একজন টিকটিকি (পর্ব – ৫)
সন্ধে হয়ে এল। দীনবন্ধুর জন্য তবু বসে রইল যোগেন।
মিষ্টি একটা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে।যোগেন এই গন্ধটা খুব চেনে। গন্ধটা কেয়া ফুলের।এসময় কদমফুলের দিকে তাকালে যেমন মন ভাল হয়ে যায় ঠিক তেমনি কেয়া ফুলের গন্ধ ছটফটিয়ে মারে। এতটাই ভাল গন্ধ যে বুকের ভিতর খাঁ – খাঁ করে ওঠে।
অথচ ভয়ে কেউ কেয়া গাছের আশেপাশে যায় না রাতে। যে ফুলের যত বেশি গন্ধ তার সাথে সাপের গল্প তত বেশি জড়িয়ে থাকে।
যোগেন মাচা থেকে নেমে গাছটা খুঁজতে লাগল। আবছা অন্ধকারে বেশ কিছুটা এলোমেলো যাবার পর খুঁজেও পেল। ফুলগুলো পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে। শুধু গন্ধ লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা ওদের নেই বলে ধরা পড়ে গেছে।
হাতে কয়েকটা ফুল তুলে নিয়ে আবার মাচায় ফিরে এসে বসল যোগেন।
চাঁদ উঠেছে।
রুপালি চাঁদের আলোয় সবকিছু ভাসছে। ঝিরিঝিরি বাতাস আর আকাশ থেকে জ্যোৎস্না ঝরছে।
সেই জ্যোৎস্না যোগেনের মাথা ছুঁয়ে, পা বেয়ে মাটিতে পড়ছে, ঠিক মাটি নয় যেন জ্যোস্নার নদীতে সে বসে আছে।
বর্ষা এলেই সবাই নিজের মত করে বেঁচে ওঠে। গরমে হাড়পাঁজরা বের করে থাকা নদীটিও এখন তরতরিয়ে ছুটবে। যাকে শীত কিংবা গরমে অনায়াসে ভুলে থাকা যায় সেই নদীই বর্ষা এলে নিজে থেকে জানান দেয় আর প্রতি বছরের মত আস্ত মানুষ গিলবার জন্য হাঁ করে থাকে। ফাঁদ পাতে। কেউ না কেউ সত্যিসত্যিই ডুবে যায় প্রতিবছর।খুব কাছের এই নদীটির নাম আত্রাই। শহরের লোকেরা বলে আত্রেয়ী।
যোগেন লক্ষ্য করে দেখেছে, বর্ষাকাল এলেই সব হেলেঞ্চা পাতার মত বাড়তে থাকে। সব পালটে যায়।
আধমড়া ব্যাং গিলে বেকুব হয়ে থাকা দাঁড়াশ সাপ চোখের পলকে এইসময়ে ছটফটে জোয়ান হয়ে ওঠে।
রাত বাড়ল। দীনবন্ধু এল না।
অপেক্ষা করতে করতে বাঁশের মাচাতেই ঘুমিয়ে পড়ল যোগেন। মাঝরাতের দিকে চেনা ফোঁস-ফোঁস শব্দ হল। যোগেন টের পেল না।
ঘুম ভাঙল ভোরে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
যোগেন ধড়মড় করে উঠে বসল।
***
দীনবন্ধু থানা থেকে বেরিয়ে এল সকাল নটার একটু পরে।
সারারাত তাকে বসিয়ে রেখেছিল। দু’বার জেরা করেছে। কারণ তার পকেট থেকে বেরিয়েছে একটা আস্ত টিকটিকি। এইনিয়ে থানায় বেশ কিছুক্ষণ হুলস্থুল কান্ড চলেছে।
ডিউটি অফিসার যখন বললেন আপনার কাছে যা আছে তা টেবিলে রাখুন।
দীনবন্ধু পকেট থেকে টিকটিকিটা বের করতেই শুরু হল হইহই কান্ড!
বেশ কিছুক্ষণ পর তারা ফোনাফুনি করে সিদ্ধান্ত
নিল তাকে লক আপে নেওয়া হবে না। অযথা জগদীশের বাড়ি যাতে আর না যায়, পকেটে করে টিকটিকি না নিয়ে ঘোরে এসব বিষয়ে জোর ধমক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে।
দীনবন্ধু এত সহজে রেহাই পাবেন বুঝতে পারেননি। তার অতীতের প্রসঙ্গ একবারও কেউ তোলেনি। কী করেন? তা জানতে চায়নি।শুধু জগদীশের বাড়ি দিন দুয়েক ঘুরঘুর করছেন কেন তা জানতে চেয়েছে।
দীনবন্ধু স্পষ্ট বলেছে, “আমি স্যার একটা হাইস্কুলে কাজে ঢুকেছিলাম। বেল বাজানো, তালা দেওয়া-খোলা এইসব কাজ করতে হত। মাসগেলে হাজার তিনেক দিত। পকেটে টিকটিকি রাখায় এই চাকরি গেছে এটাই ভেবেছিলাম। আসলে সত্যিটা হল শুধু এই নিরীহ টিকটিকিটার জন্য নয় একজন টিকটিকি মানে আপনাদের জগদীশ খবর দিয়েছে আমি লোকটা সুবিধার নয়।
এসব প্রশ্ন না করে শুধু বসিয়ে রেখে তাকে বার বার এক প্রশ্ন করা হল, পকেটে টিকটিকি রাখেন কেন? এর লেজ কোথায়? কিলবিশ খান?
বেশ কিছুক্ষণ যাবার পর দীনবন্ধু জানলেন তার এই মহা ছাড়ের পেছনে দুটি কারণ।
এক, গত সপ্তাহে এক পাগলকে ভুল করে লক আপে রাখা হয়েছিল। সে লক আপের ভেতরে সমস্ত পাইপের মুখ খুলে দিয়েছিল। ফলে বড়বাবুকে ঘন্টা দুয়েক টেবিলে বসে থাকতে হয়। কেউ এই ভুল দ্বিতীয় বার করতে চাইবে!
দুই, পকেটে টিকটিকি থাকায় অফিসারেরা দুশো পার্সেন্ট নিশ্চিত তিনি পাগল।
যা কিছু হোক দীনবন্ধু এসব কাজে একদম বিরক্ত হন না। এ জগতের সবাই নিয়ম মানা নিয়ে বড্ড সিরিয়াস। যদিও সেটা নিজের জন্য নয় অন্যের উপরে। নিজের জন্য নিয়ম অধিকাংশ মানুষ পছন্দ করে না।
দীনবন্ধু এই অধিকাংশ মানুষের মধ্যে পড়েন না। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে, ন’টা বাজতে পাঁচ মিনিট আগে যখন ডিউটি অফিসার তার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, “এই যে আপনি
এখনও বসে আছেন কেন? ঠিকানা লিখে নিয়েছি। দরকারে ডেকে নেব। এখন যান।”
দীনবন্ধু বেঞ্চ থেকে উঠল হাসিমুখে, “আমার তাড়া নেই স্যার। আর এক দফা জিজ্ঞাসাবাদ থাকলে অনায়াসে বসে থাকতে পারি।অনেক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয় আপনাদের। দেখা গেল আমি চলে গেলাম তারপর আপনার মনে পড়ল লোকটার অমুক খানে সই নেওয়া হয়নি। তমুক কথাটা জানা হয়নি। আমি জানি স্যার, সঠিক পর্যবেক্ষণের উপর একজন পুলিশ অফিসারের যাবতীয় কাজের সফলতা নির্ভর করে। আমার এভাবে চলে যাওয়াতে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে সমস্যা হতে পারে। কত কী নিয়ম আছে ।তাইনা!”
ডিউটি অফিসার আরও বিরক্ত হলেন তারপর আরও গম্ভীর গলায় বললেন, “অযথা বকবক করবেন না। এক্ষুনি থানা থেকে বেরিয়ে যান।”
দীনবন্ধু থানার গেটে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ যদি জগদীশের দেখা পান।লোকটার সংগে দেখা না হওয়া অব্দি তার মন শান্ত হবে না। না, তার জগদীশের উপরে আর রাগ নেই। জগদীশ যা করেছে তা হল ডিউটি। মানুষ নিজের নিজের ডিউটি পালন করবে এটাই জগতের সবচেয়ে বড় নিয়ম।
দেখা হলে তিনি জগদীশ কে কী বলবেন তা ঠিক করে রেখেছেন। হাত বাড়িয়ে বলবেন, “ভাই তুমি থানার টিকটিকি। আর আমি একজন সাধারণ টিকটিকি।তুমি আমার বাবার কথা জেনেছ।সময় থাকলে আমার মায়ের কথা শুনবে।শুনলে ভাই আমি খুব আনন্দ পাব।চলো চা খেতে খেতে দু’জনে টিকটিকি নিয়ে গল্প করি।”
জগদীশ কি চা খেতে যাবে? না কী ভয় পাবে? যেমন সবাই তাকে ভয় পায়।
পড়ুন, এই ধারাবাহিক উপন্যাসের আগের পর্ব।
0 Comments