ভাঙতে থাকে এবং সেইসঙ্গে হয়েছিল বিশ্বাসের অপমৃত্যু। আদর্শের নামে নির্বিচারে চলে ছিল গণহত্যা। দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে মনে করা হয়েছিল চিরশত্রু। তথাকথিত মতাদর্শের নামে এই সংকীর্ণ পাশবিক খেলায় অপহ্নব হয়ে যায় মানবিক মূল্যবোধের শাশ্বত আবেদন। সেই অন্ধকার রাক্ষসী বেলায় কবির কলমে ঝলমল করে উঠল আশাবাদের আলোয়-

“যৌবনের ফেরাই দিয়ে

হারিয়ে-যাওয়া নতুন বন্ধুরা আমার

সামনে জিতে নাও সৃষ্টির পিঠ

যাবার আগে যেন দেখে যাই

মেঘভাঙা রামধনু

ঢেলে সাজা পৃথিবীর বুকে

যেন শুনতে পাই

ভোরবেলার আজান।।”

(‘ফেরাই’, “ছেলে গেছে বনে”)

শিল্প আর জীবন মিশে গেছিল এক বাণবেঁধার বিন্দুতে। কবির সবথেকে বড় জোর তাঁর ভালোবাসার জোর। এই ভালোবাসার অমোঘ বাণীই তাঁকে আমৃত্যু রেখেছে সজীব ও সচল। কখন কখন তাঁর কবিতাকে করেছে এক উতল মায়ায় ভরপুর। তিনি অন্তহীন পথ চলতে চেয়েছেন কিন্তু তাঁর নেই কোন গন্তব্য। জীবনের শেষ দিকে এই আশ্চর্য সুন্দর কবিতাটি তিনি লিখেছেন-

"…ও ফুলের সাজি
     ও নদী,ও মাঝি
        বনের জোনাকি
           ও নীড়,ও পাখি 
    .
                যাচ্ছি,...''('যাচ্ছি')

এখানেই তিনি দুর্মরভাবে রোম্যান্টিক। যে কোন রোম্যান্টিক কবিই যেতে চান এক অনধিগম্যলোকে কিন্তু বাঁচতে চান মানুষের অন্তরঙ্গ বৃত্তে, স্মৃতিলোকে। পেতে চান মানুষের উষ্ণ সান্নিধ্য। সময় বদলে যায় কিন্তু কবি পথ চলা থামান না। আশ্চর্যজনক ভাবে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্য “পদাতিক” অর্থাৎ সেই পায়ে হাঁটা সৈনিক।কবি ও তো তাই যিনি স্থবিরতার অচলায়তনকে চুরমার করতে চান


তথ্যসূত্র :—
১. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে’জ প্রকাশনী।
২. দেশ পত্রিকা (১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


সুমন ব্যানার্জি

পেশা - বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। লেখার উদ্দেশ্য - তথ্য ভিত্তিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে ভালো লাগে সেই তাগিদ থেকেই লেখা।

1 Comment

Via Artiam · আগস্ট 17, 2020 at 12:02 পূর্বাহ্ন

খুব সুন্দর আলোচনা

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।