ভিজিটিং কার্ড

নিলয় বরণ সোম on

visiting_card

দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে মোটেই বড় নয়, কিন্তু জিনিসটি ওজনদার I অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের টার্গেট লাঞ্চিত জীবনের রোজনামচায় একটি অবশ্যকর্তব্য, পার্স বা ওয়ালেট কিংবা কার্ড হোল্ডার থেকে টুক করে কার্ড টি বের করে ক্লায়েন্টের অফিসের বড় সাহেবের কাছে পৌঁছে দেওয়া , আর প্রতীক্ষা I খস খস করে প্রেসক্রিপশন লিখে যখন ডাক্তার ক্লান্ত , ‘এম আর ‘দের ‘মিট করার ‘ সময় , ডজন খানেক এম আর এর ভিড়ে নিজের বিশেষ কার্ডটি ডাক্তারবাবুর হাতে পৌঁছে দেওয়া I বদলী হয়ে আসা নতুন সরকারী সাহেবকে তার নতুন জায়গায় সবকরম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে কার্ডের উপরে ছোট্ট ক’টি শব্দবন্ধ – জেনেরাল অর্ডার সাপ্লায়ার্স I কার্ড মালিকের ধূর্ত চাহনি , অফিস সুপারভাইজারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বিল ক্লার্কের মাসান্তে বৌকে নিয়ম করে বিরিয়ানি খাওয়ানো ঢাকা থাকে ছোট্ট ঐটুকু কার্ডে I 

অনির্বান ও সুগত দুজনে একই ম্যানেজমেন্ট স্কুল থেকে পাশ করা I অনির্বান বিশাল একটি কোম্পানিতে বিশাল প্যাকেজ নিয়ে ঢুকে পড়েছে , সুগত ছোট খাট ফার্মে চাকরি করে চলেছে I অনির্বানের অফিসে সুগতকে মাঝে মাঝেই আসতে হয় বিক্রি বাটার তাগিদে I অনির্বানের পিসেমশাই ওই কোম্পানির সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হওয়ার সময় থেকেই কোম্পানিতে জুনিয়র ম্যানেজার অনির্বানের হালকা দাপট I কিছুটা বন্ধুত্ব , কিছুটা চক্ষুলজ্জার খাতিরে অনির্বান , সুগতকে , যাকে বলে , ‘ব্যাক করা ‘ তাই করতে চায় I মুশকিলটা অন্যত্র I সুগত তার এক একটি দর্শনে ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দেয় I জানুয়ারি মাসে সে হয়ত দাম ও টেকনোলজির দিকে খান্ডেলওয়াল এন্ড কোম্পানির জিনিসটি সেরা বলে জাহির করল , অফার প্রাথমিক ভাবে অনির্বানের মনেও ধরল , মার্চ মাসে ডিল ফাইনাল করার সময় সুগত ফিসফিস করে জানিয়ে দেয় , খান্ডেলওয়াল এখন ডুবন্ত জাহাজ , তার সদ্যপ্রাপ্ত ভিজিটিং কার্ডে জ্বল জ্বল করা সানশাইন প্রাইভেট লিমিটেডের জুড়ি ভূ -ভারতে মেলা ভার I

এ হেন্ সুগত একদিন এসে আরেকটি কোম্পানির কার্ড বার করে অনির্বানের হাতে দিল – সুগত ব্যানার্জী নামের নীচে কায়দা করে লেখা – টিম লিডার I অনির্বান খুশিই হল – যাক, বন্ধুটি এখন আর পাতি সেলস এক্সিকিটিভ নেই I জিজ্ঞাসা করল , ” দেখে ভাল লাগছে তুই টিম লিডার হয়ে গেছিস ! তোর আন্ডারে কটি ছেলে আছে ? “সুগতর জবাবটি এবারও মারাত্মক , ” দূর লিডার না ছাই – এই মাঝবয়সে মালিক কোন করেপন্ডেস কোর্স এম বি এ করেছে , এখন কিছুদিন টিম বিল্ডিং, সিনার্জি , ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এসব ছাড়া কথাই বলছে না ! একা কুম্ভ আমাকে টিম লিডার বানিয়ে দিয়েছে,টিম বলতে কিছু নেই! আমার বসকে বানিয়েছে রিজিওনাল মার্কেটিং ম্যানেজার – এদিকে টেরিটরি বল , রিজিওন বল , সবই তো একটাই ! এমনকি আমাদের চুল বাদামী করা, আই ল্যাশ লাগানো যে বুড়িমত রিসেপশনিস্ট আছে , তাকেও একটি কার্ড বানিয়ে দিয়েছে – ম্যানেজার , এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন্স !

এক মাঝারি বাঙালী প্রতিষ্ঠানের মেজো সাহেব আমাদের আড্ডায় প্রায়ই আসতেনI তার কাছে কার্ড সংক্রান্ত একটি মজার গল্প শুনেছিলাম I সুগতর কোম্পানির মত সেটিও বাবুভিত্তিক – তা মালিক স্যানালবাবুর শখ হল একবার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেনI মেজো সাহেব ডেকে বললেন – একটা জম্পেশ দেখে বিজ্ঞাপন বানাও তো -সবাই জানুক আমরা কি করছি! মেজো সাহেব বললেন , স্যার বিজ্ঞাপন বানাতে তো আমরা কেউ পারব না -এতো এড এজেন্সির কাজ -আপনি বললে যোগাযোগ করতে পারিI মালিক সম্মতি দিলেন I তিনদিন বাদে ত্রিমূর্তি এন্টারপ্রাইস থেকে সৌভিক, কুন্তল আর চয়ন এসে হাজির I ওরা চলে যেতে স্যানাল মেজো সাহেবকে ডাকলেন কি সব ব্রাইট ছেলে মশাই – এই বয়সে বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স এ ঢুকে গেছে ! ভিজিটিং কার্ড গুলো রেখে দিয়েছি ! কুন্তল ছেলেটি তো দেখতেও ভাল , আমার বিজলি মায়ের সঙ্গে মানাবে না ? “মেজো সাহেব বুঝিয়ে বলেন, “ছেলেগুলো ব্রাইট তাতে সন্দেহ নেই , কিন্তু এড এজেন্সিতে প্রায় সবাই ডিরেক্টর- ওদের পোস্ট গুলোই এমনি- ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর, আর্ট ডিটেক্টর এরকম -এর সঙ্গে বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সের সম্পর্ক নেইI” শেষ অব্দি দরদামে না পোষানোতে কোম্পানির বিজ্ঞাপনও বেরোলো না, আর বিজলি, কিছুদিনের মধ্যে সবাইকে চমকে দিয়ে,বিষেন বলে একটি শিখ ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায় -সুতরাং তার আর ডিরেক্টরের ঘরনী হয় হল না I 

এর ওর মুখে গল্প শোনা ছাড়াও, ভিজিটিং কার্ড সম্বন্ধে আমার নিজের অভিজ্ঞতা তো কম কিছু নয় ! ভিজিটিং বা বিজনেস কার্ডের কাগজে যেমন বৈচিত্ৰ্য , তেমনি তার ডিজাইন বা লে আউটে I অনেকের কার্ডে দেখি ডিগ্রির ফিরিস্তিও থাকে , বি টেক , এম বি এ ( কেপিএম ), ডি সি পি পি , পি জি ডি এম ( এইচ আর ) ইত্যাদি ইত্যাদি I এরকম কার্ড দেখে একটু গা ছম ছম করে I 

একবার এক ভদ্রলোক এমনি একটি কার্ড নিয়ে এলেন -কার্ডের উল্টোদিকে আবার ‘এসোসিয়েটেড উইথ ‘ -বলে দশটি সংস্থার নাম প্রিন্ট করা I কথা প্রসঙ্গে জানা গেল , উনি আমার এক দাদার প্রতিবেশী I পরে দাদার সঙ্গে দেখা হতে বললাম চিন্তন বাবুর কথা -উনি কত গুলো কোম্পানির মাথায় রয়েছেন সেও বললাম I দাদা একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন – চিন্তন ! বাবা আই টি সি তে বড় পোস্টে কাজ করতেন – তার জমানো টাকা এ ব্যবসা সে ব্যবসাতে লাগাচ্ছে আর লস খাচ্ছে I ওর একমাত্র বলার মত এসেট হচ্ছে বৌ – রূপশ্রী একটা মন্টিসেরি চালায়- মাস গেলে নিশ্চিন্ত আয় !

সরকারি কাজে গিয়েছিলাম মাদুরাই I সার্কিট হাউসের পাশে একটা প্রদর্শনী হচ্ছিল, বিকেল বেলা গেলাম সেখানে I একটি এন জি ও তাদের নানারকম পসরা সাজিয়ে বসেছে – আলাপ হল তার মালকিনের সঙ্গে I উনি বিজনেস কার্ড টি ধরিয়ে দিলেন হাতে – দেখলাম লেখা আছে , প্রোপ্রাইট্রেস অফ অমুক ফাউন্ডেশন , ন্যাশনাল ভলিবল প্লেয়ার ( রিটায়ার্ড ), বি টেক (কম্পিউট্যার সায়েন্স ) ! তেমনি দাক্ষিণাত্যের কোনো একটি ফরেস্ট অফিসে রেঞ্জারের কার্ডে তার নাম সঙ্গে একটি বাঘের ছবি শোভা পেতে দেখেছি I 

আরেকটি রসসিক্ত ঘটনা। মধুসূদন মঞ্চে নাটক দেখতে গেছি, গরুর গাড়ির হেডলাইট, যার বিজ্ঞাপনের ক্যাচ লাইন ই ছিল,’,দম ফাটা ,হাসির নাটক। বিরতিতে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, “কেমন লাগছে নাটকটা?” আমি আমার প্রতিক্রিয়া বললাম। “উনি বললেন, ” পরিচালকের উদ্দেশ্য খুব ভাল, লোককে আনন্দ দেওয়া। আমরা এল আই সি থেকেও তাই চেষ্টা করি, লোককে আনন্দে রাখার। এই নিন আমার ভিজিটিং কার্ড…”. ভাগ্য ভাল, বিরতি শেষের ঘন্টা সে সময়ই বেজেছিল।

কোনো কোনো সংস্থা আবার কার্ডের উপর কোম্পানির মটো বা আজকের ভাষায় মিশন স্টেটমেন্টও ছাপিয়ে দেন I সরকারি বা আধা সরকারি অফিসারদের ভিজিটিং কার্ডে অশোকস্তম্ভের ছবি ছাড়াও অনেক সময় দ্বিভাষা সূত্র মেনে দুপিঠে হিন্দি ও ইংরেজিতে নাম ধাম ছাপা থাকে I কোনো এক তন্ত্রসিদ্ধ ভৈরবীর বিজনেস কার্ডে শত্রুদমন, বশীকরণ , মামলা মোকদ্দমা ইত্যাদি গূঢ় ব্যাপারে তার হস্তসিদ্ধির কথা জানান দেওয়া আছে I 

এই যে রাশি রাশি বিজনেস বা ভিজিটিং কার্ড দেওয়া নেওয়া হয়, সেগুলোর গতি কি হয় ? যারা একটু গোছানো গোছের মানুষ, কার্ড এলব্যামে পর পর সাজিয়ে রাখেন সেগুলো I অনেকের, বিশেষ করে সরকরি বাবুদের অভ্যাস আছে টেবিলে কাঁচের নীচে সেগুলোকে গুঁজে দেওয়া, অনেকে আবার সটান এগুলোকে চালান করেন ওয়ালেটে Iতবে কার্ড দেওয়া নেওয়া নিয়ে জাপানিদের প্রথা বা এটিকেট বেশ বিস্তারিত I বহুকাল আগে জাপানফেরত এক বন্ধুর মুখে এ কথা শুনেছিলাম, এখন অন্তর্জালেও তার সমর্থন পাচ্ছি I জাপানি ভিজিটর, সামাজিক প্রথামত , বিনয়ের সঙ্গে কার্ডটি দেবেন উদ্দীষ্ট ব্যক্তির হাতে I উদ্দীষ্ট ব্যক্তি হাতে কার্ডটি রেখে কিছুক্ষন দেখবেন , প্রশংসাসূচক কোন কথা বলবেন অথবা কোন কিছু জিজ্ঞাসা করবেন , তারপর সেটিকে রাখবেন তার অভ্যস্ত জায়গায় I 

আমাদের দেশেই বলুন , ইউরোপ আমেরিকাই বিদেশেই বলুন -অনেকের বিজনেস কার্ডে কৌতুকের ছোঁয়া থাকে I একটি আমেরিকান মেয়ে তার কার্ডে লিখে রেখেছিল- ” I am not a good baby sitter -but there are worse ! ” এমন উদ্ভাবনী ব্রেনের অধিকারিনীর মক্কেল সংখ্যা জানার সৌভাগ্য অবশ্য হয় নি আমার !

এবার একটা না কার্ডের গল্প বলি I 

একজন দাপুটে সিনিয়র আমলা , জয়েন্ট সেক্রেটারি পদমর্যাদার I লাল টাই পরা এক অসম্ভব স্মার্ট শেষ এক্সিকিউটিভ কর্তার দপ্তরে কোনো মেশিন পত্র বিক্রি করতে এসেছে I করতে স-পার্ষদ ‘ডেমো’ দেখলেন -তারপর পাত্রপক্ষের মত বলে দিলেন , ” ” I ‘ll let you know “

ছেলেটি যাওয়ার সময় একবার জিজ্ঞেস করল. . ” স্যার, আপনার ভিজিটিং কার্ড কি পেতে পারি ?” 

চেনা বামুনের নিস্পৃহতায় বড়কর্তা তার হাতদুটোকে সুইভেল চেয়ারে ঠেকানো মাথার পেছনে রাখলেন I বললেন , “No, I do not have any visiting card . People do visit me !” 

এমন একটি আন্টি ক্লাইমেক্সের পরে আবার কার্ডে ফেরা যাক I ছোট একটি প্রকোষ্ঠ বা কিউবিকল I একটি যুবক, একটি যুবতী I একজনের ভেন্ডর মিটিং, আরেকজনের ক্লায়েন্ট কল I কথাবার্তা, প্রেজেন্টেশন, পরবর্তী মিটিংএর দিন স্থির I বিজনেস কার্ড বিনিময়- আলাপের প্রথম দিকেই I কে বলে, কাগজে নাম লিখলে সে কাগজ ছিঁড়েই যায় – হৃদয়ে লেখা হয় না ?


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


নিলয় বরণ সোম

নিলয় বরণ সোমের জন্ম ১৯৬৫ সালে উত্তর পূর্ব ভারতের ত্রিপুরার সালেমায়। স্থায়ী বাসস্থান কলকাতায়। প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কর্মস্থল ত্রিপুরার বিভিন্ন মফস্বলে,উচ্চতর শিক্ষা কলকাতার দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কলেজ ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। ভারত সরকারের আয়কর বিভাগে ১৯৯০সাল থেকে কর্মরত। জীবিকাসূত্রে কলকাতা ছাড়াও চেন্নাই ও ডেপুটেশন সার্ভিসে আফ্রিকার দক্ষিণে বতসোয়ানায় কাজ করেছেন। লেখালেখি ছাড়া পড়াশুনা , আড্ডা, গান শোনা ও ভ্রমণে আগ্রহী। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকও লেখকের পছন্দের জায়গা। শৈশবে লেখালেখি শুরু করলেও কলেজ জীবনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বঙ্গ সাহিত্য সমিতির সভানেত্রী , বাংলার অধ্যাপিকা প্রয়াত মৈত্রেয়ী সরকারের উৎসাহে ও অভিভাবকত্বে ছোট গল্প লেখা শুরু হয়। বর্তমানে রম্যরচনায় ব্যাপৃত, অনুবাদেও উৎসাহ আছে। ছাত্রজীবন ও পরবর্তীকালে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও বিভাগীয় সাময়িকী ও প্রবাসকালে পূজা সংকলনে লেখকের লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে 'কলেজ স্ট্রিট পত্রিকায়, ২০০১ সালে। দীর্ঘ বিরতির পরে বিভিন্ন ফেসবুক গ্রূপে লেখালেখি ২০১৬-১৭ সালে শুরু । ২০১৯ সালে ফেসবুক গ্রূপ ' শনিবারের আসরের ' ২০১৯ সালের পূজা সংকলনে একটি রম্যারচনা প্রকাশ পায় । ওয়েবজিন 'সময়.ইন ' এর কয়েকটি সংখ্যায় লেখকের রম্য রচনা স্থান পেয়েছে। সৃজনাত্মক সাহিত্যের পাশাপাশি আয়কর আইন সংক্রান্ত বিষয়ে লেখক লেখালেখি করেন।২০১৩ সালে বিভাগের 'ট্যাক্সপেয়ার ইনফরমেশন সিরিজে' যুগ্মলেখক হিসেবে 'Royalty and Fees for Techn।cal Serv।ces' শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ পায়। ২০১৯ সাল থেকে বিভাগীয় ওয়েবজিন 'ট্যাক্সলোগ'-এ লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।