হৃদয়ে দেশভাগ

সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী on

(পর্ব ১)

দেশটায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে বারবার। আর সেই পালাবদলের সাথে সাথে বারবার নানাভাবে চাগিয়ে ওঠে সহায়সম্বলহীন ছিন্নমূল উদ্বাস্তু পরিবারগুলির উদ্বেগ আর অসহায়তার দিনলিপি। একটি সিলমোহর চাই, সরকারি সিলমোহর। নয়তো আবার অনিশ্চিত অনির্দিষ্ট হয়ে যেতে পারে দু’মুঠো খুদকুঁড়োর সংস্থান। রাজনৈতিক তৎপরতার ফলশ্রুতিতে, দুর্বিষহ উদ্বেগ নিয়ে আর মনের ভেতরকার ঝড় সামলে, গোপাল আর গোবিন্দ এনআরসি অফিসের সামনের অস্থায়ী ক্যাম্পে লাইন দিয়ে বসে আছে আগের রাত থেকে। সঙ্গে নব্বই কবেই পার করা, একশোর কাছাকাছি বয়সী অশক্ত বৃদ্ধা দিদিমা ইন্দুবালা সূত্রধর। স্বর্গীয় মদনমোহন সূত্রধর ওরফে মনা মিস্তিরির বিধবা। আগেরবারের এনআরসি তালিকায় নাম এই পরিবারের ছিলো কি ছিলো না, এই নিয়ে ভারী বিতর্ক। এই অসহায় উদ্বেগ ছাড়া কোনো সহযোগিতা পায় নি এই পরিবার এখনো তেমনভাবে, না সরকারি, না রাজনৈতিক। ইন্দুবালার স্বামী বা মেয়েরা ও জামাইরা কেউ আর ইহজগতে নেই। থাকার মধ্যে বৃদ্ধার এই দুই নাতি ভিন্ন আর কেউ নেই সাতকুলে। আজ এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা বের হবে শুরু থেকেই তো বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এনআরসি৷ শুধু রাজনীতি নয়, পাড়ার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বাড়ির অন্দরমহল, সবজায়গায় আলোচনার বিষয়বস্ত।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে সীমান্ত জুড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। গোটা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত জুড়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে, চলছে কঠোর নজরদারিতে জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ বা এনআরসি। উঠে আসছে বিতর্কের ঝড়। ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স অর্থাৎ এনাআরসি মানে দেশের বৈধ নাগরিকদের তালিকা৷ এই জাতীয় নাগরিকদের নথিভুক্তকরণের ইতিহাস

অনেক লম্বা। শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ১৯জুলাই থেকে৷ কিন্তু ঘরছাড়া, ভিটেমাটিছাড়া ছিন্নমূল উদ্বাস্তু পরিবারগুলির অনেকেই তো এই যে নাগরিক পঞ্জীকরণের প্রয়োজনীয়তা বোঝে নি অতশত তত গভীরভাবে, যত গভীর ভাবে অনুভব করেছিলো ক্ষিদের তাড়না, মাথার উপর একখণ্ড আচ্ছাদনের তাড়না, লজ্জা নিবারণের তাড়না। কাজেই আরো অগণিত হতভাগ্য পরিবারের মতোই হওয়া হয়ে ওঠে নি হয়তো এনআরসি তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্তিকরণ, মনা ওরফে মদনমোহন সূত্রধরের পরিবারেরও হয়ে ওঠে নি ভারতের পঞ্জীকৃত নাগরিক হয়ে ওঠা। শুধু যে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জুটে গেছে মনার পরিবারের মুখে এই না কত!

খসড়া তালিকায় বাদ পড়াদের গ্রাস করেছে আতঙ্ক। এনআরসি-ছুটদের মধ্যেকার বড়সড় যে অংশ চূড়ান্ত উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে, মনা মিস্তিরির পরিবারের অবশিষ্ট তিনটি প্রাণীও তাদের দলেই। বৃদ্ধা ইন্দুবালার কাছে আগেরবার খসড়া তালিকা তৈরীর সময় তরুণ সরকারি কর্মীবাবুটি জানতে চেয়েছিলো, “এদেশে কতকাল?” বৃদ্ধার মুখের রেখায় রেখায় নড়নচড়ন। ঘোলাটে দৃষ্টি মেলা অনির্দিষ্টের দিকে। কোটরাগত চোখের কোলে ঝুলে আছে দু’ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। পরনের শতচ্ছিন্ন কাপড়ের আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে কাঁপা কাঁপা গলায় বৃদ্ধা ইন্দুবালা বলেছে গোপাল গোবিন্দর দিকে শীর্ণ অঙ্গুলি নির্দেশ করে, “হেয়া তো কইতে পারুম না বাপ। তয় ইয়াগোর মায় তহনে আমার প্যাটে আসিলো, তহনই আইয়া পড়লাম দ্যাশ ছাইড়্যা… হেই কুনকালে!” হতদরিদ্রা বৃদ্ধার মুখের বলিরেখায় যেন লেখা হয়ে রয়েছে সেই করুণ ইতিহাস। তিরতির করে কাঁপছে বৃদ্ধা, বহুদূর থেকে ভেসে আসছে বৃদ্ধার কম্পিত গলার স্বর। তরুণ সরকারি কর্মীবাবুটিও যেন হারিয়ে গেছে ইন্দুবালার সুদূর অতীতের জীবন খাতার পাতায় পাতায়।


“মনা, অ মনা, আরে ওই ছ্যা‍মড়া, হুনোস না কি কই? তর কি আক্কল পসন্দ কুনোকালে অইবো না রে? এমুন ক্যা রে তুই? দ্যাখ গা, হগ্গলতে কেমুন কাম-কাজ কইরা চলতে আসে, আর হক্কাল থন তুই কুন কামডায় লাগস্, ক তো দেহি?”

বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে পিসিকে এতক্ষণ বলতে দিলো মনা….. মানে মদনমোহন। এবার মুখ খুললো মনা, “পিসি, এইডা তুমি কি কইল্যা কও দেহি? ক্যারা কইসে তুমারে, আমি কাম-কাজ কিস্যু করি না? হক্কাল থন গোলা পিডান, নৌকা বাইচ, মাছ ধরন্, গুড়ি উড়ান্, ঘুড়ায় সড়া…. ইগলি বুঝি কুনো কাম না?”

পিসি অপলক চেয়ে থাকে মনার সুঠাম দেহের দিকে, মনার বাবড়ি চুলের দিকে, মনার পেটানো ছাতি আর গুলি বার করা বাহুর দিকে। পিসির চোখ দিয়ে স্নেহরূপী স্নেহ গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা হয়ে। মনাকে মনার নিঃসন্তান বিধবা পিসিই মানুষ করেছে। সেই যখন মনার মা আঁতুড়ঘরেই সূতিকাজ্বরে, তার নাড়ীছেঁড়া ধন মনার মায়ার বাঁধনেও সংসার আঁকড়ে থাকতে না পেরে ইহসংসার ছাড়লো, তখন থেকেই। মনার দেবকী মা জন্ম দিয়ে ক’দিনের মাথাতেই তো তার মদনমোহন গোপালকে পিসির রূপে যশোদা মায়ের হাতে সঁপে দিয়ে সব মায়া কাটালো। মনার জন্মের মাস চারেক আগেই মনার বাবা নিজের ভরা সংসার রেখেই সংসারের মায়া কাটিয়েছিলো। হয়তো নিয়তির নির্ধারিতই হবে। নাহলে যে মানুষ পনেরো ষোলো বছর বয়স থেকেই নিজের হাতে তৈরী করা নৌকা নিজেই ধলেশ্বরীর বুকে ভাসিয়ে আসছে নির্বিঘ্নে, সেই কিনা নৌকা ভাসাতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে ধলেশ্বরীতেই তলিয়ে যায়? পিসির বুক চিরে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

মনার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী যখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখনই ঘটেছিলো এই দুর্ঘটনা। মনার মা দ্বিতীয় সন্তান মনার জন্মের আগেই বিধবা হোলো। মনার বাবার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ঘরের চারটি ছেলে আর দুটি মেয়ে। তারা তাদের ছোটমাকে ফেললো না। নিজেরা মাতৃহারা হয়েছিলো যখন, তখনই বিয়ে হয়ে ছয় ছেলেমেয়ের মা হয়ে চোদ্দো বছর বয়সে মনার মা….. মানে ছোটমা এসেছিলো এ সংসারে। সকলকে বুকে করে আগলে রেখেছিলো। কখনো বুঝতে দেয় নি তাদের মায়ের অভাব। তারপর অনেক বছর পেরিয়ে মেয়েদের বিয়ে হয়েছে, ছেলেরাও বাবার সঙ্গে নৌকা তৈরীর ব্যবসা এবং তাদের জাতব্যবসা কাঠের কাজে যোগ দিয়েছে। সবাই ধরেই নিয়েছে ছোটমা বাঁজা বুঝি, নাহলে বয়স ঢলতে বসেছে এখনো ছেলেপুলে হোলো না! প্রায় বছর বত্রিশ বয়সে মনার মা প্রথমবার সন্তানসম্ভবা হোলো। জন্ম দিলো একটি ছেলের। তারপর বছর না ঘুরতেই আবার দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ করলো মনার মা। তবে বিধিলিপি কে আর কবে খণ্ডাতে পারে? মনার মা স্বামীকে হারালো দেড় বছরের ছেলে কোলে আর পাঁচ মাসের ভ্রূণ মনাকে পেটে নিয়ে। স্বামী মারা যাবার কারণে জন্মের আগেই মনার মায়ের দ্বিতীয় সন্তান মনার কপালে অপয়া অলক্ষুনের সিলমোহর ছেপে বসে গেলো।

(পর্ব ২)

বাবা-মা বলতে মনার মনে পিসির মুখে মুখে শোনা কথায় আঁকা অস্পষ্ট এক ছায়ামাত্র। আর মনা পায় মায়ের হাতের ছোঁয়া মায়ের নিপুণ হাতে সেলাই করা নকশি কাঁথাগুলির ওমের মধ্যে। এছাড়া মনাকে ভীষণ ভালোবাসে ওর বৈমাত্রেয় বড়দাদা। তবে মনা বড়দাদাকে ডাকে ভাই বলে, কারণ বড়দাদা কনিষ্ঠ বাকী চার ভাইকে নাম ধরে ডাকলেও মনাকে ডাকে ভাই বলেই, মনাও পাল্টা ভাই বলেই ডাকে। বড়দাদা মনাকে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে অনেক বোঝায়, “অহন তো কাম-কাজ করনের দরকার, অহনে তো তুমি ডাঙ্গর অইসো ভাই।” খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে মনা উত্তর দেয়, “ভাই, আমি কইলে নৌকা বানানের কামই করুম হুদা, আর বাইচ খেলনের সুমে কইলে তুমি আমারে আটকাইতে পার্বা না।” বড়দাদা ভূপেন মেনেই নিলো মনার আব্দার, উদ্দেশ্য একটাই…. মনা কাজে তো চলুক আগে!

পরদিন সকালে দুধের সর জ্বাল দেওয়া ঘি দিয়ে গরম সিদ্ধভাত খেয়ে শুরু হোলো মনার কর্মজীবন। ভূপেন, উপেন, যোগেন, নগেন আর নারান – এর সঙ্গী হোলো মনাও। কারখানায় মন টিকছে না মনার, তবু ভাইকে দেওয়া কথা রাখতে মনা দাদাদের কাছে চিনছে করাত, হাতুড়ি, বাটালি, রাঁন্দা, ক্যারামপিস (ক্র্যাম্প পিস), আরও নানান যন্ত্রপাতি। একবার এ কর্মচারী তো পরক্ষণেই অন্য কর্মচারীর পাশে বসে ঝুঁকে পড়ে তাদের কাজের আগাপাশতলা বোঝার চেষ্টা করছে। আবার কখনো বড়দাদার পাশটিতে বসে দেখছে ইঞ্চি ফুট গজের হিসেব করা স্লেটে আঁক কষে কষে। অবাক বিস্ময়ে দেখছে বড়দাদার গদি সামলানো, খদ্দেরদের সাথে আদান-প্রদান, মহাজনের সাথে আলাপ আলোচনা। তবে মনার মন কিন্তু ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার বাঁকে বাঁকে।

মাসকয়েক পার হতেই মনা এবার ভালোবাসতে শুরু করেছে কাজটাকে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, “মনা দ্যাশের (দেশের) হগ্গলের থন (সবচেয়ে) বড় নৌকাডা বানাইছে, ঠিক ভাইয়ের মুখে শোনা ইস্টিমারডার (স্টিমারটার) লাহান (মতোই) বড়ো দীঘল নৌকা।” একদিন মনা বসে বসে দেখতে দেখতে মাইঝ্যা (মেজো) দাদার কাজের অবশিষ্টাংশ বেশ নিঁখুতভাবেই শেষ করে ফেললো। পরের দিন সাইঝ্যা (সেজো) দাদার অর্ধেক করে রাখা নকশা সুন্দর করে শেষ করে রাখলো, দাদার দুফোইরা খাওনের সুমে (দুপুরের খাবার সময়)। এভাবেই মনার হাতেখড়ি, না না, হাতেবাটালি হয়ে গেলো। অনেক চেষ্টা করেও মনার ভাই মনাকে পাঠশালায় পাঠাতে পারে নি। তবে নিরক্ষর মনা কিন্তু খড়িপেন্সিল বা কাঠপেন্সিল দিয়ে কাঠের তক্তার ওপর ভারী সুন্দর ফুল লতাপাতা, সিংহের মুখ-থাবা, পেখমধরা ময়ূর, বাসুকির ফণা… দিব্যি ফুটিয়ে তুলতে পারে। তারপর সেই নকশার দাগে দাগে বাটালি দিয়ে খোদাই করে জীবন্ত করে তুলতে পারে তার আঁকা নকশাদের। আসলে জাত শিল্পী, রক্তে কাঠের কারুশিল্প। ধীরে ধীরে মনার মন বসে গেছে চারচালা টিনের পৈতৃক কারখানা ঘরের কোণে। তবে মাঝেমধ্যে কোথাও নৌকাবাইচের খবর পেলেই হোলো, মনা সেখানে হাজির, নিজের নৌকা আর শাগরেদ খুইশা, ন্যাপলা আর রমজান আলিকে নিয়ে। মনা বোধহয় নৌকাবাইচ খেলায় হারতে শেখে নি, মেডেলে মেডেলে তার ভাইয়ের (বড়দাদার) ঘরের মেহগনি কাঠের আলমারির একটা তাক ভর্তি হয়ে উঠেছে।

দিন চলছে মসৃণ গতিতে। মনার বয়স উনিশ পেরিয়ে কুড়ি। মনার বিয়ের ঠিক হয়েছে, বুড়িগঙ্গার পাড়ের মেয়ে এগারো বছরের ইন্দুবালার সঙ্গে। শুভ দিনে বিয়েও হয়ে গেলো। তারপর ইন্দু তার বাপের বাড়িতে। আর মনা ডুবছে কাজের নেশায়। মনার হাতের কাজের, মনার বানানো বাইচের নৌকার ভারী নামডাক হয়েছে। সাভারের, এমনকি ঢাকা শহরের কিছু লোকজনের কানেও পৌঁছেছে নৌকা বানানোয় মনার সুন্দর কারিগরির নাম। মনার কাজের মতির ও সাফল্যের দাবিদার কিন্তু অন্য একজন হোলো। সে মনার বৌ ইন্দু। তিনটি বছর পার, এবার ইন্দুর দ্বিরাগমন হোলো পতিগৃহে। তেইশ বছরের মনার সংসারের কর্ত্রী হয়ে এলো চোদ্দো বছরের ইন্দুবালা। লক্ষ্মীমন্ত ইন্দু সংসারের সব কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভারী সুন্দর করে চমৎকার সব সেলাই করে। ঘোমটা টানা ইন্দু একদিন মনাকে একখণ্ড সাদা কাপড়ে রঙীন সুতোয় ফুলতোলা একটা রুমাল দিলো সকাল সকাল কাজে যাবার সময়। মনার বুকের রক্তটা ছলাৎ করে উঠলো, ঠিক যেমনটি হয় বাইচ খেলার শেষে দু’হাতে বৈঠা মাথার উপর তুলে “চিকুইর পাড়নের সুমে”(চিৎকার করার সময়)!

সম্পন্ন আর্থিক পারিবারিক পরিকাকাঠামোয় মনার সুমসৃণ জীবন যাপন। নৌকায়, কারখানায়, ঘোড়ায়, পূজাপাঠে, খোল -কর্ত্তাল – হরিধ্বনিতে, গাছের ফলফলাদিতে, বারো মাসের তেরো পার্বণে, দাদাদের শাসনে-আদরে, ভাপা ইলিশে, চিতলের মুইঠ্যায়, খেঁজুরের রস জ্বাল দেবার গন্ধে, পিঠে পুলি নাড়ু মোয়া মিষ্টান্নে আর ইন্দুর অকুন্ঠ নীরব ভালোবাসার সাথে। তরতর করে পার হয়েছে আরো বছর তিন-চার। এরপর খুশির জোয়ার শতেক গুণ করে মনা ইন্দুর প্রথম কন্যাসন্তান রমলা এলো, তার বছর ছয়েক পরে কমলা এলো ঘর আলো করে। তারপর বছর ঘোরার অপেক্ষা, এলো বিমলা। মনা মেয়েদের নিয়ে ভারী খুশী। সংসারে সুখ শান্তি উপচে পড়ছে, কোথাও কোনো কমতি নেই। মনার হাতে তৈরী নৌকার কদরে কারখানা ঘর বাড়তি আরেকখানা করতে হয়েছে।

(পর্ব ৩)

কিছুদিন যাবৎ কানে আসছে নানান উড়ো খবর, দেশটা নাকি ভাগ হয়ে যাবে। চিটাগঙ্গ, নোয়াখালী আরও কোথাও কোথাও নাকি নানানরকম দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছে। তবে কর্মব্যস্ত মনার পরিবারের কেউ তেমন কানে তুলছে না, কিন্তু খবরটা উড়ছে, কখনো নদীর ঘাটে, কখনো গঞ্জের হাটে আবার কখনোবা ঘরে আসা গৃহস্থের কুটুম্বদের মুখে মুখে। ইন্দুর জায়েরা, ইন্দু আর পিসিশাশুড়ি নিজেদের মধ্যেই চাপা আলোচনা করে। এতোরকম খবরে বাড়ীর পুরুষেরা আজকাল একটু গম্ভীর। তবু

কোনোই স্পষ্ট ধারণা নেই এই দেশভাগের সম্বন্ধে।

এরমধ্যেই মনার বৈমাত্রেয় দাদারা আর নিজের দাদাটিও পৈতৃক ব্যবসার নিজের নিজের অংশ বুঝে নিতে চায়। মনার কেবল কোনো বিষয়ে কোনো তাপ উত্তাপ নেই। উনিশশো সাতচল্লিশের গোড়ায় মনার বড়দাদা ভূপেনের বড়ো দুই ছেলে কোলকাতায় চলে গেলো পড়তে। চিঠি চাপাটির লেনদেন দু-একবার হতে না হতেই মাস দুই-তিনেকের আড়াআড়িতে মনার চার দাদাই নিজের নিজের পরিবার আর পৈতৃক ব্যবসার ভাগস্বরূপ মোটা টাকা বুঝে নিয়ে কোলকাতায় পাড়ি দিলো। “দ্যাশের” বাড়ীতে রয়ে গেলো মনা তার পরিবার নিয়ে, বড়দাদা ভূপেন আর তার স্ত্রী এবং কোলের যমজ ছেলেমেয়ে দু’টি। আর রইলো মনাদের বৃদ্ধা পিসি। অতবড়ো একান্নের সংসারটা কেমন ভেঙে খান খান হয়ে গেলো। সবাই মনমরা। মুখ শুকনো করে দৈনন্দিন কাজকর্মের গতানুগতিক ধারায় সবাই।

মনা ইন্দুর বড়ো মেয়ে রমলা দেখতে দেখতে আটে পা দিয়েছে, ভারী সুন্দর দেখতে, কিন্তু রমলা ভারী ভীতু চুপচাপ গোছের। ছ’বছরের ছোট বোন কমলা তো বটেই, এমনকি সাতবছরের ছোট বোন বিমলাও বড়দিদিকে মোটে মান্য করে না। রমলা মায়ের পায়ে পায়েই ঘোরে সর্বক্ষণ। রমলা বড়ো জ্যাঠামশাইয়ের বড্ড আদরের। কাজে কাজেই জ্যাঠামশাইয়ের আদরে সেও পাঠশালায় যেতে চাইলো না কিছুতেই। এই নিয়ে ইন্দুর মনে চাপা অসন্তোষও ছিলো। অগত্যা বড়ো মেয়েকে হাতের কাজ আর ঘরকন্নার কাজেই ইন্দু তালিম দিতে থাকলো। খুব সকালে ইন্দু পাগের ঘরে (রান্নাঘরে) ব্যস্ত, কাজে ভুল করার জন্য বড়ো মেয়েকে বকাবকি করছে। দু’বছরের মেজো মেয়ে আর একবছরের ছোটো মেয়ে বাবার কাজে যাবার আগে বাবার সাথেই বাবার পাতে বসে ঘিয়ে মেখে গরম গরম সিদ্ধভাত খাচ্ছে। বাড়ীর বাকীরাও যে যার নিত্যকর্মে ব্যস্ত। হন্তদন্ত হয়ে মনাদের বাড়ীতে ঢুকলো রমজান আলি।

বাড়ীর সকলের বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে রমজান আলি বলে চলেছে, “মনা রে, তরা অহনই পলা গিয়া, দ্যাশডা ভাগ অইয়া যাইতাসে। তরা হক্কালে কোইলকাতায় চোইল্যা যা আইজই, অহনই। ভাইজান দেরী কইরেন না। নুয়্যাখাইল্যারা দাঙ্গা কাটাকাটি কর্তে আসে। হুইন্যা আইলাম আমি, আপনেগোরে এইহ্যানে থাকপার দিবো না। হগ্গলতেই চোইল্যা যাইতে আসে। তরাতরি করেন ফুফু, ভাবীরা। আমি গ্যালাম অহনে। আপনেরা তৈয়ার অইয়া লন। আমি গুইরা আইত্যাসি।”

ঝড়ের বেগে রমজান আলি কথাগুলো বলেই চলে গেলো। আর সে ঝড়ের দাপটে মনাদের নিরিবিলি পরিপাটি সংসারের উপরে কয়েক মিনিটের মধ্যে নেমে এলো যেন এক করাল ছায়া, দেখা দিলো অশনি সংকেত।

কী হতে চলেছে তার কোনো সম্যক ধারণা কারুর নেই। তবে খুবই গুরুতর কিছু বিষয় যে, এ ব্যাপারে কারোরই কোনোই সন্দেহ নেই। বাকরূদ্ধ পরিবারের প্রাপ্তবয়স্করা আর শিশুগুলি ভীত সন্ত্রস্ত, কান্নাকাটি ভুলেছে। যা খাবার রান্না হয়ে গিয়েছিলো তাই দিয়েই ইন্দু বাড়ীর সকলকে খাইয়ে দিলো। তারপর গোছাতে বসলো ইন্দু, ইন্দুর বড়োজা আর ওদের পিসিশাশুড়ি। লুকিয়ে পালানো এখন আপাতত কিছুদিনের জন্য, সেরকমই ধারণা মনার বড়দাদা ভূপেনের। পরিস্থিতি অল্প দিনেই স্বাভাবিক হবে, তখন আবার ফিরে আসবে। যৎসামান্য সঙ্গে নিয়েই চলা হোক, ভূপেনের মতে। পরনের কিছু কাপড় চোপড়, গয়নাগাটি আর নগদ টাকাকড়ি শুধু নিলেই হবে। কোলকাতায় চার ভাই আগে থেকেই আছে তো, পৌঁছতে পারলে আর কোনো সমস্যাই হবে না। হয়তো কয়েকমাস, ফিরে আসবে তারপর সবাই নিজেদের দেশে আবার।

বড়ো বড়ো ক’টা বোঁচকা, ছোট ছোট ক’টা পোঁটলা আর বুড়ি পিসির পুঁটলিতে ঠাকুরের পট আর মনার মায়ের সোনা-রূপোর গোপাল (ঠাকুর কি অভুক্ত থাকবে?) নিয়ে রওনা হওয়ার জন্য তৈরী হয়েছে সপরিবারে মনা। উঁচু দালানকোঠা ঘরটা থেকে ইন্দু এখনো বেরোয় নি, দেখতে গেলো মনা, রমজান আলি এসে গেছে যে, ফুলবাইড়া (ফুলবাড়িয়া) গ্রাম ততক্ষণে ফাঁকা প্রায়। মনা ঘরে ঢুকে দেখে একটা কাপড়ে নিজের আর মেয়েদের সব গয়নাগাটি আঁটোসাঁটো করে জড়িয়ে ইন্দু নিজের পেটে বেঁধে পেটটা মোটা উঁচু করে ফেলেছে। ঠিক যেন গর্ভবতী। ম্লান হাসি হেসে ইন্দু জানালো যে তিনমাস চলছে, সত্যিই ইন্দু গর্ভবতী আবার, এখনো বলা হয়ে ওঠে নি স্বামীকে। বড়ো জা আর পিসি কেবল জানে।

মনার বড়দাদা ভূপেন গদিঘরের দেরাজ থেকে আর নিজের শোবার ঘরের মেহগনি কাঠের আলমারি থেকে সমস্ত নগদ টাকাকড়ি গুছিয়ে কাপড়ের তবিল থলিতে ভরে বেঁধে নিলো কোমরে, ধূতির তলায়। বৌ মেয়ের গয়নাগাটি সবটাই পরিয়ে দিলো তাদের গায়ে। এরপরে ভূপেন ডাক দিয়ে বললো, “মনা রে, যাত্রা করনের আগে, ন, ঠাকরাইনের দুয়ারে গইড় পাইড়্যা নই।” নীরবে মনা অনুসরণ করলো বড়দাদাকে। তার মায়ের ভারী সাধের আটচালা ঠাকুরঘরের সামনের বাঁধানো চাতাল করা উঠোনে দুইভাই গড়াগড়ি দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। দু’জনের মনের মধ্যেই ওঠা তোলপাড় করা ঝড়ের হদিশ হয়তো দু’জনেই দু’জনের নিশ্চুপ আত্মার অনুভবে পাচ্ছে।

চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মনারা চলেছে ধলেশ্বরীর নৌকা ঘাটের….. তাদের নিজস্ব ঘাটের পথে। সব রয়েছে পড়ে, খোলা ঘর-দুয়ার, গোয়াল ভরা গরু, আস্তাবলে ঘোড়া, ঘাটে বাঁধা নৌকার সার, ফলের আর নারকেল-সুপারির বাগান, মিঠা পানের বরজ, কারখানা ঘর, সংসার-গৃহস্থালির সর্বস্ব। মনার মায়ের সাধের আটচালা ঠাকুরদালান, মনার বাবার নিজের হাতে তৈরী গোপালের তিনতলা রথ….. সব রইলো পড়ে পিছনে, খোলামেলা, দোস্তোদের, আর রয়ে যাওয়া প্রতিবেশীদের ভরসায়, পরম বিশ্বস্ততার বন্ধনে। ঘর ছেড়ে বেরোবার সময় ছ্যামায় উষ্টা (চৌকাঠে হোঁচট) খেয়ে মনার মনটা ভারী কু-ডাক দিয়ে দিয়েছিলো। ফিরে ঘরে গিয়ে নিজের একটা ধূতিকাপড় ভাঁজ করে চার কোণায় গিঁট দিয়ে ঝোলা বানিয়ে কে জানে কী ভেবে তার মধ্যে কারখানা থেকে হাতুড়ি, বাটালি, রাঁন্দা আর দু-একটি কাজের যন্ত্রপাতি ভরে মনা নিজের কাঁধেই ঝুলিয়ে নিয়েছিলো। অস্থির মন, চোখ থেকে গরম ভাপ বেরোচ্ছে, কানে তালা।

আবাল্য খেলার সাথী রমজান আলি আর তার বৃদ্ধা আম্মি ফতিমা বেওয়া, আজন্মকালের প্রতিবেশী মনাদের, আত্মীয়ের ঊর্দ্ধে, মনার মায়ের আর পিসির ‘আসমানতারা সই’…… ওদের সঙ্গে সঙ্গে পথ হাঁটছে। বৃদ্ধার হাতে দু’খানা বোরখা আর একটা বড়সড় পোঁটলা। ইন্দুর আর ইন্দুর বড়োজায়ের হাতে বোরখা দুটো ধরিয়ে বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা বিকৃত স্বরে কোনোরকমে বললো, “অ বো, পিন্ধা নও অহনে, গোয়ালন্দ যাইয়্যা খুইল্যা থুইও।” বৃদ্ধা খালাম্মার মনে কষ্ট দিতে চাইলো না ইন্দু বোরখা ফিরিয়ে দিয়ে, “আইস্সা”, বলে মলিন হাসিতে বোরখাদুটি নিয়ে রমলার কাঁধের ছোট পোঁটলাটায় গুঁজে রাখলো আপাতত। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে বৃদ্ধা ফতিমা খালাম্মা আবার বললো, “মনা রে, এই বোস্কাডা কান্ধে ফালাইয়া থো রে, কয়ডা নাড়ু মোয়া আর সিড়া হুড়ুম গুড় দিসি, খিদা ধরলে অরা…. অই পোলাপাইনেরা খাইবো অনে।” মনার দু’গাল বেয়ে পদ্মা-মেঘনা। কিছু বলতে পারলো না মনা, শুধু জড়িয়ে ধরলো খালাম্মাকে। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতেই বৃদ্ধা বললো, “কান্দস ক্যা, বেবাক্তেই আইয়া পড়বো নে, তরাও ফিইরা আইয়া পইড়স বেবাক্তের লগে।” মনা তো ভাষা হারিয়ে বসে আছে, মসৃণ নিস্তরঙ্গ জীবনের এই হঠাৎ ছন্দপতন, আসন্ন ঝঞ্ঝার অনুচ্চারিত আগমন মানতে পারছে না। মনার বড়দাদা ফতিমা বেওয়ার হাতদুটো ধরে বললো, “খালাম্মা, হগ্গলডি রইসে পইড়্যা আপনেগো জিম্মায়, দেইখ্যা হুইন্যা থুইয়েন। কী আর কমু জানা নাই, খালাম্মা।”

(পর্ব ৪)

নৌকায় উঠে বসেছে মনা সপরিবারে, আজ আর মনা নিজের হাতে বৈঠা নিতে পারে নি। মনার মন খালি বলছে যেন সব হারিয়ে যাচ্ছে তার জীবন থেকে। রমজান আলির লগির ঠ্যালায় দুলে উঠলো নৌকা, বৈঠায় টান মারতেই কোথা থেকে দৌড়তে দৌড়তে ন্যাপলাও এসে চড়ে বসলো নৌকায়, ঘোষণা করলো, “আইজ খুইশারাও গেসে গা, ভুরব্যালা।” পাটাতনে সবাই বসেছে, সবারই নির্বাক মুখ ফেরানো পাড়ের দিকে। মনা রমজান আলির কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে তখনো, হালে আজ ন্যাপলা। ধীরে ধীরে মনার চোখে ঝাপসা হয়ে আসছে সবুজে সবুজ ফুলবাইড়া….. নান্নার, তার প্রিয় মানিকগঞ্জ। ওদের গন্তব্য নারায়ণগঞ্জ। ওখান থেকে গোয়ালন্দগামী স্টিমারে চড়ে গোয়ালন্দ, তারপর রেলের গাড়ী চড়ে কোলকাতা, এক অচেনা অজানা দেশের অপরিচিত গন্তব্যভূমিতে হয়তোবা অনিশ্চিত অনির্দিষ্টেরই এ যাত্রা।

নৌকা এগোচ্ছে, নারায়ণগঞ্জের স্টিমার ঘাটের দিকে। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ফুলবাইড়া…

নান্নার। একটি গাঢ় সবুজ রেখা শুধু দিগন্তে যেখানে আকাশ মিশেছে ধলেশ্বরীর পাড়ে, তার বিভাজিকা হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো ফুলবাইড়া…. নান্নার…. দূরের মানিকগঞ্জ হোলো অদৃশ্য দৃষ্টিপথ থেকে।

মনার চোখের কোল বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়াচ্ছে তখনও। ইন্দুর মুখ ঘোমটায় ঢাকা, তার চোখ-মুখের ভাব দেখা গেলো না। ইন্দুর বড়ো জা দুই হাতে মাথা ধরে অদ্ভুত নির্লিপ্ত অসহায় এক ভঙ্গীতে বসে আছে। মনার যে পিসি কথায় কথায় ডাক ছেড়ে বিলাপ করে, সে পিসিও হতভম্ব চুপ, কোটরাগত চোখের কোলে টলটলে দু’ফোঁটা জল ঝরে পড়ার অপেক্ষায়, যেন বুঝে উঠতে পারছে না কী ঘটছে! মনার তিন মেয়ে রমলা, কমলা, বিমলা আর মনার বড়দাদার ছোটছেলে মানিক আর মেয়ে মায়াও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে নীরবে বসে আছে। শিশুগুলির কোনো আন্দাজ নেই ঠিক ঘটে চলেছে।

মনার বড়দাদা এবার মনার উদ্দেশ্যে বললো, “ওই মনা, এম্নে কান্দস ক্যা? কয়দিন অইলেই তো ফিরা আইয়া পড়ুম অনে? দুঃখু পাইস না। আমু আমরা ফিরা আমোগো দ্যাশেই, দেইখস্। মুইস্যা ফালা চক্ষু, পোলাপাইনেরা ডরাইবো না? তরে এম্নে কাইনতে দ্যাখলে? ন, চক্ষু মুস্!” নিজের কাঁধে ফেলে রাখা গামছাটা এগিয়ে দেয় মনার বড়দাদা। এতক্ষণ নীরব ছিলো অশ্রু বিসর্জন, এবার মনা আর পারলো না, বড়দাদাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আর এতক্ষণ পাষাণ সেজে থাকা বড়দাদার চোখের জলও মনার বাবড়ি ঝাঁকড়া চুল ভেদ করে মনার কাঁধে ঝরে পড়তে লাগলো। যে যতই মুখে একজন আরেকজনকে স্বান্তনা দিক, মনে মনে সবাই সন্ত্রস্ত, নিজস্ব ভবিষ্যৎ আশঙ্কায়। একদিনের একবেলার মধ্যেই যে সব ওলটপালট, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার সময়টুকু পর্যন্ত পায় নি কেউ।

শ্রাবণের ভরা বর্ষার ধলেশ্বরীতে রমজান আলি আর ন্যাপলা সাবধানে দাঁড়-বৈঠা টানছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে নদীর স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে। ছইয়ের তলায় ক্ষুধা তৃষ্ণা বিষাদে অবসন্ন শিশুগুলি ঝিমোচ্ছে। ইন্দু, ইন্দুর বড়ো জা আর পিসির মুখ দেখে তাদের মনের মধ্যেকার ঝড়ের গতি বোঝার উপায় নেই। মনা দুই হাঁটুতে মুখের থুতনি রেখে একদৃষ্টে ধলেশ্বরী নদীর রৌদ্রোজ্জ্বল সোনাঢালা জলের দিকে চেয়ে। মাঝে মাঝেই মেঘের আড়ালে পাল্টে যাচ্ছে ধলেশ্বরীর রূপ। বড়দাদা রমজান আলির পিছনে বসা।

ঐ বুঝি দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের স্টিমার ঘাট, ঐ দূরে ধূ ধূ, কালো কালো রেখার মতো দেখা যায় বুঝি। ধলেশ্বরীর বুক বেয়ে মনাদের নৌকা এগোচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ঘাটের দিকে।

নারায়ণগঞ্জ ঘাটে পৌঁছে মনারা শুনলো আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চাঁদপুরের দিক থেকে আসছে গোয়ালন্দগামী সেদিনের শেষ স্টিমার। নিজেদের নৌকা রইলো নোঙ্গর করা। মনা আর তার পরিবারের সবাই, বড়দাদার পরিবারের সকলে পিসিকে নিয়ে স্টিমার ঘাটের একধারে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজেদের সব পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে। আবাল্যের গল্পে শোনা মনার স্বপ্নের স্টিমার নিয়ে আজ আর মনার মনের মধ্যে কণামাত্র উচ্ছ্বাসও অবশিষ্ট নেই। রমজান আলি আর ন্যাপলা গেছে টিকেটের সন্ধানে। নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে ওরা দেখলো ওদের মতোই কাতারে কাতারে পরিবার পোঁটলা পুঁটলি বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে চলেছে এক অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে, কেউই জানে না, এরপর কী হবে? দিশাহারা ছলছলে জলে ভরা লালচে চোখে আর ধরা ধরা গলায় সমব্যাথায় কাতর মানুষগুলি অসহায়ের মতো হতাশাভরা গলায় এর ওর সাথে কথা বলে বুঝতে চাইছে যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন অনির্দিষ্ট অদূর ভবিষ্যৎকে।

স্টিমার এসে ভিড়েছে ঘাটে, লোকজনের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। বেশী সময় হাতে নেই, স্টিমার ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। ঠেলাঠেলি হুড়োহুড়ি করে লোকজন লোকারণ্য স্টিমারে উঠছে। মনাও কোনোরকমে ঠেলাঠেলি করে ইন্দু আর মেয়েদের তুলে দিয়ে নিজেও উঠেছে। বড়দাদা আর ন্যাপলা ধরাধরি করে পিসিকে তুলেছে। এবার বড়দাদার পরিবারের স্টিমারে ওঠার মুখে বড়দাদার ছেলে ভিড়ের চাপে উল্টে পড়ে গিয়ে হাত পা কেটে ছড়ে গেলো, সামনের দাঁত ভেঙে ঠোঁট কেটে অঝোরে রক্ত পড়ছে। মনা চেষ্টা করেও নামতে পারছে না। ভিড়ের চাপে ঠেলা খেয়ে স্টিমারের আরো ভিতরের দিকে ঢুকে গেলো। মনার কাঁধে বসানো কমলা – বিমলা ছোট্ট ছোট্ট মুঠিতে বাবার চুল খামচে ধরে আতঙ্কে তারস্বরে চিৎকার করছে। ভিড়ে যাতে আলাদা না হয়ে যায়, তাই ইন্দু বুদ্ধি করে রমলার আর পিসির আঁচল নিজের কাপড়ের আঁচলের সাথে শক্ত করে গিঁট দিয়ে বেঁধে নিয়েছে। টাল সামলাতে না পেরে বুড়ি পিসি রমলাকে বুকে জড়িয়ে ইন্দুর পায়ের কাছে ডেকের পাটাতনের উপর উবু হয়ে বসে পড়েছে। পোঁটলা পুঁটলিগুলি কতক ইন্দুর কাঁখে কাঁধে, কতক পিসির আর রমলার কোলে। ইন্দুর মাথার উস্কো চুল উড়ছে বাতাসে, জবাফুলের মতো লাল দু’টি চোখ, দাঁত চেপা শক্ত চোয়াল, ইন্দুর মাথা থেকে ঘোমটা খসে পড়েছে কখন! কালো কালো মাথার ভিড় টপকে ইন্দুর নজর চলছে না পাড়ের দিকে। এইসময় ইন্দুর মনে এলো ক’বছর আগে বাপেরবাড়ি গিয়ে বেতারে শোনা নেতাজীর ভাষণ। ইন্দুর টকটকে লাল শুকনো চোখদুটো হুহু করে জ্বলছে, যেন লঙ্কাবাটা ডলে দিয়েছে কেউ।

বড়দাদা ছেলেকে সামলে তার পরিবার নিয়ে কিছুতেই উঠতে পারছে না স্টিমারে। ভিড়ের চাপে এগোতেই পারছে না স্টিমারে ওঠার সিঁড়ি পর্যন্ত। রমজান আলি আর ন্যাপলা আপ্রাণ চেষ্টা করছে কোনোক্রমে ভিড় ঠেলে সরিয়ে নিরাপদে ওদের এগোনোর পথ করে দিতে। কিন্তু ওরা বিফল হোলো, এই স্টিমারে আর যাত্রী তোলা হবে না, যাত্রী বেশী হয়ে গেছে। স্টিমারের সিঁড়ি সরিয়ে রেলিঙ টেনে দেওয়া হোলো। মনার আর মনার বড়দাদার কাতর অনুনয় কেউ শুনলো না, আবেদন পৌঁছলো না কারোর কানে। ভিড়ের মধ্যে চিৎকারে কেউ কারোর কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছে না, শুনতে পাচ্ছে না কেউ কিচ্ছু স্পষ্ট করে। শুধু কোলাহল আর কোলাহল! তারই মাঝে এক হৃদয়বিদারী জোরালো ভোঁ দিয়ে স্টিমার দুলে উঠলো। পাক খেয়ে উঠলো সকলের ভাঙাচোরা রক্তক্ষরিত মনের মধ্যে সেই “ভোঁ-ওওওওওওওও…..”

চারিদিকের কান্নাকাটি কোলাহল ছাপিয়ে আরেক হৃদয়বিদারক চিৎকার “ভাই-ই-ই-ই”…. মনার গলা স্টিমারের ডেক পাটাতন ইঞ্জিন চুঙিতে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার মনার কাছেই ফিরে এলো, নাকি ঘাটে বিচলিত হয়ে দাঁড়ানো বড়দাদার গলার ডাক এসে মনার কানে পৌঁছলো, তা মনা বুঝলো না। মনা শুধু শুনতে পেলো সেই ডাক….. হৃদয়বিদারক আকুল ডাক, “ভাই-ই-ই-ই”! সে ডাক যেন বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা ছুঁয়ে উড়ে মিলিয়ে গেলো মানিকগঞ্জ, নান্নার, ফুলবাইড়ার মাটির দিকে, গায়ে মনার বুক ভাসানো নোনা জলের বাতাস মেখে, উদাসী হয়ে।

হেলেদুলে ঢেউয়ের তালে স্টিমার এগোচ্ছে রাক্ষসী পদ্মার বিপুল জলরাশিতে, মনাকে নিয়ে অনির্দেশের পথ পাড়িতে। মাথার উপর দূর আকাশে বাসায় ফিরতি পথে উড়াল দেওয়া গাঙচিলেরা, আর পিছনে চলে যাচ্ছে ধীরগতিতে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটার মাটি, নদীতে নদীতে ঘিরে থাকা মনার জন্মভূমির মাটি, মনার পিতৃ-পিতামহের ভিটার মাটি, মায়ের হাতের তৈরী নকশি কাঁথার মতো বিছিয়ে থাকা ‘শস্য শ্যামলা সুজলা সুফলা’ মনার দেশের মাটি। মনা ইন্দু চলেছে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে।


“দিদমা, ও দিদমা, দিদমাআআআ গ, কিস্যু কওনা কেইর লিইগ্যা?” কঁকিয়ে উঠলো গোপাল গোবিন্দ দুই ভাই। মাথাভরা রুখু চুল আরও রুখু, চোখে রাত্রি জাগরণের রক্তিমাভা ছাপিয়ে টকটকে লাল চোখ সত্যিই রক্ত ঝরাবে বোধহয় এবার। আবারো বৃদ্ধা ইন্দুবালার গায়ে ধাক্কা দিয়ে পাষাণভাঙা চিৎকারে চারিদিক সচকিত করে তুললো গোপাল গোবিন্দ, “দিইইদমাআআ…”! আগের রাত থেকে না খাওয়া, না দাওয়া, না ঘুম। মাঝে একবার দু’ঢোঁক জল শুধু। নব্বই পার হওয়া বৃদ্ধা, নিজের বয়সের হিসেব নিজের কাছেই তার ছিলো না। ছিলো শুধু একবুক বেদনা, দেশভাগের বেদনা, দেশ ছাড়ার অব্যক্ত যন্ত্রণা। প্রায় একশো ছুঁই ছুঁই বয়স বৃদ্ধা ইন্দুবালার, লোকের তাই অনুমান। সব হারিয়ে ফেলেছে, ঘর সংসার, স্বামীর পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি, এমনকি দেশের নাগরিকত্বটুকুও। স্বামীর হাত ধরে, সন্তানদের বুকে করে নিয়ে তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো এসে আশ্রয় নিয়েছে পরভূমে। দেশভাগের ফসল। একটা দেশ তখন তিন টুকরো। যে টুকরোয় ইন্দুবালার জন্ম কর্ম সংসার ধর্ম ছিলো, তা রাতারাতি পরের হলো। আর নিজের ভূমি ছেড়ে এসে আশ্রয় নিলো দেশের যে টুকরোয়, তাতো ইন্দুবালার পরভূম হয়েই রইলো আমৃত্যু।

গোপাল গোবিন্দ দিদিমার মৃতদেহের পাশে দিশেহারা দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে। জানে না কী করণীয়। জ্ঞান হওয়া ইস্তক দিদিমাই ওদের সব। কবেই যে ওদের সব আপনজনেরা ইহলোকের মায়া কাটিয়েছে। কেউ অনাহারে, তো কেউ রোগে ভুগে, বিনা চিকিৎসায়। কেবলমাত্র রয়ে গিয়েছিলো দুই অনাথ নাতি গোপাল গোবিন্দকে বুকে আঁকড়ে বৃদ্ধা ইন্দুবালা। আজ সেও চলে গেলো ওদের মায়া কাটিয়ে। নাকি ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে, অপমানে? এর উত্তর গোপাল গোবিন্দর কাছে হয়তো নেই, তবে যে দেশের টুকরোটায় আশ্রয়প্রার্থী ছিলো সপরিবারে ইন্দুবালা, সেই দেশ ও তার জনগণের কাছে আছে কি? সম্পন্ন গৃহবধূ কেন বাধ্য হয়েছিলো আক্ষরিক অর্থেই হতে পথের ভিখারিনী? কে দেবে সেই উত্তর? সাত-সাতটি দশক যে দেশের ধূলোমাটি গায়ে মেখে এক ছিন্নমূল উদ্বাস্তু বৃদ্ধা রমণী ভিক্ষাবৃত্তি করে দিনাতিপাত করেছে, কখনো দু’মুঠো ভাতের বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করেছে, ন্যূনতম সরকারি সাহায্যের আশ্বাসটুকু পর্যন্ত না পেয়েও, সেই দেশটাকেই নিজের নিরাপদ আশ্রয় ভাবতে চেয়েছে… সেই দেশ কি ইন্দুবালাকে সেই মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পেরেছে? শুধু কয়েক টুকরো কাগজের ওপরে কয়েকখানা সিলমোহর ছিলো না ইন্দুবালার পরিবারের হাতে, কিন্তু এই দেশটায় যে তারা ছিলো সেই ১৯৪৭ সাল থেকে, তার কোনো প্রমাণ ইন্দুবালারা দেখাতে পারে নি। তাই এই দেশটার মাটিতেও তাদের আর কোনো অধিকার জন্মায় নি। স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে ফুটপাতে ঘুরে ঘুরে ইন্দুবালার পায়ের তলার চামড়া ক্ষয় হয়েছে পেট ভরানোর তাগিদে, কিন্তু সহায় সম্বল না থাকায় নাম ওঠাতে পারে নি এনআরসি তালিকায়। শেষ নিঃশ্বাসও ছেড়ে গেলো আজ ইন্দুবালাকে।

সরকারি অফিসারবাবুটির তৎপরতায় ইন্দুবালার সৎকারের ব্যবস্থা হলো চাঁদা তুলে। গোপাল গোবিন্দ চিতায় পুড়তে থাকা দিদিমার দেহের দিকে উদাস চেয়ে। জানে না এরপর ওদের ভাগ্যে কি আছে? কেউ নেই ওখানে শ্মশানের মড়িপোড়া ডোমটা ছাড়া। চিতা ঠাণ্ডা করতে হবে। ডাকলো ওদের ডোম। তখনো চিতা থেকে পাক খেয়ে খেয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে, আর পুবমুখী হাওয়ায় মিশে ভেসে চলে যাচ্ছে সেই ধোঁয়া ইন্দুবালা জন্মভূমির দিকে। কারুর আর সাধ্য নেই ইন্দুবালাকে এনআরসি তালিকাভুক্ত করে এই দেশের নাগরিক ঘোষণা করবে। দেশকালের গণ্ডী বড়ো গৌণ এখন ইন্দুবালার হৃদয়ে দেশভাগের দগদগে ক্ষতর বিরামহীন ক্ষরণে। সেই ক্ষরণে সামান্যতম প্রলেপের অবকাশ অভিমানী ইন্দুবালা এই অহঙ্কারী দেশটাকে দিতে চায় নি হয়তোবা আর, কিছুতেই! এনআরসি তালিকা মুবারক… বলে গেলো হয়তো ইন্দুবালা যাবার বেলায়। কে জানে?


(ডিসক্লেইমার:- প্রিয় পাঠক পাঠিকাবৃন্দ, আমার দাদামশাই-দিদিমার মুখে শোনা তাঁদের স্মৃতির ভাঁড়ার থেকে, তাঁদের চাক্ষুষ দেখা শিকড় ছেঁড়ার অমূল্য অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। প্রায় পাঁচ দশক আগে শোনা, বাহাত্তর বছর আগের আবেগতাড়িত এ বিবরণ। গল্পাকারে রূপান্তরের সময়, এই কাহিনী বিন্যাসের বা অন্য কোথাও যে কোনো ত্রুটি থেকে থাকলে তা আপনারা নিজগুণে ক্ষমা করবেন, এইই আশা।)

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী

জন্ম ১২.৭. ১৯৬৭ তে কলকাতা সংলগ্ন শহরতলিতে। পেশায় শিক্ষিকা। পড়াটা নেশা, লেখাটা প্রচেষ্টা, আর ভ্রমণ ও সঙ্গীত শখ। প্রকাশিত সাহিত্য: আয়নায় (যৌথ কবিতা সংকলন), পঞ্চ-ভূতে পঞ্চ-প্রাণ (একক গল্প সংকলন), ষড়রিপু ( একক গল্প সংকলন), প্রকাশিতব্য: একটি উপন্যাস, দু'টি একক সংকলন এবং চারটি সমবেত সংকলন, একটি সমবেত কবিতা সংকলন। শারদ পত্রিকা: প্রতিলিপি বাংলা, আত্মপক্ষ, শব্দের মিছিল, ঝিঙেফুল সাহিত্য পত্রিকা, জিজীবিষা, এবং প্রকাশনায় অপেক্ষায় আছে আরো অনেকগুলি পত্রিকা এবং ই-বুক। পুরস্কার: টপ ব্লগার মমস্প্রেসো বাংলা (চারবার), প্রতিলিপি বাংলা (উইনার বিশ্ব বাংলা গল্প উৎসব এবং আরো তিনটি ইভেন্টে পুরস্কার), স্টোরি মিরর পাবলিশিং হাউস (নমিনেটেড ফর অথর অফ দ্য ইয়ার), সাতকাহন প্রকাশনী সাহিত্য সম্মান। ফার্স্ট প্রায়োরিটি: পরিবার।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।