ভয়
ছেলেবেলা থেকেই অদ্ভুত ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। মানে এতটাই বাড়াবাড়ি রকমের যে… ভয় নামক ভয়ংকর বস্তুটিই আমাকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে না যায়, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেখার বিষয়। তবে হ্যাঁ,আরশোলার কাছে আমি চিরকাল কাবু।একে যদি ভয় বলে,তো আমি মেনে নিচ্ছি আমি ভীতু। তাই উড়ন্ত আরশোলার বিচিত্র গতি আর আমার চিল চিৎকারের সমানুপাতিক সম্পর্ক দেখে আমার পিতৃদেব খুব মজা নিতেন চিরকাল ই।যাইহোক, “সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের ন্যায়”। নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলি,উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হলাম বড়ো শহরের নামকরা কলেজে। স্বাভাবিকভাবেই হস্টেলে উঠলাম। হোস্টেলটা অনেকটাই পুরোনো। চেহারা অনেকটা ওই উত্তর কোলকাতার ঐতিহ্যবাহী অবতারের মতো। কানাঘুষোতে শুনতাম হোস্টেলের উত্তরের ঘরটা নাকি সুবিধার না। তাই সকালে ই বারণ করেছিল ওই ঘরটা না নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি ও তো ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নই। অনেক বলে কয়ে ও সেই ঘরটা ম্যানেজ করতে পারিনি ঠিক ই। কিন্তু,ওটার সবচেয়ে পাশের ঘর টা নিয়ে ম্যানেজ করেছিলাম, দিব্যি দিন ও কাটাচ্ছিলাম। ঘরটার সাথে লাগোয়া একটা বহু প্রাচীন বটগাছ ছিল। কি জানি কি জন্য গাছটাকে দেখলেই বড্ড অস্বস্তি হয়।বলা নেই কওয়া নেই নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তবুও বেশ কিছু দিন ভালোই ছিলাম। হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল। আমি কেমন যেন একটা কিছুর অস্তিত্ব টের পেতাম সব সময়।একা থাকলেও মনে হত কেউ যেন আছে। যাই হোক, এর মধ্যে ই আমার এক বন্ধু আমার হস্টেলে ক’দিন কাটাতে এসেছিল। ওরকম একটা হস্টেলে বহাল তবিয়তে সাহসের সাথে থাকি বলে খানিক বীরত্ব দেখিয়ে ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠিয়ে ওকে সব কথা খুলে বললাম। ঘুড়িয়ে দেখিয়ে ও ছিলাম সব।ঘটনা চক্রে সেদিন দেখানো বাকি পরে গেল সেই উত্তুরে ঘরটা। সেদিনের মত সফর স্থগিত করে পরের দিনের এজেন্ডা তেই সেটাকে রেখে দিলাম।
কলেজের কাজের জন্য ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেছিল। একেই শীতকাল তার উপর সেদিন যেন একটু জলদিই সন্ধ্যা নেমে যাচ্ছিল। টুপটাপ বৃষ্টি ও পড়ছিল। আমরাওমেতে উঠলাম অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। ওই বট গাছটার নিচে এসে কি যেন দেখে দুজন ই কুড়োচ্ছিলাম .. ঠিক মনে নেই। এমন সময় আমাদের নজরে পড়ল ওই ঘরটা। লক্ষ্য করলাম হাওয়ার দমকেও ওই ঘরটার হালকা ভেজিয়ে রাখা পাল্লা টা খুললো না। একটু কাছে গিয়ে কান করতেই শুনলাম টিক্ টিক্ করে ঘড়ির কাঁটা সরার মতো শব্দ। খটকা লাগলো। এত বছরের নিষিদ্ধ ঘরটাতে ব্যটারি ছাড়া ঘড়ি চলে কি করে?
মধুমিতা বলে আমার এক বছরের সিনিয়ার বন্ধু ছিল। প্রথম থেকেই দেখতাম মেয়েটা কিরকম গুম মেরে থাকতে। আবার ভয়ে ভয়ে ও। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম , কি হয়েছে তোমার?” সেদিন ও আমার একটা প্রশ্নের ও জবাব দেয়নি। শুধু বলেছিল,” তোর ভালো চাই তাই বলছি ওই ঘরের দিকে কিন্তু এক পা ও বাড়াবি না।চুলোয় যাক তোর এক্সপিরিয়েন্স।” আস্তে আস্তে যত পুরনো হতে থাকলাম কলেজে তত ই কানাঘুষো বেশি করে কানে আসত। শুনেছিলাম ওই ঘরের সাথে ওর খুব খারাপ একটা কিছু হয়েছিল। কি হয়েছিল সেটা খুব কড়া ভাবেই বলতে বারণ করেছে হস্টেল অথারিটি। তার পর থেকেই ও এমন হয়ে গেছে। এতদিন পরে মনে পরে গেল মধু দি’র, “প্লিজ ওখানে যাসনা ভাই”।
হঠাৎ ই জানালাটা খুলে গেল। কোনো রকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই। আবার হাওয়া ও ছিল না। একদিকে ভয়,অন্যদিকে কৌতুহল.. ঠক্ ঠক্ করে পা কাঁপছে। বহু কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে তাকিয়ে দেখি……
হস্টেলের ঠিকাদার সিং জি ঘড়িতে ব্যাটারি লাগিয়ে ট্রায়াল দিয়ে ভেতর থেকে জানালা খুলছিলেন।
আমাদের দুজনের তখন হার্ট অ্যাটাকের যোগাড়। এদিকে সিং জি তো হেসেই খুন। সত্যি সত্যিই সেখানে ভূত বাবাজি থাকেন কি না বলতে পারি না। তবে ওই হতভাগা ঠিকাদার যে ভয়টা দেখিয়েছিল.. তাতে বোধকরি সৃষ্টি কর্তা ও তার সৃষ্টির ওপর বিশ্বাস হারিয়েছিল।
0 Comments