ফেরত
অবশেষে ধুঁকতে ধুঁকতে মার্টিন কোম্পানীর অতিকায় ইঞ্জিনটা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অমৃতসর থেকে লাহৌরের মুঘলপুরা স্টেশনে এসে ঢুকল। গাড়ী প্রায় আটঘন্টার ওপর লেট ! এই ট্রেনের যাত্রীসংখ্যায় বেশ বৈচিত্র আছে। অর্ধেক যাত্রী আসলে অগুন্তি ডাঁই করা লাশ, আর অর্ধেক ছিন্নভিন্ন আহত মানুষ। কান্না, আর্তনাদ আর শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ লেপে আছে এদের সর্বাঙ্গে। মধ্যরাত্রির স্বাধীনতা প্রাপ্তির সবকটা চিহ্নই ট্রেন জুড়ে এখনো জ্বলজ্বল করছে।
বেলা দশটা নাগাদ সিরাজউদ্দিনের হুঁশ ফিরল। জ্ঞান ফিরতে প্রথমেই চারপাশে যেটা দেখতে পেল তা হল চাপ চাপ রক্ত আর ইতঃস্তত স্তূপীকৃত ছড়িয়ে থাকা লাশের মধ্যে যে সে এখনো বেঁচে আছে। এই মুহূর্তে এটাই খুব আশ্চর্যের। কোণাকুণি তীর্যকভাবে সূর্যের আলোটা চোখে পড়ে জ্বালা ধরাচ্ছে। মাথাটাও ভারী হয়ে আছে সঙ্গে অসম্ভব ব্যথা।
এদিক ওদিক চোখ বোলাতে কিছু বিধ্বস্ত নারী,পুরুষ, আর শিশুর জটলা দেখতে পেল সে। অনেকেই পালিয়ে আসতে যেমন পেরেছে, আবার মরেছেও কম নয় ! যারা বেঁচে আছে তারা সবাই রিফিউজিদের ছাউনির দিকে যাচ্ছে। নিজেদের বাড়ির লোকদের খোঁজ করছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
সিরাজউদ্দিন মনে করতে চেষ্টা করে ঠিক কোথায় সে আর সাকিনা, মানে ওর মেয়ে আলাদা হয়ে গেল তা মনে করতে লাগল..মিলিটারীদের ট্রাকে.. ট্রেনে…স্টেশনে..কোথায়? সেটা আর একদম মনে পড়ছে না এখন!
চোখের ওপর একটা দগদগে দৃশ্য ভেসে উঠল। পালানোর সময় দাঙ্গাবাজদের হাতে ওরা ধরা পড়ে গেছিল ! সাকিনার মা’র তলপেটে ছোরা ঢুকিয়ে দিয়েছিল শয়তানের বাচ্চাগুলো। আর সেই হাঁ-করা ক্ষতটা থেকে ভলভলিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। অস্ফূট স্বরে সে যেন শেষবারের মত বলেছিল.. পা-আ-আ-লা-আ-আ-ও !
সিরাজউদ্দিনের গলা থেকে গোঙানির মত ‘সাকিনা! সাকিনা!’ নামটা দু’বার বের হল। সে ও কোথায় কে জানে। কামিজের পকেটে একটা রক্তমাখা ওড়না রয়েছে উঁচু হয়ে, ওটা তো সাকিনা’রই ! কপাল চাপড়ে মাথা ঠোকে সে। দাঙ্গার বিপর্যয়ে এখন চোখ থেকে জলটুকুও আর বের হয়না। দৌড়ে পালানোর সময় সাকিনার এই ওড়নাটা মাটিতে পড়ে গেছিল। ও তুলতে যাচ্ছিল নীচু হয়ে, সাকিনা বলেছিল – ওসব থাক আব্বু ! পালাই চল! ওরা ধরে ফেলবে আবার…
সামনের রাস্তায় চারজন বন্দুকধারী টহল দিচ্ছিল। সিরাজউদ্দিন ওদের দিকে এগিয়ে গেল। কাতর গলায় জিজ্ঞাসা করল -‘ মেরে বেটী কো আপলোগ নে কহিঁ দেখা হ্যায় ক্যা? গোরী সি হ্যায় ওহ্! উসকি আম্মী জ্যায়সি সুরত হ্যায় মেরী বাচ্চী কি ! সাকিনার গালে যে তিল আছে তাও ইঙ্গিতে বোঝাল ওদের। ওরা আশ্বস্ত করল সিরাজকে, যদি সে বেঁচে থাকে নিশ্চয় খুঁজে বের করবে ! চারদিকের অবস্থা তো সুবিধার নয়!
অনেক নারী,পুরুষ, শিশুকে খুঁজে পেতে ক্যাম্পে উদ্ধার করে আনলেও, সাকিনা’র অবশ্য এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ছাউনির সর্বত্র একটা হাহাকার ফুকরে মরছেই।
দিনদুয়েক পরে, মিলিটারী লোকগুলো ক্যাম্পে ফেরত আসার সময় একটি বছর সতেরোর মেয়েকে রাস্তায় একা উদভ্রান্তের মত দৌড়াতে দেখে। ট্রাক থামিয়ে কোনওভাবে তাকে উঠিয়ে অানে। মলিন, প্রায় শতচ্ছিন্ন রক্তের দাগ লাগা পোষাকের ফরসা, বাঁ গালে তিলওয়ালা মেয়েটা ট্রাকে উঠেই অস্ফূট গোঙানীর মত শব্দ করে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে।
মেয়েটাকে জ্ঞান ফেরার পর ওরা যত্ন করে গরম দুধ আর রুটি খেতে দিয়েছে। চারজন সশস্ত্র যুবককে সামনে দেখতে পেয়ে মেয়েটা সম্বিৎ ফিরে পায় যায় যেন। ওড়নাটা এখন কোথায় কে জানে? কাঁপা কাঁপা হাতের পাতায় বুকদুটো ঢেকে ভীত জড়োসড়ো হয়ে সে গুটিয়ে বসে থাকে এক কোণে।
সর্দারগোছের একজন মেয়েটির মাথায় হাত রেখে বলে ‘বহেনজী ডরো মৎ’! ‘তোমার আব্বুর নাম কি সিরাজউদ্দিন? ‘তোমার নাম সাকিনা?’ ঘোলাটে চোখে নিরুত্তর থাকে মেয়েটি। অবশেষে কোনওমতে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।
ক্যাম্পের অস্থায়ী হাসপাতালের সামনে মাথায় হাত দিয়ে সিরাজউদ্দিন অসহায়ের মত বসে ছিল। এখনো সাকিনাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আল্লাহ্ র কাছে প্রার্থনা করার সময় একটা আশ্বাসবাণী ওর কানে বাজে- ” যদি সে বেঁচে থাকে নিশ্চয় ওরা খুঁজে বের করবে ! চারদিকের অবস্থা তো সুবিধার নয়!”
খানিক পরে স্ট্রেচারে করে একটি অল্পবয়সী অচেতন মেয়েকে লোকগুলো ধরাধরি করে হাসপাতালে আনে। দেখতে পেয়ে সিরাজউদ্দিন ছুটে যায়।
” এই-ই-ই-তো-ও-ও-ও ! সাকিনা…মা আমার…ইয়াহ্ আল্লাহ্”!
ডাক্তারটি ছোকরা বয়সী। ঘরটিতে আলো জ্বালাতে বলে স্ট্রেচারের দিকে এগিয়ে যায়। মেয়েটির নাড়ীর গতি খুব ক্ষীণ! রক্তপাতে শরীর অবসন্ন। বোঝাই যাচ্ছে পাশবিক অত্যাচারের আর একটি মর্মান্তিক নমুনা এটি।
সিরাজউদ্দিন ফুঁপিয়ে বলে ওঠে- ‘এ আমার মেয়ে! সাকিনা! আআআমি ওর আব্বু!’
ডাক্তারটি ওদের দুজনের দিকে তাকায়। ঘরের ভিতরটা একটু গুমোট আর ভ্যাপসা! গম্ভীর স্বরে তিনি বলেন –
‘ খিড়কীয়াকো জারা খোল দো’
স্ট্রেচারে অচেতন মেয়েটি হঠাৎ যেন তা শুনে একবার নড়ে উঠল। তার কানে আবছা স্বরে ভেসে এল দুটি শব্দবন্ধ – ‘খো-ওওওওল -দো-ওওও’
তার কম্পিত হাত কামিজের ছিন্ন দড়িতে টান দেওয়ার বৃথা প্রচেষ্টা করে। তারপর একটুখানি স্খলিত বসনের ফাঁক দিয়ে তার রক্তমাখা জঙ্ঘাদুটি উন্মুক্ত হয়ে আসে।
‘সাকিনা ! মা !বেঁচে আছে! ডাকডার সাহাব! বেটী আমার জিন্দা আছে!’
সিরাজের কান্নায় হাসপাতালের ঘরটা গমগম করে ওঠে..আরও একবার।
- সাদাত হাসান মান্টোর গল্প ‘খোল দো ‘ – এর অনুবাদ।
0 Comments