ছুট

অনসূয়া খাসনবীশ on

সে অনেকদিন আগেকার কথা। তখন টোটো গাড়িও হয়নি, এমনকি মোবাইল ফোনও হয়নি। মোবাইল ফোন তো ছাড়, ল্যান্ডলাইনও ছিলনা বাড়িতে বাড়িতে। বাক্স টিভি ছিল,তাও সাদাকালো। সেইসময় বাবা হঠাৎ কল্যানী থেকে বালুরঘাট বদলী হয়ে গেলো। মা রাগ করলো,দিদি জেদ করলো,যাবে না। বাবা তখন আমায় বলল,’চল, পাহাড় আছে,নদী আছে।’ একটা দিন ট্রাকে সব জিনিষপত্র তুলে দিয়ে আমাদের নিয়ে বাবা ট্রেনে উঠে পড়লো।কোন জারিজুরি খাটল না কারুর। মাসিমণি,দিদিভাই,দিদা ষ্টেশনে এসে আমাদের জড়িয়ে জড়িয়ে কত কাঁদলো। অত বড় বড় মানুষদের কাঁদতে দেখে আমি হেসে ফেলেছিলাম ফিক ফিক করে।
সেখান থেকে শিয়ালদা গেলাম,সেখান থেকে একটা ট্রেনে করে মালদা। তারপর আর ট্রেন যেত না। সেখান থেকে বাসে করে বা গাড়ি করে যেতে হত। বালুরঘাটে গিয়ে বাবা বলল,এখানে আত্রেয়ী নদী আছে। নাম শুনেই আমার খুব ভালো লাগলো। কিন্তু,পাহাড় নেই। কেন বাবা তাহলে বলেছিল,পাহাড় আছে? একথা জিজ্ঞেস করলেই বাবা খালি মুখ টিপে হাসতো। কিন্তু আমার নদীটাই বেশ ভালো লাগলো। মণিমালা চিলড্রেন্স হ্যাপি হোম স্কুলে আমাদের ভর্তি করে দিল বাবা। আমি ওয়ানে আর দিদি ফোরে। একবছর দিদির সাথে স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে একটা রাস্তা যেত নদীর দিকে। আমি দাঁড়িয়ে দূর অবধি দেখতাম। খুব ইচ্ছা করতো রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যাই নদী অবধি। কিন্তু,গেলেই দিদি মা’কে বলে দেবে,ভয় পেতাম।তারপর দিদি অন্য স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল। বাবা আমায় সাইকেলের সামনের সিটে বসিয়ে স্কুলে ছেড়ে দিয়ে আসত,সক্কালবেলা।  ফিরতাম একা একা। সুযোগ পেয়ে তাই,নদীর দিকের রাস্তাটায় যাবার ইচ্ছেটা চাগিয়ে বসলো। একদিন দিলাম হাঁটা লাগিয়ে।ডানদিকে একটা মন্দির পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম খানিকটা। কেন কে জানে,রাস্তাটায় লোকজন একেবারেই ছিল না। এক দুটো সাইকেল চলে যাচ্ছিল এদিক ওদিক। বেশ খানিকটা এগিয়ে দেখি,একটা বাচ্চা ছেলে মাথা নীচু করে মাটি নিয়ে খেলছে। তার কাছে একটু যেতেই দেখি তার উপরের ঠোঁট বলে কিছু নেই। ঠোঁটটা গোটানো নাকের তলা অবধি যেন নাক থেকেই ঠোঁট শুরু। আমি তো পাঁই পাঁই করে ছুট। এক ছুট্টে কালীবাড়ির সামনে। সেখানে নাকি কাঁঠাল পেকে পড়ে থাকে,আম পেকে পড়ে থাকে,শেয়ালেও খায় না। মন্দিরের ভেতরে কালীও নাকি শেকলে বাঁধা,মুন্ডুটা নাকি হাতে ধরা। আর কালীবাড়ির পাশেই হাড়গিলেদের বাসা।গাছটায় পাতা নেই শুধু হাড়গিলের পালকহীন মাথা।সেটাকেও পেরিয়ে গেলাম কোন সাহসে কে জানে। তারপরই নদী। আত্রেই নদী। প্রাণভরে দেখলাম সেদিন,চওড়া হয়ে চরা পড়েছে ওপারে। বেঁকে গেছে নদী।পাড়ে কাদা,তাতে কাদের পায়ের ছাপ গর্ত হয়ে বসেছে।দূরে ছোট্ট ব্রিজ। ঢেউয়ে সূর্যের আলো চিকচিক করছে। মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি।একেবারে জ্যান্ত একটা নদী!! আমার সামনে!!! দু’একবার চুপিচুপি বলে নিলাম,আত্রেই আত্রেই। আমি হাঁটছিলাম ইটবাঁধানো বাঁধের উপর দিয়ে। খালি মনে পড়ছিল,মা বলে ছোটরা একা বাঁধের উপর দিয়ে গেলে গড়িয়ে পড়ে যায়। আমি তাই যতটা সম্ভব ডাঙার দিক ঘেঁষে যাচ্ছিলাম। সাইকেল করে একটা লোক গেল দেখতে দেখতে। ভাবলাম,নির্ঘাত বাবাকে চেনে,বলে দেবে আমি এখানে। তাহলে তো গেলাম। ভয়ের চোটে দিলাম দৌড়। দৌড়ে ঢাল বেয়ে নেমে গেলাম মোমদির বাড়ির সামনের রাস্তায়। সেখানে ইয়াব্বড় একটা গরু ঝিমোচ্ছিল। বেশ জানতাম, কৃষ্ণ কৃষ্ণ বললে গরু গুঁতোয় না। কি করে জানতাম তা বলতে পারবো না। ঠাকুর দেবতাকে বেশ কাজটাজ অনুযায়ী ভাগ করে ফেলেছিলাম আমরা।তারপর হলো কি,আমি ছুটলাম,ছুটতে ছুটতে মোমদিদের বাড়ির সামনের গরুটাকে পেরিয়ে,কচিকলা ক্লাবের সামনে দিয়ে বড় রাস্তায় পড়লাম।  এত দৌড়ে পেটের মধ্যে কনকন করছিলো। বাড়ি গিয়েই মা’কে বললাম,মা খেতে দাও৷ মা এত্তবড় ঘি,ভাত আলুসেদ্ধর দলা পাকিয়ে দিল। আমিও পা নাচিয়ে নাচিয়ে খেতে লাগলাম। এরকম ভাবেই আত্রেয়ী নদীর সাথে আমার ভাব জমেছিল,সেই ঠোঁট উলটানো ছেলেটার সাথেও।সাঁতার শিখেছিলাম। একবার জেলেপাড়ায় হারিয়ে গেছিলাম। সেনাপতি আমার ভাগের জেলি পাঁউরুটি খেয়ে নিয়েছিল,লাল আলুর দম কেমন হতো,সেসব তো আরেক গল্প। বলেছিলাম না, দিব্যি কেটেছিল বালুরঘাটের কয়েকবছর। 

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


অনসূয়া খাসনবীশ

জন্মস্থানঃ নদীয়া । শিক্ষাঃ ইংরাজীতে এম.এ, বি.এড । কর্মজীবনঃ শিক্ষকতা । লেখা লেখি ও আড্ডা মারতে ভালোবাসেন । আগ্রহের বিষয় শিশুসাহিত্য । জয়ঢাক,ঋতবাক,রংছুট,ম্যাজিক ল্যাম্প, প্রিন্টেড ও বিভিন্ন ওয়েবম্যাগে লিয়মিত লেখেন।

1 Comment

সুবিৎ ব্যানার্জী · ফেব্রুয়ারি 26, 2019 at 12:35 অপরাহ্ন

খুব সুন্দর লেখা। এক্কেবারে সত্যিকারের শিশু পাঠ্য।
রায়গঞ্জে পোস্টেড থাকতে আত্রেয়ী দেখেছি। বিরাট নদী খাত । বর্ষায় ইরিগেশন এর ঘুম ছুটিয়ে দেয়।

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।