একজন টিকটিকি (পর্ব – ১৪)

শুভ্রদীপ চৌধুরী on

ekjon_tiktiki

রাত একটা কুড়ি। টিমটিম করে জ্বলছে কম পাওয়ারের হলদে বাল্‌ব। সেই আলোর নীচে দীনবন্ধু থমথমে মুখে ঘরের মেঝেয় বসে আছেন। তিনি একা নন, তার সামনে বসে আছে যোগেন।কারও মুখে কোনও কথা নেই৷

পরপর চারদিন জগদীশের বাড়ির চারদিকে ঘুরঘুর করে বেশ কিছু খবর এনেছে যোগেন। তাতে সহজেই বোঝা যাচ্ছে জগদীশকে পুরো বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে না রাখতে পারলে কিছুতেই কিছু করা যাবে না। সময় কমে আসছে। পুলিশ নজর রাখছে সব সময়। পুলিশের চোখ এড়িয়ে সবটা করা মুশকিল।

দীনবন্ধু নিশ্চিত দু একদিনের মধ্যে আবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যাবে পুলিশ। এসব কিছু হবার আগেই পুরো কাজটা শেষ করতে হবে।

এর আগে যখন পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গিয়েছিল  অনেক কিছু সহজেই এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন।  এখন সেটা করা যাবে না।  কায়দা করে মন্ত্রীর কথা বলেছিলেন।

শুরুতেই অফিসারটি প্রশ্ন করেছিল, আপনি বলছেন জগদীশের বিপদের আঁচ পেয়ে আপনি ওর বাড়ি ছুটলেন। এসব আগাম বিপদের খবর আপনাকে কে দেয়? সমস্ত গরীবমানুষের এমন বিপদের খবর দিতে ছোটাছুটি করেন? খবর পান কী করে? আপনার  পকেটে থাকা টিকটিকিটা খবর দেয়?

— আপনি মজার মানুষ স্যার। একসংগে এত প্রশ্ন করে আমায় ঘাবড়ে দিচ্ছেন। তবে স্যার আজকাল আমি ঠিক করেছি যা খুশি হোক ঘাবড়াবো না।  জানতেই যখন চাইছেন তখন শুরু থেকে বলি,

আমার জন্য উদাসের লেজটা কাটা পড়েছে।

— উদাস কে?

–এই টিকটিকিটার নাম রেখেছি উদাস। ভাল না নামটা, স্যার?

— যা বলছিলেন বলে যান।

—উদাসের লেজ কাটার পর এমন তো কতকিছুই হয়নি ভেবে চলে আসতে পারতাম। ভাবলাম এর পর কী হবে?  লেজ ছাড়া উদাস চলবে কী করে? এই লেজের গুন তো অনেক।

—–লেজের গুন সম্পর্কে আপনি অনেকটা  জানেন  দেখছি। কত কী জানেন!

—–আর একটা কথা স্যার, আমি এটাও  ঠিক করেছি যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ব্যাপারে মাথা ঘামাবো না। গরীবমানুষের এত দিক ভাবলে চলে না। তাই না স্যার? আপনি রাগ না করলে আমি লেজ বিষয়ে যতটুকু জানি একটু গুছিয়ে বলার চেষ্টা করব। অনেক সময় লাগবে তাই আজ শুধু টিকটিকির লেজ নিয়েই বলব।

—- বলুন।    

 —  টিকটিকি কথা বলতে পারে না। তাই এই লেজ নেড়েই একে-অপরের সঙ্গে কথাবার্তা  বলে।  বলতে পারেন, এর নাম গোপন টিকটিকি-ভাষা।  ভেবে দেখুন স্যার, বেচারাদের সারাক্ষণ দেয়াল বেয়ে ওঠা, লাফঝাঁপের ভেতরে দিন-রাত থাকতে হয়। আপনি তো জানেন স্যার শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতেও লেজ বড় দরকারি।

— থামলেন কেন?

—আমি ঠিক করলাম যতদিন না উদাসের  লেজ আবার আগের মত

হচ্ছে ততদিন ওকে আমি কাছছাড়া করব না।  হরিমতি স্কুলের লাইব্রেরিতে একটা বইতে পড়েছিলাম  লেজ খসানো আর গজানোয় ওস্তাদ আর্জেন্টিনার বিশেষ এক প্রজাতির টিকটিকি। এরা জীবনে পাঁচ না ছয়বার লেখাছিল ঠিক মনে পড়ছে না। ধরেনিন ছয়বার পর্যন্ত লেজ খসায় আর লেজ গজায়! স্যার একটা প্রশ্ন ছিল! ঠিক সাহস পাচ্ছি না।আমার জেরা চলছে আসামি হিসেবে প্রশ্ন করা কি ঠিক হবে?  করব?

— প্রশ্ন?

—আপনার চেনা জানার মধ্যে আর্জেন্টিনায় কেউ থাকলে একটু খোঁজ খবর নেবেন তো। ব্যাপারটা কতটা সত্যি? আপনি কি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছেন?

—- না। আপনি জেলে কতদিন ছিলেন?

—– চারবছর তিনমাস বাইশ দিন। ঠিক বাইশ দিন নয়। সাড়ে বাইশ বললে ঠিক বলা হবে। দুমকরে আমার বেরুনোর দিন খবর এল কারামন্ত্রী আসছেন। জেলার সাহেব বললেন,  যাবার আগে মন্ত্রীস্যার কে একখানা গান শুনিয়ে যেও।

—  বাহ্। আপনি গান জানেন?

—- ওই টুকটাক। শুনে শুনে  যতটুকু গলায় বসিয়ে নেবার চেষ্টা করি। সবই লোকগান।

— কারামন্ত্রীকে শোনালেন?

—– একটা গেয়ে থামতেই দেখি উনি বলছেন আরেকটা শুনি। বুঝলাম গানের কথা শুনে উনি মুগ্ধ হয়েছেন। জেলে পরিচয় হয়েছিল পবন রুইদাসের সঙ্গে সে মাঝেমধ্যেই হেঁড়ে গলায় দুটো লাইন  গুনগুন করত,  ‘হাওয়ার উপর চলে গাড়ি,

লাগেনা পেট্রোল ডিজেল।

মানুষ একটা দুই চাক্কার সাইকেল।

কি চমৎকার গাড়ির মডেল গো,

চমৎকার গাড়ির মডেল,

মানুষ একটা দুই চাক্কার সাইকেল।’

আমি পবনকে ধরলাম এর পরের লাইন কী?  ও বলল, জানি না। কথা দিল জেল থেকে বেরুলেই সবটা জেনে এসে আমায় বলে যাবে।পবন কথা রেখেছিল স্যার, গানের কথা দিতে এসেছিল জেলে।

মন্ত্রী মহাশয় সে গান শুনে বললেন, আপনি আমায় মাঝেমধ্যে গিয়ে গান শোনাবেন। আমি সমস্ত ব্যবস্থা করে রাখব। যাবেন তো? এত জোর করলেন যে মাঝেমধ্যেই যেতে হয়। অনেকে বলে উনি আমায় খুব পছন্দ করেন। কথা যে মিথ্যা নয়  তাও জানি। কিন্তু ওনার কাছ থেকে কাজ টাকা-পয়সা কিছুই নিইনি। চাইনি কোনওদিন।

— কেন?

—- এটা হল একটা সংস্কার। সহজ করে বলি, ছেলে- মেয়ে  অসুস্থ হলে বাবা, মা সারারাত জেগে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। প্রয়োজন হলে সারাটারাত জেগে থাকে। এটা হল ঘুমানোর সংস্কার কে জয় করা। এই জেগে থাকা পেছনে আছে শুধুই ভালবাসা। আমার গানের মাধ্যমে শুধুই আনন্দ ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করিনা।আমার এই উত্তরটা কেউ বিশ্বাস করে না।

হয়ত আপনিও করবেন না।

—বিশ্বাস  করেছি। আপনি বলে যান।

— আপনি মিথ্যে কথা বলছেন স্যার।

— কেমন করে বুঝলেন?

—- আমি সত্য- মিথ্যা বুঝতে পারি। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা করতে পারেন!

— কেমন করে বুঝতে পারেন?

—আপনি আমার চোখের দিকে না তাকিয়ে বললেন, বিশ্বাস করেছি। আপনি বলে যান। যদি সত্যিই বিশ্বাস করতেন তবে চোখে চোখ রেখেই বলতেন। আপনি চাইলে আমার আরও পরীক্ষা নিতে পারেন। 

— থাক, পরীক্ষার দরকার নেই। আপনি বলুন কেন জগদীশের পিছু নিয়েছেন?

—আগেই বলেছি স্যার লোকটার বিপদ। তাই…!

ততক্ষণে দীনবন্ধু স্পষ্ট বুঝে গিয়েছেন, সামনের অফিসার মানুষটি মিনিট দশেক আগে  যেমন ছিলেন ঠিক তেমনটা আর নেই!

নিজেকে শান্ত করে একটার পর একটা  উত্তর দিয়ে গেলেন। বারবার মন শান্ত করার কথা বলত মায়ারানী। বলত, ‘মনের চিন্তাভাবনার উপরে ভাল করে লক্ষ্য করবি। তাতেও যদি মন শান্ত না হয় তবে মনে মনে একটা মোমবাতির শিখা কল্পনা করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবি। হাজার চেষ্টা করলেও তোকে বুঝতে পারবে না। এভাবেই তুই দুঃখ, ভয়, দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাবি ।’   

— আমি মুক্ত হতে পারবো, মা?

—- কেন পারবি না?

—-  চোখ বন্ধ করে থাক কিছুক্ষণ।  কী অনুভব করছিস?

—–নানান চিন্তা উঠছে মনে।

—- ঠিক। আরও মন দিয়ে দ্যাখ। মনের ভেতরে চিন্তা খেলা করছে। এই বার প্রশ্ন করতে হবে, আমি কে? আমার কাজ কি? আমার স্বপ্ন কী?

মনে রাখবি আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই বলেই তা দেখতে পাই। নিজের কাজ থেকে এক পা পিছিয়ে আসবি না।শুধু চিন্তার হাত থেকে মুক্তির রাস্তা খুঁজবি।তবেই তুই যা চাস তাই হবে। তুই যা হারিয়েছিস তা একদিন ফেরত পাবি।’

ফড়ফড় শব্দ তুলে দুটো ফড়িং জোড় বেঁধে উড়ে এল ঘরে। বাল্ফের ঘোলাটে আলোর আশেপাশে   চক্কর কাটতে লাগল।যোগেনের ফিসসিস করে বলল, বৃষ্টি নামবে। মুষলধারে বৃষ্টি নামবে।   দীনবন্ধু অবাক চোখে তাকালেন যোগেনের দিকে। সত্যি সত্যিই  আধাঘন্টার মধ্যে তুমুল বৃষ্টি নামল।

জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দীনবন্ধুর চোখে পড়ল একটা মাকড়সা। সাদা কালো ডোরাকাটা। এর আগেও এমন মাকড়সাকে মাছি শিকার করতে  দেখেছে দীনবন্ধু। মাছিকে বসে থাকতে দেখলেই তার কাছে এসে বসে। এর পর পা টিপেটিপে এগিয়ে যায়। তিন- চার ইঞ্চি  ফাঁক থাকতে মাছির ঘাড়ের উপরে লাফিয়ে পড়ে।

এসব ভাবতে ভাবতেই দীনবন্ধুর    মাথায় এল প্ল্যানটা। যোগেনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, কতক্ষণ বৃষ্টি চলতে পারে?

— আধঘন্টার বেশি।

–তবে যে করেই হোক আজ রাতেই সাধনবাবুর বাড়ি থেকে ডায়েরিটা উদ্ধার করতে হবে।আর দেরি নয় চলো বেরিয়ে পড়ি।

মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে কাঠের হাতলওয়ালা একটা ছাতা এগিয়ে চলেছে। ছাতার নীচে দুজন মানুষ ফিসফিস করে গল্প করছে। তাদের গল্প বৃষ্টির শব্দে হারিয়ে যাচ্ছে।


ক্রমশ…


পড়ুন, এই ধারাবাহিক উপন্যাসের আগের পর্ব।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


শুভ্রদীপ চৌধুরী

শুভ্রদীপ চৌধুরীর জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৮৩। গ্রামের নাম ইদ্রাকপুর। বাংলাসাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা। প্রথম গল্প প্রকাশ ২০০৪ সালে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা সূত্রে বালুরঘাটে থাকেন। অক্ষরে আঁকেন গল্প। লেখকের কথায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যা শেখায়, "যা মনে করায় তার প্রতিচ্ছবিই আমার লেখা"। যোগাযোগঃ subhradip.choudhury@gmail.com

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।