বুড়ির চুল ও গোল্লাছুট
কিছু গল্পের কোনো শেষ হয় না,একটা বিন্দুতে আটকে থাকে।যখন গল্পটা মনে পড়ে ওই বিন্দু থেকেই শুরু হয়,যেমন প্রিয় গান লুপে চলতেই থাকে।তাই শেষ না হওয়া গল্পেরা সন্ধ্যে হলেই গা-ধুয়ে,চুল বেঁধে ফুরফুরে বৈশাখী বিকেলের সমস্ত নিভৃত প্রিয়তমতা নিয়ে চলে আসে।আর সেখান থেকে শুরু হয় অন্য যাপন।
যখন এরকম বিরাট সব স্বপ্নরা শরীর পায়নি,তখন একটা গোটা বিকেল আমাদের কপালে কোনো না কোনো ভাবে জুটে যেতো ঠিকই।তাই এক দৌড় দিলে পাড়ার মোড়ে একটা ছোটোখাটো জটলা মতোন যেটা হতো,সেটায় পৌঁছোনোর তাড়া থাকতো।ধুলোওড়া সেইসব নরম বিকেল মাড়িয়ে চলতো আমাদের বৈকালিক খেলাধুলো।প্রায়ই সময়ের হুঁশ চলে যেতো,আর খেলা উদ্ভাবন করতেও যথেষ্ট সময় লেগে যেতো।তখন চাইকি পাড়ার ভেতরেই একফালি মাঠ খুঁজে পাওয়া যেতো,সেটা পাড়ার দাদারা বিকেলে ঘন্টা দুয়েকের জন্য আমাদের ছেড়ে দিতে আপত্তি করতো না।সেখানেই আমাদের সঙ্গে আলাপ হয় বুড়ির চুলের।
একদিন যখন খেলা বেশ জমে এসেছে,সবাই মনের মতোন কিল চড় ঘুঁসি খেয়ে ও খাইয়ে একটা সমাধানের জায়গায় পৌঁছে গেছে,ঠিক সেইসময় ইয়া ঢোলা পাজামা পরা কাঁধে গামছা এক বুড়োমতো লোক নীল গোলাপি মনোলোভা তুলোর মতো কীসব প্লাস্টিকে পোরা নিয়ে এসে দাঁড়ালো।পাক্কা দু’সেকেন্ড লাগলো অবস্থাটা বুঝে নিতে।তারপরই বুড়োর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া হলো।ফেরিওয়ালা তো কতোই আসতো,ঝাল চানাচুর,মশলা বরফ,চটপটা আচার,গুড় বাদামের পসরা নিয়ে।তাদের সব চেনা মুখ,চেনা বলিরেখা চোখের পাশে।ভালোবেসে ‘ফাউ’দিয়ে যেতো কতো,হিসেব টিসেবের বালাই থাকতো না।সুখ-দুঃখের গপ্পোও যে হতো না তা নয়।সেই সময়টা গলার চারপাশে ফাঁস বুনে দেয়নি এতো,তাই সহজেই আপন বানাবার প্রক্রিয়া ছিলো নখদর্পণে।যাই হোক,এই বুড়োকে আগে কখনো দেখাই যায়নি তায় এর পসরাখানাও নতুনত্বে ভরপুর।প্রাথমিক প্রশ্নোত্তরের পালা চুকলে আমাদের কৌতূহল নিবৃত্তি করতেই বুড়ো একটা প্যাকেট খুলে হাতে হাতে একটু দিলো।একদম তুলোর মতোই,কিন্তু মুখে দিলেই গলে যায়!এমনকি হাতে ধরে রাখাও যায়না বেশিক্ষণ,চুপসে ছোট্টো গুটলি পাকিয়ে যায়।মজাদার তো বটেই!তা ছাড়া কেমন মিষ্টি।কিন্তু নাম শুনেই চোখ গোল হয়ে গেলো আমাদের।এম্মা!ছি!বুড়ির চুল বলে সবাই ওয়াক থুউউ করে দিলো।কেউ কেউ দৌড় দিলো বাড়ির দিকে।বাকি যারা থু-এর পালা সাঙ্গ করেই বুড়োকে চেপে ধরলো।বুড়ো কিন্তু টসকায়নি মোটেও!মিটিমিটি হেসে আধা হিন্দি আধা বাংলাতে যা বললো,তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায় এ মোটেও সত্যি বুড়ির চুল নয়,এর নাম এমন।
সত্যি বলবো?বিশ্বাস হলো না।পাড়ার পড়ুয়া বলে খ্যাত চশমা আঁটা দাদাদের অভাব ছিলোনা। সেরকমই একজনকে ক্লাব থেকে ধরে আনা হলো,সে তো হেসেই কুটিপাটি!”এ রামো!গাধাবাচ্চা সব।আরে এটা কটন ক্যান্ডি।বুড়ির চুল বলে লোকে খ্যাপায়।ছ্যাঃ!তোরা না মানুষ হলিনা।”বলে যে ডেকে এনে বৈকালিক আড্ডাতে বাগড়া দিয়েছে তাকে একখানা গাঁট্টা দিয়ে চলে গেলো।আর বুড়োও খুকখুক করে হাসতে হাসতে তল্পিতল্পা গুটিয়ে রওনা দিলো।
বলা বাহুল্য এই ঘটনার পরে ক’দিন ধরে স্কুলে,খেলার মাঠে এই আশ্চর্যজনক আবিষ্কারের গল্প চাউর হতে থাকলো।প্রতিটি দলেই অতি উর্বর মস্তিষ্কের কয়েকজন থাকবেই।আমাদের দলেও ছিলো।সে ছেলে টিনটিন,পান্ডব গোয়েন্দা,ঋজুদা,ফেলুদা ইত্যাদি পড়ে পড়ে বেশ বিশিষ্ট একজন বলে বিভিন্ন বৈপ্লবিক মতামত দিতো।শোনা গেলো,সেই নাকি বলেছে,বুড়ির চুলটা সত্যি হলেও হতে পারে।তবে কিনা ওটা এই পৃথিবীর নয়!এই অব্দি শুনে সকলের মনেই প্রশ্ন জাগলো,তবে কোথাকার বুড়ি?!!অম্লানবদনে ছেলেটি উত্তর দিলো,”কেন চাঁদের বুড়ির।ওজন্যেই তো দেখলিনা পৃথিবীর মাটিতে চুলটা কেমন চুপসে গেলো!”এই বিষয়ে বিভিন্ন মতপার্থক্য যে দেখা দেয়নি তা নয়,তবে কিনা প্রথমবারের অভিজ্ঞতার পরে কেউ রাজি হলোনা দাদাদের থেকে যাচাই করে আসতে।অতএব,ঠিক হলো এটাই গ্রহণীয় বক্তব্য।সন্ধ্যেবেলা হলেই গোল থালার মতো চাঁদটা দেখতাম,মনে মনে ভাবতাম হলোই বা চাঁদের বুড়ির চুল,বুড়োটা কি করে সেটা পায়?ও বুঝি চাঁদের বুড়ির ভাইপো হবেও বা।ভালোবেসে ওকে দিতেই পারে!কিন্তু তা বলে কেনই বা সেটা প্লাস্টিকে করে বেচতে আসবে?কী জঘন্য!
এরপরে শহর বদলেছে,বদলেছে বৈকালিক নিয়ম।নাগরিক ব্যস্ততায় অনেকসময় খেয়ালই হয়না বিকেলটা কখন ফাঁকি দিয়ে খরচ হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।এরকমই ব্যস্ততার ফাঁকে হঠাৎ কোথাও চোখে পড়ে যদি নীল গোলাপি বুড়ির চুলের ফেরিওয়ালা,একবার মেপে নিই ভালো করে।সেই বুড়োর সঙ্গে যদি দেখা হয়েই যায় একবার শিখে নিতে হবে,এতো দিন ধরে চাঁদের বুড়ির চুল কী করে পৃথিবীর ছোটো ছোটো জিভে স্বর্গীয় স্বাদের ফোয়ারা ছোটানো জারি রেখেছে।
1 Comment
Kaberi Roychoudhury · ফেব্রুয়ারি 22, 2019 at 6:52 অপরাহ্ন
poulomi bhari mon kemon kara ekta lekha upohar dili! kalom choluk.