সেই পেয়ালার চা

এরিনা ঘোষ on

মেঘলা সকালের বাদামী মনখারাপটা কাটাতে এক প্লেট ফল আর ব্রেড বাটারের সঙ্গে এক মগ এক্সপ্রেসো নিয়ে বসলাম। উদ্ভাস কে ছেড়ে আসার পর নিজের দেড় কামরার স্টুডিও এ্যাপার্টমেন্টে একটু একটু করে অচেনা ছকে জীবনটা সাজাতে শুরু করেছি এমন সময় রীতিদির মানাউ পৈ তে আসার এই আমন্ত্রন। রীতিদি আর দীপ্তেশ গগৈদা আমাদের মুম্বাই এর প্রতিবেশী। আমাদের মতই আনকোরা সংসারী এই দম্পতির সঙ্গে সপ্তাহান্তিক ঘোরাফেরা কি পার্টি সবই চলতে চলতে কখন যেন আত্মীয়তা হয়ে গেছিল। উদ্ভাসের কাজে ডুবে থাকা আমার থেকে একটু করে দূরে চলে যাওয়ার দিনগুলোতেও রীতিদিকে কাছে পেয়েছিলাম। এখন ওরা ফুটফুটে জেনির মা বাবা। তাই আমার ফ্রিল্যান্সিং সাংবাদিকতার নতুন সংযোজনে মানাউ পৈ নিয়ে একটু অন্যরকম তথ্য সরবরাহ আর জেনীসোনা কে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। এমনিতেই মেয়ে আমার ভিষন পছন্দ। ভালবাসার কত নির্ঘুম রাত আমি আর উদ্ভাস মেয়ে হলে কি নাম রাখব ভেবেই কাটিয়েছি। তিনসুকিয়ায় এই আগমন ছোট্ট জেনী আর সাংগফো ট্রাইবদের মূল উৎসব মানাউ পৈ এর জন্যই।এমনিতেই ছোট্ট জেনীকে নিয়ে রাতজাগায় বেশ বেসামাল ওরা। তাই মূল শহরেই এক ছোটখাট হোটেলে উঠলাম ওদের বিব্রত না করে। ফেব্রুয়ারীর ঠান্ডা আমেজ আর এই মেঘলা দিন বড্ড মন ভার করে দিল। এই জন্যই অতিবেগুনীর মন ভালো করা জাদু আমার প্রীয়। নতুন জায়গায় গেলেই রোদ মাখতে বেড়িয়ে পরি আগে। সঙ্গে জায়গাটাকেও চিনে নেওয়া হয়। আলসে উদ্ভাস এ নিয়ে কম পেছনে লাগেনি। চার মাস হয়ে গেল কিন্তু সেসব ভুলতে বোধহয় আরও কিছু সময় লাগবে। সকাল গড়িয়ে দুপুর নামল শহরের পথে পথে লোকজনের সাথে কথা বলে আর বেশ কিছু ফোটো তুলে। রং বেরং এর কাচিন পোশাকে সজ্জিত পুরুষ মহিলার ঢল নেমেছে পথে। রঙীন বিডসের গহনা আরও সুন্দর করেছে। পথের ধারেই এক খোলা রেস্তোরাঁয় স্যুপ আর মোমোর অর্ডার দিয়ে বসলাম। রেস্তোরাঁ র ডানপাশে কিউরিও শপে বেশ হাঁকাহাঁকি করে নিলাম চলছে। রোগা মোটা মাঝ বয়সী বয়স্ক সব রকম খরিদ্দার সাধ্যমতন দর বলছেন। শ্বেত পাথরের মূর্তি,কাবার্ড,রঙীন কাঁচের ক্রকারি শোকেস, চুরুট দানী সব ই একেএকে উপযুক্ত খদ্দেরের হাতে গিয়ে উঠছে। এরই মাঝে কালো ভুষকি ওঠা কোট পরা একটা পাকানো চেহারা র লোক ঐ সব জিনিসের ইতিহাস বলছে। দাম মিটিয়ে বেড়োতে যাব লোকটা দেখি গোলাপি রঙের পেয়ালা হাতে তুলে বলছে সিম্বল অফ লাভ। গাঢ় গোলাপী পিরিচে সোনালি পাতার কাজ আর ফিনফিনে হালকা গোলাপি পেয়ালার গায়ে সোনালী গুচ্ছ ফুল। বেশ সুন্দর দেখতে। জেনীর জন্য একগাদা জিনিস নিয়েছি। দেরী না করে সোজা হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে হোটেলের গাড়ি নিয়েই রীতিদির বাড়ি রওয়ানা হলাম। সন্ধ্যেটা আড্ডা দিয়ে জেনিকে চটকে আদর করে ভালই কাটল। পরদিন ওদের সাথেই মানাউ পৈ তে যাওয়া ঠিক হোল। এগারোটায় ওরা তুলবে ঠিক করে রাতের খাবার ওখানেই খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। ফেব্রুয়ারিতেও বেশ ঠান্ডা এখানে। তাও বরাবরের অভ্যেস মত স্নান করে কম্বলে ঢুকলাম। ফোটো আর ইনফো যা পেয়েছি কাল সকালে ল্যাপটপে তুলব। চোখ বুজতেই রাজ্যের ঘুম এল। যে আমি একদম চা খাইনা দেখলাম পাহাড়ের গা ঘেঁসা এক বাংলোর বারান্দায় বসে নিলামের দোকানে দেখা পেয়ালা পিরিচে আমি আর উদ্ভাস হেসে হেসে চা খাচ্ছি। সকালে ঘুম ভাঙতে রাগ হোল বেশ। ছেড়ে আসবার পর একটাও ফোন আসেনি উদ্ভাসের। এরকম মানুষের জন্য স্বপ্ন দেখার কোন মানে হয় না। সেদিন দুপুরটা বেশ কাটল মানাউ পৈ তে। কাচিন দেবতার উদ্দ্যেশে বিভিন্ন দলের নৃত্য প্রদর্শন ।মানাউ মানে নৃত্য আর পৈ মানে উৎসব। মূলত নৃত্যের ই উৎসব এটা। হ্যান্ডি ক্রাফ্টের দোকান থেকে বেশ কিছুঘর সাজাবার জিনিস নিল রীতিদি। আমার ও খুব শখ ছিল একসময়। এখন অপ্রয়োজনীয় কিছুই কিনিনা। জীবনের ভাললাগা গুলোকে ছেঁটেকেটে ভাল থাকার চেষ্ঠা আরকি। পকেট ও পারমিট করে না সবসময়। জোর করেই একটা রঙীন কাচিন পোষাক দিল রীতিদি। পরশু ভ্যালেনটাইন্স ডে তে এখানে বিশেষ অনুষ্ঠান থাকবে। বলল সেদিন পরতে। সন্ধ্যেটা ইনফো আপলোড করেই কেটে গেল।সারাদিন ঘোরাঘুরিতে বেশ ক্লান্ত। ঘুমাতেই বেহূঁশ হয়ে গেলাম।

হলদে ঝিরিঝিরি পাতার আড়াল দিয়ে রোদ এসে পরছে। আর তাতেই চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোলাপী মাটি ছেনছে লাল টুকটুকে কাচিন পরা একটা মেয়ে। নিপুন হাতে গড়ে তুলল একটা গোল পেয়ালা। বাড়তি মাটি কাঠের ছুড়ি দিয়ে ছেঁচে দিচ্ছে। ওদিকে জলপাই রংয়ের অস্টিনে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে সবুজ চোখের এক সাহেব মুগ্ধ হয়ে দেখছে ঐ শিল্পকর্ম।হলদে বিকেল, বেতের টেবিলে রাখা ঐ গোলাপী পেয়ালা পিরিচে ঐ দুই তরুন তরুনী অপার মুগ্ধতায় ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে। অতল গভীর খাদ রক্তাক্ত দুইজন গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ঘামে ভিজে লাফিয়ে উঠলাম। এসব কি দেখলাম স্বপ্নে?


সবেমাত্র দিনের আলো ফুটেছে। কিছু মেল চেক করে ঝটপট জবাব দিয়ে কোনমতে প্রাতঃরাশ সেরে বেরোলাম ঐ দোকানের উদ্দ্যেশে। সকাল সাড়ে দশটা হবে। আধময়লা স্কার্ট পড়া এক মাঝবয়সী মহিলা হাতিয়ালী রোডের ঐ দোকানে ঝাড়পোছ করছে। কাঁচের ভারি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই আগের দিনের লোকটাকে দেখতে পেলাম। গোলাপী পেয়ালার কথা বলতেই মুচকি হাসি দিয়ে বসতে বললেন।ভিতর থেকে পেয়ালা পিরিচ জোড়া সামনের টেবিলে এনে রাখতে দেখলাম একটা পেয়ালার কানা চলটা ওঠা। আমার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা বাংলায় লোকটা ঐ পেয়ালা জোড়ার যা ইতিহাস বলল তা হোল মিমলি ছিল সাংগফো সম্প্রদায়ের প্রধানের মেয়ে। ওদের রীতি অনুযায়ী নিজের দাদা বা ভাই বা না থাকলে তুতো সম্পর্কেই বিয়ে হয়। পৃথিবীর আদিমতম জাতিদের মধ্যে ঐ প্রথা মূলত বংশগত সম্পত্তির রক্ষার উদ্দ্যেশে মানা হোত।ফুটফুটে সুন্দর মিমলি অসাধারন মৃৎশিল্প আয়ত্ব করেছিল ওর মাতৃকূলের কোন এক বয়স্কের কাছে। সেই নিয়েই মগ্ন সু্ন্দরী মিমলিকে দেখে মুগ্ধ হয় হান্স উইন্সটন। তিনসুকিয়ার চা বাগানে টি টেষ্টার হয়ে আসা বৃটিশ যুবক। উনবিংশ শতকের কাছাকাছি প্রত্যন্ত আসামের ঐ অন্চলে সমস্ত পারিবারিক বাধা উপেক্ষা করে তারা দুজনে সংসারী হয়। প্রচন্ড রাগে হিংসায় প্রতিশোধ নিতে মিমলির জ্ঞাতি দাদা অগ্নি মিমলিকে বিয়ের যৌতুক স্বরূপ অনেক উপহারের সঙ্গে বিষাক্ত গুন্জা ফলের বীজ পাঠায় আর পাঠায় ঐ বীজ দিয়ে তৈরী অভিনব এক চা তৈরির প্রনালী। যার স্বাদ অতুলনীয় হলেও ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয় স্বাদকোরক। চৈনিক কোন এক পূর্বপূরূষের কাছ থেকে ঐ প্রনালী তারা শিখেছিল। টি টেস্টারের খাওয়া দাওয়ার অনেক বিধিনিষেধ থাকে। বিশেষ চা যেগুলি বিদেশে রপ্তানি করা হোত সেগুলোর পরীক্ষায় বিশেষজ্ঞ ছিল হান্স। কিন্তু ধীরে ধীরে পারদর্শিতা হারিয়ে অধৈর্য্য হয়ে পরছিল সে। একদিন চা কোম্পানির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে হান্স জানতে পারে নিয়মিত তার চায়ে মেশান কোন বিষের ফলেই স্বাদকোরকের বিশেষত্ব হারিয়েছে সে।রাগে অন্ধ হান্স বাড়ি ফিরে টেবিলে ছুঁড়ে দেয় প্রীয়তমা মিমলির বানানো গোলাপী পেয়ালা । সব জানতে পেরে অপরাধবোধে নিজের হাতের শিরা কেটে ফেলে মিমলি। ক্ষুব্ধ হান্স বোঝে কারো ষড়যন্ত্রে শেষ হতে চলেছে ওদের যৌথ জীবন। দূর গৌহাটির হাসপাতালের পথে জোরে গাড়ি ছোটায় মৃত্যুপথযাত্রী মিমলি কে বাঁচানোর প্রানপন চেষ্ঠায়।কুয়াশা মাখা পথে সেই গাড়ি গড়িয়ে পরে বহু নীচের খাদে। এমনকি ওদের মৃতদেহও উদ্ধার করা যায়নি। টি এস্টেটের বাংলোর সব জিনিস নীলামে উঠলে বেশ কিছু হাতবদল হয়ে এই পেয়ালা পিরিচ এসে পৌঁছায় এই কিউরিও শপে। এর বিশেষত্ব হোল যার হাতেই এই পেয়ালা পিরিচ পরেছে তাদেরই সম্পর্কে উন্নতি হয়েছে। গাঁজাখুরি ভেবে কাটিয়ে দিতাম কিন্তু পরপর দু রাত দেখা স্বপ্নটার কথা ভেবে নিয়েই নিলাম ওগুলো। পরের দুই দিন খুব খাটনি গেল উৎসবের সব তথ্য জোগাড় করতে। ফেরার দিন এয়ারপোর্টে রীতিদি দের বিদায় জানিয়ে জেনিকে অনেক আদর করে ফ্লাইট ছাড়তেই অনলাইন হলাম। একী?লালনীল কাচিন পরা ছবিতে উদ্ভাসের লাল হৃদয়। মেসেন্জারে ছোট্ট মেসেজ একটু কি দেখা করা যাবে?কেমন যেন অদ্ভুত অনুভুতি হোল। পেয়ালা পিরিচের সেটটা হ্যান্ডব্যাগেই ছিল। হাত বুলিয়ে ভাবলাম দেখাই যাক না। রিপ্লাই করলাম পরশু,বিকেলে চা হতে পারে,আমার এ্যাপার্টমেন্টে। অনেক অনেক পুরোনো স্মৃতির ক্যালাইডোস্কোপে চোখ রেখে মাথা হেলালাম আর ছোট্ট প্লেনটা উড়ে চলল আমায় আমার প্রীয় শহরে উদ্ভাসের কাছে নিয়ে।

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


এরিনা ঘোষ

পেশা — সিভিল ইন্জিনিয়ার, নেশা — বই ও কবিতা, অবসর বিনোদন — লেখা ও পশুপাখির সঙ্গে সময় কাটান।

1 Comment

Susmita Mukherjee · জুলাই 8, 2019 at 5:57 অপরাহ্ন

Khub bhalo laglo.. Ektu edit kore nao…

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।