বিষাদবৃক্ষ

রিংকু কর্মকার চৌধুরী on

রাত প্রায় তিনটে। মৃন্ময় ঘোষালের চোখে ঘুম নেই। পাশে শুয়ে স্ত্রী সুপ্রভা একটানা ঘং ঘং করে কেশে চলেছেন। কয়েকদিন যাবৎ বুকে সর্দি বসেছে সুপ্রভার। কথা বলতে গেলে হাঁফিয়ে যাচ্ছেন। সবই লক্ষ্য করছেন মৃন্ময়, শুধু পয়সার অভাবে ডাক্তার দেখাতে পারছেন না। মৃন্ময় জানেন সুপ্রভাও  ব্যাপারটা বুঝেছেন, তাই স্বামীর সামনে যতটা সম্ভব চেষ্টা করেন নিজেকে সুস্থ দেখানোর। সুপ্রভাও জানেন তাঁর স্বামীর  অপারগতার কথা। নিজের ব্যর্থতা, এই দীনতার জন্য মনে মনে নিজেকে প্রতিনিয়ত কটু কথা শোনান মৃন্ময়। এই মধ্যরাতের নিস্তব্ধতায় তাঁর ব্যর্থতার আওয়াজ  সুপ্রভার কাশির গমকের সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে।  দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কাত হয়ে শুলেন মৃন্ময় । ঘরের নীল আলোয় পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রীকে দেখে শিউড়ে উঠলেন ।সুপ্রভার চেহারাটা দিনদিন মৃত  মানুষের মত সাদাটে হয়ে যাচ্ছে —

কোটরাবৃত চোখ, দুগাল তুবড়ে হাড় ঠেলে উঠেছে। আলো-আঁধারিতে স্ত্রীকে দেখে ভয় করল মৃন্ময়ের। অথচ সুপ্রভা এক কালে দারুণ সুন্দরী ছিলেন। বৌকে নিয়ে খুব গর্ব ছিল তাঁর।গর্ব আরেকজনকে নিয়েও ছিল।সে এখন অতীত আর এই মুহূর্তে তার কথা ভাবতেও চান না। তাকে ভুলে যেতে পারলেই বরং শান্তি পাবেন। যে কটা দিন আছেন তাকে ভুলেই থাকতে চান মৃন্ময় ও সুপ্রভা। অথচ কিছু স্মৃতি যেন মোমের মত,গলে গলে পড়ে তারপর আস্তে আস্তে পুড়িয়ে দেয় বুক। তবে সেই সব স্মৃতিদিন মৃন্ময় পেরিয়ে এসেছেন বহুদিন। এখন যেন এক নির্লিপ্ত মানুষ যাঁর শুধুই পেটের দায়। দুটো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার দাবী। আর স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখবার প্রবল তাগিদ। তবুও মাঝেমাঝে মোচড় দেয় বাম বুক। 

খাটের পাশের সুইচ বোর্ড থেকে বেড সুইচটা অন করে লাইট জ্বালিয়ে উঠে বসলেন মৃন্ময়।  বালিশের পাশে রাখা বোতল থেকে জল খেয়ে স্ত্রীর গায়ে কাঁথাটা ভালো করে জড়িয়ে, লাইট অফ করে খাট থেকে নেমে পড়লেন। ঘুম আসছে না আজ । ভেতরটা অস্থির লাগছে।  বহুদিন পর মৃন্ময়ের  ভীষণভাবে মনে পড়ছে  তাকে। কোত্থাও নেই সে। অথচ এখনও অব্দি সবকিছুতেই তার ছোঁয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ।তিনিই তো নাম রেখেছিলেন তার —  ‘অনিকেত’।

ছোট ছোট হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে আবদার করতো। এটা দাও ওটা দাও। ওটা চাই, এটা নেই। দেখতে দেখতে ছেলেটা বড় হয়ে গেল। কবে যেন মস্ত রেজাল্ট করে  কলেজে পড়তে চলে গেল, কীভাবে যেন পেয়ে গেল বিদেশের চাকরীটাও। চলে গেল লন্ডন। তারপর…

মৃন্ময় মনে করার চেষ্টা করলেন স্মৃতি হাতড়ে।সেদিন খুব তাড়াতাড়ি উঠেছিলেন। মহালয়া ছিল বোধহয়। পিতৃতর্পণ  সেরে ফিরে এসে পুজো সেরে সবেমাত্র চায়ের কাপে প্রথম চুমুক, বেজে উঠেছিল ফোন। ‘হ্যালো! মৃন্ময় ঘোষাল?’,  এটুকুই বোধহয় শুনতে পেয়েছিলেন, বাকিটা শোনার মত অবস্থায় আর ছিলেন না। কর্মক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে উপরে ওঠা তাঁর ছেলে  দ্রুতগামী চাকার নীচে পিষ্ট হয়েছে। নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকুও পায়নি কেউ। স্কুল মাষ্টার মৃন্ময়ের আর্থিক অবস্থার উত্থান কোনকালেই তেমন ছিল না। যেটুকু ছিল তা অনিকেতের বিদেশযাত্রায় চলে গেছে। পাঁচ বছর হয়ে গেল।  কবেকার শোক তার ভেসে গেছে থেমসের জলে।

    বসন্তের শিরশিরানি, শেষরাতের নরম হিমঝরা আবেশ, আমের মুকুল,লেবু ফুলের সুঘ্রাণ টেনে আনা ভোর। টেনে আনে পুরোনো আগুপিছু দিনরাতের বাকি থাকা লাভক্ষতির হিসেব। অনিকেত চলে যাওয়ার পর সুপ্রভা দিনদিন সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। নিজের মত নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। শুচিবায়ুগ্রস্ত, অসুস্থ এক নারী তাঁর বৃত্তে ঘোরাফেরা করে চলেন। আর তিনি নিজে ক্ষয়াটে, ন্যুব্জ শরীরের সেই অকালে বুড়িয়ে যাওয়া নারীটিকে রক্ষা করে চলেছেন। মৃন্ময়ের বুড়ো হাড়ে ক্ষমতা ফুরিয়ে আসছে। বিধ্বস্ত, হেরে যাওয়া এক পিতা, এক স্বামী নাকি মানুষ মৃন্ময়! কে আগে হার মানবে সেইটুকু দেখার অপেক্ষায় বেশীরভাগ দিনই রাতগুলো বারান্দায় বসে কাটান তিনি। শ্মশান রক্ষকের মত আগলে রেখেছেন বাড়িটাকে। বাগানের গাছগুলোয় মাকড়সাদের জানালা। তাতে খেলা করে রোদ। দেওয়ালের কোনায় টিকটিকিদের সাজানো সংসার। চারদিক ধুলোময়।  এভাবেই সাজিয়ে রেখেছেন মৃন্ময় তাঁর প্রান্তজীবনের আঙিনাকে।

      ভোর হতে চলল। প্রকৃতির ঘুম ভাঙছে।একটু পর জেগে উঠবে রাস্তাঘাট, ঘুম ভাঙবে বাড়ি, ঘর, দুয়ারের। লোকে মেপে নেবে রাস্তা, যান চলাচল সীমাবদ্ধ। প্রতি পা তখন ঘুমের আলাপ সাধবে। একা, শুধু এক সন্তানহারা  অসুস্থ মানুষের স্বামী তখনও রাস্তার দিকে চেয়ে থাকবেন  কয়েক ফোঁটা আলোর জন্য হাপিত্যেশ করে।

           সুপ্রভার কাশিটা বারান্দা থেকে শোনা যাচ্ছে। আচ্ছা, তাঁর কি বলা উচিত সুপ্রভাকে গতকালের ঘটনাটা? মৃন্ময়ের ভেতর কঠিন দোলাচল।

        তৃণাকে কোনদিনই পছন্দ ছিল না সুপ্রভার। অনির বন্ধুবান্ধবরা বাড়িতে এলে নিজে হাতে ওদের জন্য রান্না করে দিতেন, গল্প করতেন , মজা করতেন। অথচ তৃণাকে দেখলেই কেমন একটা থমথমে মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। যেদিন অনিকেত বাড়িতে জানালো

তৃণাকে ও ভালোবাসে, সুপ্রভার মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছিল। সারাটা রাত গুমরে গুমরে কেঁদেছিলেন। মৃন্ময় ভাবছিলেন, গতকাল তৃণার সাথে তাঁর দেখা হওয়াটা সুপ্রভাকে বলবেন কি না। এতবছরে সুপ্রভা হয়তো সব মেনে নিয়েছেন। না মেনেই বা কী করবেন! যে যাওয়ার সে তো চলে গেছে ।  তার জন্যই তো এত কিছু।

           ভোর প্রায় সাড়ে চারটে। সুপ্রভার কাশিটা হঠাৎ বেড়ে গেল যেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সুপ্রভার দিকে এগিয়ে গেলেন মৃণ্ময়। মশারি তুলে বিছানায় ঝুঁকে মাথায় হাত রাখলেন স্ত্রীর। তারপর গুটিশুটি ঢুকে  গেলেন চাদরের নীচে। চোখ বুজে আসছে ঘুমে। ঝিম ঝিম করছে মাথা। ঘুমন্ত অবস্থায় বিড়বিড় করলেন, ‘কাল বলতে হবে সুপ্রভাকে তৃণার কথা। সামনের মাসে ওর বিয়ে। বিয়ের আগে একবার দেখা করতে চায় সুপ্রভার সাথে। সুপ্রভা রাজী হলে ওকে বলবেন একদিন আসতে।

       দশ বছরের অনি খোলা ছাদে খেলে বেড়াচ্ছে। লাটাইটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলছে, ‘বাবি! আরও, আরও, আরও উপরে ওড়াও। অনেক উঁচুতে উড়তে চাই আমি, কী মজা! কী মজা!  আমার ঘুড়ি উড়ছে। কী মজা!মৃন্ময় হু হু করে উপরে তুলছেন ঘুড়িটাকে। হঠাৎ মাঝপথে ফস্ করে কেটে গেল তাল, উড়ে গেল ঘুড়ি। তারপর চোখের নিমেষে অনিকেতের পা পিছলে গেল কার্নিশের উপর থেকে। মৃন্ময় অবাক, ছেলে কার্নিশে কীভাবে গেল!  উপর থেকে নীচে পড়ে যাচ্ছে অনিকেত। ধড়মড় করে হাত বাড়িয়ে ছেলের হাত ধরে নিলেন, উপরে টেনে তোলার চেষ্টা করছেন মৃন্ময়, পারছেন না।ক্রমাগত সর্বশক্তি দিয়ে টানছেন। একসময় হাত আলগা হয়ে গেল। পড়ে যেতে যেতে  অনি চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘বাবা! আমাকে ক্ষমা করে দিও।’ মৃন্ময় পাথরের মত অবিচল দাঁড়িয়ে দেখছেন ছেলের চলে যাওয়া। নীচে পড়ে যাচ্ছে অনিকেত।

 একি! মৃন্ময় যে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। কী অদ্ভুত! নীচে পড়ে থাকা দেহ তো দশ বছরের কিশোর অনির নয়, নীচে পড়ে আছে বছর পঁচিশের যুবক অনিকেত! রক্তাক্ত, দুমড়ে মুচড়ে তাল পাকিয়ে যাওয়া একটা তরতাজা দেহ।

শিউড়ে উঠলেন মৃন্ময়। দু’হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে নিলেন।

দমবন্ধ হয়ে আসছে ।  এতটুকু হাওয়া নেই কোত্থাও। বুকের কাছটায় চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করছেন। চারদিক কালো হয়ে আসছে। ঝোড়ো হাওয়ায় যেন ভেসে যাচ্ছে তাঁর পলকা শরীর। অন্ধকার নেমে আসছে চোখের পাতার উপর।

দুঃস্বপ্নের ঘোর কেটে ধড়ফড় করে উঠে বসলেন মৃন্ময়। ঘেমেনেয়ে অস্থির। পাশ হাতড়ে দেখলেন স্ত্রী পাশে নেই। চিৎকার করে ডাকতে চাইছেন অথচ পারছেন না। অসম্ভব এক যন্ত্রণা  চেপে বসেছে সারাটা শরীরে। চোখ দুটো ঘোলাটে অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। মাথার শিরা-উপশিরাগুলো পলকা সুতোর মত ছিঁড়ে যাচ্ছে। মুঠো আলগা হয়ে হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে একফালি জীবন। জীবন বিমুখ হয়ে চলে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে। কিংকর্তব্যববিমূঢ় মৃন্ময়  সে যাওয়ায় অংশগ্রহণ করছেন মাত্র।

 ডক্টর’স ফিনাইলের গন্ধটা ঝ্যাট করে নাকে লাগলো মৃন্ময়ের। চারদিকে তাকিয়ে দেখে  মনে হল জায়গাটা তাঁর অচেনা। বিশ্রী গন্ধটা নাকে লেগে আছে ।  বোঝার চেষ্টা করলেন কিন্তু বুঝতে পারলেন না কোথায় আছেন এই মুহূর্তে  । দেখলেন পাশে সুপ্রভা বসে আঁচলে চোখ মুছছেন।

হাসপাতালে একধরনের  গন্ধ থাকে। গন্ধটাকে  মৃত্যুগন্ধ বলে চালানো যেতেই পারে। মৃন্ময় কথা বলার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। জিভটা জড়িয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। হাত বাড়িয়ে সুপ্রভার হাতটা ধরতে চাইলেন। এবারও পারলেন না। কী এক প্রবল শক্তি তাকে চেপে ধরেছে। বুকের কাছে চাপ চাপ ব্যথাটা আবার অনুভব করলেন  তিনি। চোখের সামনে  ঝলসে ওঠা তীব্র আলোয় পুড়ে যাচ্ছে তাঁর চোখ। ফিনাইলের গা-পাকানো গন্ধে বমি পাচ্ছে তার। পিঠ তুলতে চেষ্টা করছেন৷ কিছুতেই পারছেন না। তাঁর শরীরটা যেন হাসপাতালের বিছানায় গেঁথে গেছে। ক্রমে শরীরটা নির্জীব হয়ে যাচ্ছে । ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। তাকাতে পারছেন না। হঠাৎ পেটের কাছে খিঁচুনির মত করে উঠল। ঠোঁট দুটো দু’ বার  কেঁপে উঠে নিথর হয়ে গেলেন মৃন্ময় ঘোষাল।

 সুপ্রভা চন্দন পরিয়ে দিলেন মৃন্ময়কে। নতুন বস্ত্রে সাজিয়ে শেষবারের মত ছুঁয়ে দেখলেন স্বামীর নিথর শরীর। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শুনছো,সাবধানে যেও। অনিকে বলো ওর মায়ের ওকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে।’

সে রাতে বহুদিন পর ঝেড়েপুঁছে তানপুরা নামালেন সুপ্রভা। অন্ধকার পুরীতে যখের মত বেঁচে থাকা এক নিঃসঙ্গ মহিলা কবেকার হারিয়ে যাওয়া সুরে বুঁদ হয়ে গান করছেন, তাঁর সদ্যপ্রয়াত প্রিয়তম মানুষটার জন্য।

‘আমি যত বলি তবে, এবার যে যেতে হবে

দুয়ারে দাড়ায়ে বলে না না না

ও যে মানে না মানা।’

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


রিংকু কর্মকার চৌধুরী

ইংরেজী তে স্নাতকোত্তর।অপদার্থের আদ্যক্ষর পত্রিকা, পথের আলাপ, দৌড়, কবিতা ক্লাব, নতুন কৃত্তিবাস, চিলেকোঠা, নিয়ন,রংছুট, শব্দের মিছিল, শাব্দ, শব্দযান, বৃষ্টিদিন এ ছাড়াও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিওমিত লেখেন। কবির কাছে লেখা মনের আরাম। কেরিয়ার- নিজস্ব বুটিক অমলতাস।

2 Comments

shibani · এপ্রিল 20, 2019 at 1:40 অপরাহ্ন

অসাধারণ গল্প

কমল সরকার · এপ্রিল 20, 2019 at 2:54 অপরাহ্ন

অসাধারণ গল্প।

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।