রঙ

তিস্তা চক্রবর্তী on

গন্তব্যে প্রায় পৌঁছে গেছি মনে হলেই আজকাল  একটা অবসাদ আসে। কিন্তু হিসেবমতো উল্টোটাই হওয়া উচিত। তবু আলোঝিরি পথের ভেজামাটি পেরিয়ে ঠিক যেখান থেকে চাপচাপ কুয়াশা শরীরকে আবছা করে তোলে সেখানেই প্রতিবার বড্ড ঘুমঘুম পায় যেন। দু’একটা গিরগিটি রং বদলে সবুজ থেকে ধূসর হয়ে যায় হঠাৎই। অরণ্যও বহুরূপী হয়।
পাইন ফলবিছানো রাস্তায় পায়ের চাপে পিষে যায় কত নাম না জানা ঘাসফুল। বয়সের গাছপাথর নেই যে গাছগুলোর তাদের শুয়ে থাকতে দেখা যায় পথের মাঝখানে অকারণ ঘুমের ঘোরে।প্রতিবার রুটম্যাপ হয়ে ওঠা গাছগুলোর গায়ে ঢ্যাঁরা কাটতে কাটতে জিষ্ণুর ডানগালের কাটা দাগটা দগদগ করে ওঠে।
বাইশ বছর! এখনও আঘাত স্মৃতির মতোই তীক্ষ্ণ। একটু আগেই যে লাল রং এর ইনোভা টা পাশ কাটিয়ে চলে গেল তার জানালায় রাখা চোখ অনেক পুরোনো কিছু পরিচিত বিকেলের ছবি দিয়ে গেল অযাচিতভাবেই।
লাল বরাবরই খুব প্রিয় রং মেঘনার। আজও যখন ওর স্কার্ফটা উড়ে এসে জিষ্ণুর দৃষ্টি ঢেকে দিয়েছিল, কয়েক মুহূর্তের জন্য ‘শুভ পরিণয়’ অ্যালবামের লাল রং এর ভেলভেট কভারটা হঠাৎই যেন চোখের সামনে…মেঘনার শাড়ির রং এখন ধূসর,কিছুটা আমাদের চুলে লেগে থাকা বিদায়ী বসন্তের মতোই। তবু ওর নাম মেঘনা…তাই মেঘ না চাইতেই জলের মতো একটা ছোট্ট ধমক জুটেই গেল বরাতে…
-“স্বভাবে জংলী ছিলে, এখন চেহারাটাও দেখছি তেমনই বানিয়েছ! চশমা কোথায় তোমার?”বড় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। সত্যিই তো, চশমাটা কোথায় যেন!
অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম মেঘনার দিকে।মুচকি হেসে আমার মাথায় চড়ে থাকা বস্তুটাকে নামিয়ে এনে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে থাকলো যত্ন করে। অনেকক্ষণ ধরে। যেন ঘষে ঘষে তুলে ফেলতে চাইছে জমে থাকা সময়ের ধুলো… নোনাজল …শব্দবাষ্প!
ওর হাত ছুঁলাম। বললাম,”মেঘ, ওটুকু লেগে থাকতে দাও। ঠিক যেভাবে লেগে আছে তোমার দেওয়া শেষ দাগটুকু আমার গালে…মুছো না প্লিজ।”
চশমাটা আমার চোখে পরিয়ে দিতে দিতে আচমকাই ওই কাটা দাগটায় আঙুল রাখল মেঘনা।-“সবটুকু দিয়ে আঘাত করেছিলাম তোমায়, ঠিক যেমন সবটুকু দিয়ে চেয়েছি বরাবর …তেমনই।আমি গাছ হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম জিষ্ণু।ডালপালা মেলে, আকাশ অব্দি ছড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। গুরু ছিলে তুমি আমার। রং কিভাবে কথা বলে শিখিয়েছিলে তুমি। সেই রং ঢেলেই তুমি আমার নিবেদনকে নষ্ট করে দিয়েছিলে জিষ্ণু। এতটাই ইনসিকিওর ছিল তোমার শিল্পীসত্তা!তোমাকে অরণ্য মেনেছিলাম। তুমি আগাছার মতো উপড়ে ফেলেছিলে আমার স্বপ্নকে।শেষবারের মতো প্যালেট টা দিয়ে তাই তোমার গালেই আমার প্রিয় রং এঁকে দিয়েছিলাম। খুব ব্যথা করে না গো, আজও?”
কী নরম হাত আজও তোমার মেঘ! একবার চেপে ধরো আমার চোখেমুখে…বেঁচে আছি কি না পরখ করে দেখি।
-“রং হারিয়ে গেছে মেঘ। রং হারিয়ে যায়। শুধু দাগটুকু থেকে যায়। ব্যথাটুকু ওই দাগটার মতোই।ভেবো না এত।”
মেঘনা স্কার্ফটা জড়িয়ে নেয়। তারপর পিছিয়ে যায়, আরও আরও পিছিয়ে যায়…চাপচাপ কুয়াশায়।—————–একটা শব্দ কখন থেকে কানের কাছে বেজে চলেছে অনবরত। কিসের শব্দ এটা? বিরক্ত লাগছে জিষ্ণুর।
-“আহহ! স্টপ মেকিং সাচ ইরিটেটিং নয়েজ, ইউ সিলি আর্বান বার্ডস!”
-“আঙ্কল, কখন থেকে আমরা হর্ণ দিচ্ছি।আপনি শুনতে পাচ্ছিলেন না? আপনি এই জঙ্গলে এভাবে একা একা…আর ইউ ওকে? কোথাও ড্রপ করে দেব আপনাকে?”
জিষ্ণু মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আবার সবুজ রং টা চারপাশে বেশ গাঢ় হয়ে আসছে। ব্লু জিন্স, ওয়াইন রেড টপ আর …স্কার্ফ…
-“মেঘনা!”
-“স্ট্রেঞ্জ! হাও ডু ইউ নো মাই নেম!”
জিষ্ণু হেসে ফেলে।মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”লাল তোমার প্রিয় রং…এটাও জানি।”
 হাত নাড়তে নাড়তে এগিয়ে যায় জিষ্ণু পাইনের হাতছানিতে….”Country roads, take me homeTo the place I belong….”


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন

Categories: গল্প

তিস্তা চক্রবর্তী

জন্মঃ হাওড়ার আন্দুলে। বর্তমানে গড়িয়ায় বসবাস। শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম.এ (২০০৪) পেশাঃ স্কুল শিক্ষিকা লেখালেখি শুরু লিটল ম্যাগাজিনের হাত ধরে। 'উৎসব ','সাপলুডো ','অপদার্থের আদ্যক্ষর' ইত্যাদি ম্যাগাজিনের পাশাপাশি 'নতুন কৃত্তিবাস ' ও 'দেশ ' পত্রিকাতে কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।

1 Comment

কাশীনাথ ভট্টাচার্য · অক্টোবর 2, 2019 at 9:57 অপরাহ্ন

কয়েকটা লেখা পড়ে বেশ লাগল। তিস্তা চক্রবতীর লেখা বেশ ভাল ।

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।