কবিতার খোঁজে গলি থেকে রাজপথ
◆ মেধাবী জিন ও কবিতার ভ্রুণ
“কৌটোর মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা
– বিনয় মজুমদার
উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ, দিকচক্রবাল”
প্রতিভা যতদিন সুরক্ষিত থাকে ততদিনই মাংসের ঘ্রাণ। তা কতটা ভবিষ্যত কে উদ্ভাসিত করবে তা বলা হয়তো সময়ের হাতে। তবু এই কৌটোর মাংসই তো শক্তি যোগান দেয় প্রতিকূল অবস্থায় একজন শব্দ সৈনিককে।
কবিতার জন্ম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যেমন প্রতিভার প্রসঙ্গ উঠে আসে, তেমনই কথাশিল্পীর সহজাত ভাব ও ভাবনাও শুরুর দিকে একটি কবিতার প্রথম মুকুল ফোঁটাতে সাহায্য করতে পারে। কবিতার জন্ম নিয়ে যেমন কবির নিজস্ব জীবনযাপন একটি সরাসরি ভূমিকা নিয়ে থাকে, তেমনই তাঁর নিজস্ব খাদ্য অর্থাৎ তাঁর পাঠ অভ্যাস ও পড়াশোনাও যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তা পাঠকমাত্রেই জানেন।
◆ পাঠক কারা ও জনপ্রিয়তার মাপকাঠি
আমাদের সমাজে কবিতা নিয়ে একটা মিথ ইতিমধ্যেই চালু আছে যে পূর্বে কবিতার যত পাঠক ছিল, যত দিন যাচ্ছে কবিতা তত বেশি পাঠক হারাচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কবিরাই হয়ে উঠছে কবিতার পাঠক। কবিতা কি তবে অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং এখন তা ভাবনার রাজপথ বেছে নিয়েছে? আসলে কবিতার সর্বজনগ্রাহ্যতা হয়তো কোনদিনই ছিল না। সেটা যে কোন শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শিল্পের প্রতি অনুরাগ হয়তো সমাজের সব শ্রেণীর সব রকম মানুষের মধ্যে সচেতনভাবে জাগিয়ে তোলা কিছুটা কঠিন। কিন্তু কিছু বিশেষ অবস্থা বা বৈশিষ্ট্য শিল্প ও কাব্য চর্চার ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে থাকে বিভিন্ন সময়ে।
একটা সময় কাহিনীধর্মীতা, লিরিকপ্রিয়তা কবিতার পাঠক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা নিয়েছে। প্রেম, ভালোবাসা, মানবিক সম্পর্ক এসবের প্রতি যে একটা তীব্র আকর্ষণ পাঠক মননে কাজ করেছিল, পরের দিকে এসবের পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়, বিদেশি শোষণ এসবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও পাঠকপ্রিয় করে তুলেছে কবিতার জগৎকে। তবে কবিতার ব্যুৎপত্তিগত জন্মরহস্য নিরসন করতে গিয়ে বারবার যে বিমূর্ত ধারনার কথা উঠে আসে সেই কুয়াশাপরত বাংলা কবিতায় যত চেঁপে বসতে শুরু করে সম্ভবত সেই সময়টাই পাঠক হারানোর ক্ষেত্রে মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। আবার একথাও ঠিক যে কবিতা পেয়েছে নতুন এক সচেতন পাঠক জগৎকে যারা মিলে মিশে ভাগ করে নিচ্ছে সমস্ত ধরনের লিখন শৈলীকে।
◆ দূর্বোধ্যতা ও পাঠক সমাজ
” গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
– জীবনানন্দ দাশ
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় – অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে “
এই ধরণের কবিতা পাঠককুল কতটা সহজে গ্রহণ করতে পারবে সে নিয়ে একটা সময়ে যে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছিল তা আজও বিদ্যমান। কিন্তু কবি যদি পাঠকের কথা ভেবে লেখেন তাহলে তো তাঁর নিজের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতার সমান। তিনি যদি সহজভাবে ও সরাসরি উপস্থাপনে বিশ্বাস রাখেন তো আলাদা কথা। কিন্তু কবিতা যদি তার কাছে বিমূর্ত ভাবেই আসে, গোপনীয়তা, স্বপ্ন ও কুয়াশা নিয়েই যদি কবিতার জন্ম ঘটে সেক্ষত্রে তিনি কি করবেন! আবার এমনও হতে পারে সময়ের সাথে সাথে তাঁর সঙ্গযাপন ও বিবিধ চর্চা তাঁর লিখন শৈলীতে প্রভাব ফেললো। অনেকেই চান শুরুতে তাঁর একটা নিয়মিত পাঠককুল গড়ে উঠুক, তারপর তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষার পথে হাঁটবেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে উল্টোটিও ঘটে। জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি সাধারণ পাঠকের কাছে নিবিড় ভাবে পৌঁছতে “রূপসী বাংলা” – র মতো কাব্যগ্রন্থ পরিবেশন করেছেন। আসলে এই জার্নিতে কে কখন সওয়ার হবেন তা তিনি নিজেও জানেন না।
সমসাময়িক কবিতার ধারা নিয়েও যদি আমরা পর্যালোচনায় যাই দেখা যাবে কবিরা ক্রমশঃ নিবিড় সাধনায় মগ্ন হচ্ছেন। বেশি করে ভাবছেন কবিতার নির্মাণ নিয়ে , বিভিন্ন ফর্ম নিয়ে। পরীক্ষা নিরীক্ষার চেষ্টা চলছে নিয়ত। আগামী দিনের কবিতাকে পথ দেখাতে তারা সহায়ক হবেন।
◆ কবিতায় অনুপ্রেরণা বা ভাব চুরির অভিযোগ > কিছু প্রাক্তন উদাহরণ
আদৌ কি কোনো সৃষ্টিই মৌলিক? আমরা যা কিছুই তৈরি করে চলেছি তা আসলে কোনো না কোন ভাবে আমাদের অবচেতন এ কাজ করে চলা কিছু স্মৃতি বা অভিজ্ঞতার ভাড়ার থেকে উঠে আসা শব্দবন্ধকেই আলোড়িত করে। আজকাল এই যে এত কবিতা চুরি, ভাব চুরির অভিযোগ, ব্যক্তি আক্রমণ, স্ক্রিনশট এর রাজত্ব চলছে তা যে সবক্ষেত্রেই অমূলক তা বলছি না, কিন্তু এই প্রভাব বা অনুপ্রেরণা আগেও ছিল, এমনকি সমসাময়িকদের মধ্যেও। মধ্যিখানে যেটা হারিয়ে গেল তা হলো সৌজন্যতা ও ধৈর্য্যশক্তি। এ প্রসঙ্গে অতীত থেকে বেশ কিছু প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যেতে পারে। পাঠক নিজেই বিচার করে দেখুন।
১) বুদ্ধদেব বসু লিখছেন তাঁর “একখানা হাত” কবিতায় –
” বিছানায় শুয়ে আছি , ঘুম হারায়েছে ;
না জানি এখন কত রাত ; “
আবার জীবনানন্দ লিখছেন তাঁর ” পাখিরা ” কবিতায় –
” বিছানায় শুয়ে আছি ;
– এখন সে কতো রাত ! “
২) বুদ্ধদেব বসু লিখছেন তাঁর ” আমন্ত্রণ – রমাকে ” কবিতায় –
আমি বসাবো তোমাকে মোর ইজি-চেয়ারে
আমি বসবো পাশে ।
ঘরে জ্বলবে মোমের আলো এক কিনারে ,
আর জ্বলবে সন্ধ্যতারা আকাশপারে “
আবার বিষ্ণু দে লিখছেন ” গার্হস্থ্যাশ্রম ” কাব্যমালায় –
” তৃতীয়ার ক্ষীণ করুন আলোয় দখিন হাওয়ায়
কাঁধে কাঁধ দিয়ে ইজিচেয়ারেই বসবো দোঁহে । …
স্তব্ধ শহরে করুন আলোয় নিরালা কোনায় …
আঁধারে মাঝে সন্ধ্যতারা সঙ্গহারা জ্বলে ; “
এখানে দুটি কবিতায় উল্লিখিত ‘ ইজি-চেয়ার ‘ ও ‘ সন্ধ্যতারা ‘ এই দুটি শব্দের কোনটিই অসাধারণ শব্দ নয়, এগুলি কারো পৈতৃক সম্পত্তিও নয় । তবুও বিষ্ণু দে -র কবিতায় ব্যবহৃত এই দুটি শব্দ পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসুর কবিতায় দেখে একটু অবাক হতেই হয়।
৩ ) সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা “শাশ্বতী” – র একটি পংক্তি –
” সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না “
আবার “বর্ষার দিন” কবিতায় বুদ্ধদেব লিখছেন –
“বলে কানে কানে, ‘আমার অঙ্গীকার
ভুলবো না আমি, কোনদিন ভুলবো না।”
◆ আগামী দিনের কবিতা পরিবেশ
আসলে এসব আলোচনা , সমালোচনা চলতে চলতেই পাঠক নিজেকে ঠিক খুঁজে নিচ্ছে তাঁর প্রিয় কবিতাকে । এখন সেই পাঠক যদি কবি হয় সেটা দোষের নয় , আখেরে অন্ধ অনুরাগীর চেয়ে সচেতন সমালোচক সবসময় কবিকে উত্তরণের পথ দেখায় । কিন্তু প্রকৃত সমালোচনা হচ্ছে কি ? ক্রমশঃ পারস্পরিক পিঠ চাপড়ানি অথবা নিতান্তই ব্যক্তিগত শত্রুতার বশে সমালোচনা – এর কোনটাই কবি বা কবিতার উন্নতিতে সহায়ক হবে না বলেই মনে করি । তাই সমালোচনা গ্রহণ করার মতো মানসিক সৌন্দর্যও নিজের মধ্যে প্রতিপালিত হোক । কবির নিজস্ব অহংকার থাকুক । কিন্তু তা যেন তাঁকে আন্তরিক হওয়ার পথে অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায় এই আশাই রাখি । পাঠক অবশ্যই বাড়ুক । পাঠ বাড়ুক আরো বেশি । তবেই আগামী দিনের কবিতা একটি সুস্থ পরিবেশ খুঁজে পেতে সমর্থ হবে ।
ঋণ : শ্রুতি ও প্রতিশ্রুতি – রঞ্জিত সিংহ
0 Comments