দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি

তিস্তা চক্রবর্তী on

আমরা যারা আশির দশকের শালিক হয়ে এই সময়েও দিব্যি ঘাড়ের রোঁ ফুলিয়ে বর্তমান প্রজন্মের সাথে একপাতে চানা খুঁটে খাচ্ছি, তারা সত্যিই অনেকক্ষেত্রে নিজেদের বেশ ভাগ্যবান বলেই মনে করি। হাট থেকে মল, শাড়ি টু ক্যাপ্রি, ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি হয়ে আজকের স্মার্ট নেটফ্লিক্স-এ এক বিস্তীর্ণ চরাচর আমাদের। সম্পর্কের সংজ্ঞাও সিলেবাস অনুযায়ী বদলাতে দেখেছি ধারাবাহিক ভাবে, সেই ‘তেরো পার্বণ’ থেকে আজকের সপ্তাহব্যাপী মেগার ঘনঘটায়। শুধু যেটা বদলায়নি তা হল ‘কমপ্ল্যান’, কারণ আজও কমপ্ল্যান বলে, “দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি!”

বস্তুত মা কে মাম্মি বলার হাওয়া সেই ভিন্টেজ আলোয় রাঙানো দিনগুলো থেকেই বয়ে আসছে।মনে পড়ে, শ্রীমান হংসরাজের সেই বিখ্যাত গান, “হেথা বাবারে কেউ ড্যাডি ডাকে, মামি বলে নিজের মা কে…”! তবে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি মা হোক বা মাম্মি, আবেগের দিক থেকে এনারা অপরিবর্তনশীল, ধ্রুবক।

এই যেমন ধরুন, আপনি যতই গান্ডেপিন্ডে গিলে নধরকান্তি হোন না কেন, যতই আপনার ঝুলে পড়া ভুঁড়ি দেখে লোকজন ভূয়সী খিল্লি করুক না কেন, আপনার মা তখনও আপনাকে দেখে বলে উঠবেন, “ইশশ বাবু, চেহারাটার কী হাল করেছিস বলতো! একটু ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে পারিস না! এইইইই সন্ধ্যা, একটা ডবল ডিমের ওমলেট আর ফ্রিজে দেখ রসগোল্লা আছে, বাবুর জন্য নিয়ে আয় তো। চোখমুখ বসে গেছে ছেলেটার না খেয়ে খেয়ে!”

আমি জানি এই অব্দি পড়েই আপনার যাঁর কথা মনে পড়ছে তিনি হলেন একটি বিখ্যাত এফএম চ্যানেলের চশমেবদ্দুর চরিত্র দি গ্রেট সরলা দেবী যাঁর আদরের ‘বাবু’ কখনোই বড় হয় না, আর সেই দুঃখে (নাকি সুখে?) তিনি হামেশাই সেই কালোত্তীর্ণ বাণী শুনিয়ে থাকেন যা পৃথিবীর যেকোনো মায়ের পেটেন্ট ভাবনা, “মায়ের ওপর করে নাও, বউ কিন্তু সহ্য করবে না!”

খুব একাত্ম বোধ করি এই ডায়ালগের সাথে কারণ অনেকদিন আগেই এক জনপ্রিয় নায়ক আমাদের কানে সেই অমৃত বচন দিয়ে গেছেন, “বউ গেলে বউ পাবি রে পাগলা, মা গেলে মা পাবি না!”

খাঁটি কথা এক্কেরে মশাই! আমরা হলাম গিয়ে যাকে বলে মাতৃসাধক জাত। প্রতি রবিবারের দ্বিপ্রাহরিক ভোজনবিলাসিতার বলি হয় যে ছাগল সেও অন্তিম প্রহর অব্দি মা মা থুড়ি ম্যা ম্যা করেই ডাকে!

আর শুধুই কি তাই! মায়ের মহিমা এমনই অপার যে ফ্লাইওভার থেকে ভোটের প্রচার সর্বক্ষেত্রে তিনিই একমেবদ্বিতীয়ম। এ সোনার বঙ্গে মায়ের আত্মাও ছাড় পায় না ভোটরঙ্গে, হুঁ হুঁ বাওয়া!

তবে যতই শব্দশরে বিঁধি না কেন, আজন্মকাল যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ থেকে সেই ‘মাগো’ই বেরিয়ে আসে সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে। ছোটবেলায় ‘আনন্দমেলা’তে একটা কলাম নিয়মিত প্রকাশিত হতো যার শিরোনাম ছিল ‘আমার মা সব জানে’। জানি কোথাও একটা গিয়ে এই বিশ্বাস আমাদের সবার মনেই বসত করে। তাই যখন কোনো দরজায় কড়া নেড়েই সদুত্তর মেলে না কিছু প্রশ্নের, আজও সেই মায়েরই দ্বারস্থ হই। এক ও একমাত্র মুশকিল আসান! সাধে বিস্কুটের নামও কিনা হয় ‘মম’স ম্যাজিক’!

সুতো দিয়ে নিপুণহাতে চারটে ডিমকে আটটা ডিমে ভাগ করার অঙ্কে মায়েদের দক্ষতা লাইন অফ কন্ট্রোল নির্মাতাদের চেয়েও ঢেরগুনে বেশি! মাসের শেষ সপ্তাহের অবশ্যম্ভাবী টানাটানিতে কোথা থেকে লটারি পাওয়ার মতো বাবার হাতে কয়েকশো টাকা
গুঁজে দেওয়া মা কে পি.সি সরকারের চেয়ে কম বড় ম্যাজিশিয়ান বলে মনে হতো না!

তারপর কমপ্ল্যান বেবিরা সত্যিই একদিন বড় হয়। কখনো কখনো এতটাই বড় হয়ে ওঠে যে নিজেদের প্রকান্ড ছায়ার আড়ালে চলে যাওয়া আশৈশবের ছাতাটার কথা খেয়ালই থাকে না। অসংখ্য গান কবিতা লেখা হয়, সভাসমিতিতে চায়ের কাপে হিউম্যান রাইটস নিয়ে তুফান ওঠে, কোর্টরুমের ট্রায়ালে চলে ধূঁয়াধার সওয়ালজবাব …কোথাও কোনও একটা বাড়ির একটা নির্দিষ্ট ঘরে অন্ধকার আরও জমাট বাঁধে, দীর্ঘশ্বাসের পাহাড় সিলিং ছোঁয়।

আত্মজাকে যখন চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখি প্রতিপল, তখন আরও বেশি করে অনুভব করি বড় হয়ে ওঠার যাত্রাটা কতটা স্বস্তির বড় হবার চেয়ে। মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে। সেই পুরোনো ছাতার তলায় গিয়ে দুদন্ড জিরোই। মাথায় হাত রেখে মা বলে, “চোখের তলায় এত কালি তো তোর আগে কখনো ছিল না, ঘুমটুম হচ্ছে ঠিকমতো! প্রেসারটা একবার চেক করাস তো। “হেসে ফেলে বলি,

“আর কমপ্ল্যান খাই না যে!”


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


তিস্তা চক্রবর্তী

জন্মঃ হাওড়ার আন্দুলে। বর্তমানে গড়িয়ায় বসবাস। শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম.এ (২০০৪) পেশাঃ স্কুল শিক্ষিকা লেখালেখি শুরু লিটল ম্যাগাজিনের হাত ধরে। 'উৎসব ','সাপলুডো ','অপদার্থের আদ্যক্ষর' ইত্যাদি ম্যাগাজিনের পাশাপাশি 'নতুন কৃত্তিবাস ' ও 'দেশ ' পত্রিকাতে কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।

1 Comment

Priyanka Bhattacharya · মে 13, 2019 at 12:33 পূর্বাহ্ন

Just amazing. Fatafati

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।