একজন টিকটিকি (পর্ব – ১০)
দীনবন্ধু বুঝলেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন।
যা হচ্ছে তা সত্যি নয়। পরক্ষণেই মন হচ্ছে সত্যি হলেও হতে পারে! জন্মের তিন- চার মাস পর থেকেই শিশুরা স্বপ্ন দেখা শুরু করে।
মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে স্বপ্ন দেখা ততই কমতে থাকে। একসময় স্বপ্নহীন হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়।
ট্রেনে চটি বই ফেরি করত যুগল রায়। লোকটা বলেছিল, ক্লান্ত মানুষ প্রথম দুই ঘন্টা ঘুমানোর সময় স্বপ্ন দেখে না। তারপর দ্যাখে। অন্তত চার পাঁচটা স্বপ্ন প্রতিদিন আমরা দেখি। এর মধ্যে অল্প কিছু মনে থাকে। বাকি সব হাওয়া হয়ে যায়।
দীনবন্ধু জানতে চেয়েছিল, কেন সব স্বপ্ন মনে রাখতে পারে না মানুষ?
যুগল রায় হেসে বলেছিল, সব স্বপ্ন ধরে রাখার মত ক্ষমতা মানুষের নাই। আর যদি সব মনে থাকত তবে মানুষের দুঃখকষ্ট বলে কিছু থাকত না। স্বপ্নের তুলনায় মানুষ যে বড়ই সামান্য।
মায়ারানী মন্ডল একটু উঠে ট্রাংকের ভেতরে উঁকি দিয়ে বললেন, সব কাগজপত্র গুছিয়ে রেখেছিস। বিশেষ করে তোর হাতের চিঠিটা দেখে লজ্জা পাচ্ছি রে দিনু।
দীনবন্ধুর হাতে ধরা হালকা হলদে রঙের চিঠি। সেই চিঠির ঠিক মাঝখানে লালরঙের পদ্মফুলের পাপড়ির গোল ফ্রেম। এর মধ্যে হাতে হাত রেখে বসে আছে বর ও কনে। তাদের মাথার উপরে মেঘ। মেঘের উপরে বসে আছেন ব্রহ্মা। এই গোলাকার ছবিটির নীচে কায়দা করে লেখা শুভ বিবাহ।
মায়াদেবী আবার আগের মত বসে পড়েছেন। তার মুখ লজ্জায় লাল। মাথা নীচু করে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঝেতে আধখানা বৃত্ত আঁকার চেষ্টা করছেন। যেন এই কাজটি করতে না পারলে বিরাট কিছু ক্ষতি হয়ে যাবে!
দীনবন্ধু গলাটা খানিক নরম করে বলল, চিঠিখানা পড়ব মা ?
মাথা না তুলে একদম নীচু গলায় মায়ারানী উত্তর দিলেন, হুম।
দীনবন্ধু পড়তে লাগলেন,
স্মারকলিপি
বরানুগমন — ১৫ ই বৈশাখ( ২৮ শে এপ্রিল) সোমবার ৭ ঘটিকা
প্রীতিভোজ — ২০ শে বৈশাখ( ৩রা মে) শনিবার, ফুটানিগঞ্জের হাট সংলগ্ন মদীয় বাসভবন।
একটু থেমে আবার অন্য পাতা থেকে পড়তে লাগলেন,
শ্রী শ্রী প্রজাপতয়ে নমঃ
সবিনয় নিবেদন,
আগামী ১৫ ই বৈশাখ( ইং ২৮ শে এপ্রিল) সোমবার, মহিমপুর, দিনাজপুর নিবাসী শ্রীযুক্ত ফণীন্দ্র নাথ মন্ডল মহাশয়ের কনিষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী মায়ারানী মন্ডলের সহিত আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীমান অমলেন্দু মন্ডলের শুভ-পরিনয় হইবে।
তদুপলক্ষে মহাশয়, সবান্ধবে মদীয় ভবনে শুভাগমন করতঃ শুভকার্য্য সুসম্পন্ন করাইয়া বাধিত করিবেন।পত্রদ্বারা নিমন্ত্রণ করিলাম, ত্রুটি মার্জনা করিবেন।
বিনীত
প্রশান্ত কুমার মন্ডল
চিঠি পড়া শেষ হতেই মায়াদেবী ঈষৎ মুখ তুলে উদাস গলায় বললেন, আমার জেঠুর মেয়ে মীরা আর জনা লিখেছিল বিয়ের পদ্য।
“যে তোরে বাসেরে ভালো তারে ভালবেসে বাছা,
চিরকাল সুখে তুই রোস।
মোদের ঘরে রতন আছিলি তুই,
এখন তাহারি তুই হোস।
আমাদের ভালোবাসা নিয়ে যারে,
একপরিবার হইতে অন্যপরিবারে।
সুখশান্তি ঘোরে যেন তোর পাছে পাছে,
দুঃখ জ্বালা রেখে যাস আমাদের কাছে।
হেথা রাখিতেছি ধরে
সেথা চাহিতেছে তোরে।
দেরী হলো যা তাদের কাছে,
প্রাণের বাছাটি মোর।
লক্ষ্মীর প্রতিমা তুই,দুইটি কর্তব্য তোর আছে,
একটু বিলাপ রেখে যাস আমাদের কাছে।
তাহাদের তরে আশা যাস সাথে নিয়ে,
এক বিন্দু অশ্রুজল দিস আমাদের তরে।
হাসিটি নিয়ে যাস তাহাদের ঘরে।”
দীনবন্ধু অবাক হয়, সবটা এখনও মুকস্থ আছে তোমার!
মায়াদেবীর গলা কেঁপে গেল, মনে রাখার চেষ্টা করিনি। তবু ভুলতে পারিনি। খুব সত্যি আর খুব বানানো মানুষ সারা জীবনে ভুলতে পারে না। সেসব বয়ে বেড়াতে হয়। একজন বিধবার কানে যখন ভেসে আসে ‘রতন আছিলি তুই’ তখন বানানো কথাটাকে খুব খুব মনে ধরে। সেদিন ছাদনাতলায় বসে শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, যদি এই পদ্য সত্যি হত! বিয়ের আসরে বসে পন্ডিত মশায়ের বিয়ের মন্ত্র শুনছিলাম। একবর্ণ বুঝতে পারছিলাম না। শুধু কানে ভাসছিল, বানানো একটা লাইন ‘মোদের ঘরে রতন আছিলি তুই’!
দীনবন্ধু ভার গলায় বলল, ছাড়ো ওসব পুরনো কথা। তুমি কীভাবে গোপনে বালুরঘাট থেকে পিস্তল নিয়ে গোয়ালন্দে পৌঁছে দিতে সেই গল্পটা বলো।এখন তো তোমার মন্ত্রগুপ্তির বাধা নেই।
মায়াদেবী হাসেন, পাবনার একটা প্রবাদ আছে। আমার দিদিমা বারবার বলতেন,
‘এই কথা সেই কথা
দে লো বুড়ি আলাপাতা।’
আলা মানে হল দোক্তা। দাঁতে গুল দেওয়া বুড়িরা নানান বাহানা করে আসল কাজের কথায় আসত। ঠিক তোর মত দীনু।
দীনবন্ধু হাসে, আজ শোনাও।এটা জানা খুব দরকার আমার।
— জানি।
— তুমি জানো?
— হুম।
— তোমার কি মনে হয় আমি ঠিক কাজ করছি মা?
— ঠিক, ভুল অন্যের মুখে শুনে চলা বন্ধ কর। চোখ বন্ধ করে নিজেকেই প্রশ্ন করবি। যা উত্তর পাবি তাই করবি।
— আমার সব সময় মনে হয় ঠিক করছি। সেদিন যা করেছিলাম ঠিক করেছিলাম। তবু দ্যাখো সেই রাতের পর আমার জীবনটা কেমন অন্ধকারে ডুবে গেল। চাইলেও চেনা জায়গায় গিয়ে বসতে পারি না। আমাকে দেখলেই চাপা ফিসফাস বাড়ে। কাজ টেকে না। জেল থেকে ফিরে বাড়ি ফিরেছিলাম, সুভা বলল তুমি চলে যাও। এখানে থাকলে আমরা গ্রামে একঘরে হয়ে যাব। তোমার মেয়েটার বিয়ে হবে না। নিজের মেয়ের ভাল চাইলে আর কখনও যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।
— তারপর আর কখনও যাসনি ওদের দেখতে।
দীনবন্ধুর রক্তে লক্ষ পিঁপড়ে ওঠানামা শুরু করে। বুকটা চিনচিন করে ওঠে।কোনও মতে বলে, যাই,দূর থেকে দেখি। আমার মেয়েটার সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছে করে। মনে হয় ছুটে যাই। গিয়ে বলি, কেমন আছিস মা? আমাকে চিনলি? সেও কি বলবে, তুমি খুনি! যদিও সেটাই আমার পরিচয়। এর বাইরে আমার আর কোনও পরিচয় মাথা তুলতে পারেনি মা। অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। তাই এই পথে নেমেছি মা।
মায়ারানী মুখে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বলেন, নিজেকে প্রমাণ কর দিনু।মাথা উঁচু করে বাঁচ। মনে রাখবি বিরাট ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে লাগে শুধু সাহস। অথচ অধিকাংশ মানুষ অপেক্ষা করে ভয়ের। ভয় পেতে চায়। আমাদের লড়াইটা ছিল অজস্র মানুষের। তোর লড়াই একার। যা জানতে চেয়েছিস তা এবার বলি, ১৯৪১ সালের ঘটনা । শ্রাবণ মাসের এক বিকেলে খবর এল সন্ধের পর আত্রেয়ী ঘাটের কাছে যেতে হবে।একা। কিছু সংকেত আর বানানো নাম জানলাম। তখন আমার মাথার দাম সরকারের কাছে পাঁচ হাজার টাকা।তাই খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়।
আত্রেয়ী ঘাটে সময়ের অনেক আগে গিয়ে দাঁড়ালাম।বেশ কিছুক্ষণ পর একজন পুরুষ মানুষ এসে দাঁড়ালেন ঘাটের কাছে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সোজা নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন। জলে শব্দ করে পা ডুবিয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে এলেন।আশপাশের মেছো নৌকোয় জ্বলে উঠেছে লম্ফ।সেই আলোতে বুঝলাম পুরুষমানুষটির হাতে একটা মস্ত ছাতা। নির্দেশ যা এসেছিল তাতে জেনেছি যিনি পিস্তল দিতে আসা মানুষটির হাতে থাকবে একটা ছাতা।
আমি ধীরেধীরে এগিয়ে গিয়ে ওনার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, ওপার যাবেন বুঝি?
উত্তর এল, হুম। আপনি?
— আমিও।
ভদ্রলোক বেশকিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে হাঁকরে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমার ব্যাগ আর ছাতাটার একটু খেয়াল রাখুন আমি নৌকার খোঁজ নিয়েই আসছি। কথা শেষ করে হনহন করে আত্রেয়ীর দিকে নামতে লাগলেন।
আমি আর সময় নষ্ট না করে ছাতা আর ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। জানতাম ব্যাগে মুড়ি-বাতাসার পুটলির ভেতরে আছে পিস্তল। ছাতার ভেতরে সেলাই করে একটা কাগজের টুকরো জুড়ে দেওয়া। তাতে লেখা,তোমার নাম হবে পার্বতি। বাড়ি ঢাকার ঢাকেশ্বরী। তোমার দাদার নাম জয়ন্ত দত্ত। তোমার সঙ্গীর নাম,সুমন্ত বসু।বাড়ি বালুরঘাট। তার স্ত্রী সাজবে সান্তাহার স্টেশনের পর থেকে।খবরদার তার আগে কেউ কাউকে চিনবে না। বালুরঘাট থেকে হিলি যাবে বাসে।সময় সন্ধে ছ’টা দশ। হিলি স্টেশনের উত্তর দিকে একটা ঝাঁকড়া করবী গাছ আছে তার নীচে দাঁড়াবে। সুমন্ত টিকিট নিয়ে তোমার কাছে আসবে।মনে রাখবে তোমাদের খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে তাই আবদারটা বেশি করবে।
হিলি স্টেশনে সেই একলা দাঁড়িয়ে থাকা করবী গাছের নীচে দেখা হল আমাদের। একখানা টিকিট আমার দিকে বাড়িয়ে সুমন্ত বলল, সাবধানে রাখবে।
—রেখেছি।
–লোডেড?
— হুম।
— সেফটি দিয়ে রেখেছ?
—হুম। আমার কার্তুজ একটা কম আছে তাই।পাঁচের ঘর খালি রেখেছি।যাতে এক থেকে চার পরপর কাজ হয়।
সুমন্ত হাসল, আমরা সফল হব। এক্সপ্রেস ট্রেন এসেছে। আমি ইঞ্জিনের পরের বগিতে গিয়ে উঠবে, আমি ট্রেন ছাড়ার আগে দৌড়ে উঠব। চারদিকে চোখ রাখবে। আই বি থেকে সাবধান। সান্তাহারের আগে আর কোথাও স্টপেজ নেই।
জানতাম না সেদিন অতবড় একটা ক্ষতি হয়ে যাবে!
এতক্ষণ চুপ করে পুরনো ক্যালেন্ডারের নীচে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল টিকটিকিটা।লেজকাটা উদাস। সে দ্রুত বেরিয়ে এল। কেউ একজন এসেছে বাইরে। মাথা তুলে বিস্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে থাকল দরজার বাইরে।
এই মুহুর্তে বাইরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জগদীশ। সে শব্দ না করে খুব সাবধানে হাতের তালুতে লেগে থাকা খয়েরি রক্তের দাগ তুলবার চেষ্টা করছে।
পড়ুন, এই ধারাবাহিক উপন্যাসের আগের পর্ব।
0 Comments