ছাড়পত্র
ঝকঝকে পেতলের সাজ পড়ানো টাঙ্গাটা নিয়ে আবু যখন বাজারের স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়, ওকে ঠিক যেন এক মোঘল বাদশাহদের মতই লাগে। ওর নির্মেদ, ঋজু চেহারাটায় এমন কিছু একটা আভিজাত্যের জৌলুস আছে যেটা অবশ্যই অন্য কোচোয়ানদের চেয়ে আলাদা। আবু কখনো নেশাভাঙ করেনা বলে তার সূর্মা পড়া দু’চোখের দৃষ্টি সর্বদা প্রখর ও উজ্জ্বল দেখায়। কোচবাক্সে তার গর্বোদ্ধত বসবার কায়দা আর শখ-শৌখিনতার জন্য ওকে যেন এক শাহজাদা তার তখত্- ই তাউসেই আসীন বটে।
পনের টাকা করে তার রোজ কামাই। তা অবশ্য নেহাৎ কম নয় এই বাজারে। যে কটা টাঙ্গা দুবেলা ভাড়া খাটে তাদের চেয়ে হয়তো কখনো একটু বেশী বা কম হয়েই যায়। মোট কথা নিজের মর্জিতে গাড়ি হাঁকায় সে।
সবাইকে তার গাড়িতেও তোলেনা। এ নিয়ে লোকে দু’কথা শোনাতে ছাড়েনা তাকে।
আবু’ র তাতে কিছু এসে যায়না মোটেও।
সে নিজের বাদশাহী মর্জি , তার টাঙ্গাগাড়িটি আর আদরের ঘোড়া ‘চিন্নী’ এই নিয়েই তার দুনিয়া। এ নিয়েই সে মশগুল থাকে আরব্যোপন্যাসের ‘এক্ রাত কা সুলতান ‘সেজে।
সেদিন এক দুপুরবেলায় বড় ঝাঁকড়া গাছেটার নীচে গাড়ি লাগিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। রোজই এ সময়টা তাই করে থাকে সে। এমন সময়ে বুলবুল পাখির ডাকের চেয়েও মিষ্টি গলার রিনরিনে অথচ স্পষ্ট ডাকটা কানে এল।
দেখল একটা মেয়ে, ষোল কি সতের বড়জোর। পরণে ঢোলা কূর্তা আর আকাশনীল জমির স্কার্ট। একটা হাল্কা রঙের দোপাট্টা দিয়ে মাথাটা ঢেকে রাখলেও কানের ঝোলা রূপোলী ঝুমকো আর সামনে সিঁথে করা বিন্যস্ত চুলের কিছুটা তার দেখাই যাচ্ছিল তা সত্ত্বেও।
‘ স্টেশন অবধি যেতে কত ভাড়া নেবে..?’
বাঁশীর আওয়াজও কি এত মিষ্টি শোনায়?
আবুর সূর্মা পড়া চোখে দুষ্টুমি ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
‘ তোমার জন্য একপয়সাও লাগবে না..’
একমুঠো লজ্জাঅরুণ ফাগ ছড়িয়ে পড়ে মেয়েটার মুখে। সে আবার বলে ওঠে –
‘ বলছি! স্টেশন অবধি যেতে কত ভাড়া নেবে..?’
আবু ইশারা করে চোখের। মেয়েটিকে উঠে বসতে বলে।
‘ যা ইচ্ছে হয় দিও না হয়! তোমার সাথে সওদা করব না আজ!’
‘তাহলে জলদি চালাও’ বলে হুড়মুড় করে মেয়েটা গাড়িতে উঠে আসে।
আবুর চোখে আবার বিদ্যূৎ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মেয়েটা কাপড়চোপড় সামলে ত্রস্ত হয়ে বসে। গাড়িটা অনেক গলিঘুঁজি দিয়ে ঘুরপথে ছোটে সময় নিয়ে। যেখানটায় ফাঁকা মাঠ ঘোড়ার ক্ষুরে রাঙা ধূলো ওড়ে সেখানে পথের কিনারে। তাদের গন্তব্যের পথ তবু যেন আর ফোরাতে চায় না!
‘ কিন্তু এখনো স্টেশন এল না কেন?’ মেয়েটির গলায় যেন একটু কপট উষ্মা!
আবু ততক্ষণে মেয়েটার পাশে এসে বসেছে।
পৃথিবীর কিছু রাস্তার বাঁকে বাঁকে কিছু গল্প লেখা হয় এমন করেই। দিনান্তের আলো সেখানে গা’এর ওপর আলতো ছোঁয়ায় রূপকথার গল্প বুনতে বসে অহেতুক।
গাড়ি থামিয়ে আবু মেয়েটির হাত দুটো তার হাতের মধ্যে নেয়। করুণ প্রেমের আর্তি আর সম্পূর্ণ সমর্পণ তার শাণিত অবয়বে ফুটে উঠছিল।
‘ জানো! আজকের দুপুর অবধি এই গাড়ি আর ঘোড়াই আমার সবটুকু দুনিয়া ছিল। এখন তোমাকে দেখবার পর থেকে প্রথমবার এগুলো সব বেচে তোমায় গয়না কিনে দিতে খুব ইচ্ছে করছে….বুঝতে পারছ না কেন, যে আমাদের দু’জনের স্টেশন আসলে একই ? আমার বল্গার রাশ তোমার হাতেই ধরাতে চাই শাহজাদী…হ্যাঁ… আজ থেকে..’
‘ তুমি কেন আমায় ছুঁলে! আমায়….’ অধর স্ফূরিত হয়ে ওঠে আসন্ন বৃষ্টির সম্ভাবনায়…
এরপর মেয়েটির সুন্দর নিষ্পাপ মুখটিকে আর মেঘে ঢাকতে দিতে দেওয়া যায়না।একমাত্র যৌবনই পারে জীবনকে সংশয়মুক্ত মান্যতাটা দিতে।
নাঃ, আবু’ কে আর গাড়ি বিক্রি করে কোন গয়না কিনতে হয়নি। নিঃশর্ত উৎসর্জনেই সে ওই মেয়েটিকে তার জীবন জুড়ে পেয়েছে। তবে তার জমানো টাকায় বেশ কিছু দামী কাপড় কিনে দিয়েছে তার বিবি কে। ‘ নেশতি’ এক গরীব মুচির মেয়ে। ওরা গুজরাট থেকে এখানে এসেছিল কাজের জন্য। বাড়ির লোকেরা বোধহয় এখনো স্টেশনেই অপেক্ষা করছে হয়তো!
বিয়ের পর একটা মাস কাটল দুর্দম আনন্দে। এত সুখ বোধহয় ওরাও ভাবেনি কখনো যে ওদের জন্য তোলা ছিল।
কিন্তু হঠাৎ একদিন পুলিশ এসে ঢোকে ওদের ঘরে। আবু কে ধরে নিয়ে যায়। ‘ নেশতি’ র বাড়ির লোকেরা আবুর নামে জোর করে তাদের মেয়েকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করার অভিযোগ করেছে। বালিকা বধূর আপত্তি খারিজ করেই দু’বছরের জেল হয়ে যায় আবু’র।
বাড়ির লোকেরা ‘ নেশতি’ কে ফিরে যেতে চাপ দেয়। কিন্তু সে থাকে অনড় হয়ে। আবু’র পৃথিবী আর দুনিয়া তার কাছে এখন এক। সে যতদিন গরাদের ওপারে ততোদিনই গরাদের এপারে সেও একই শাস্তি ভাগ করে নেবে একাকিত্বের শৃঙ্খলে।
হপ্তায় একদিন করে সে যায় আবুর সাথে দেখা করতে। এই কদিনেই মলিনতা লেগেছে আবুর চেহারায়। ঢিলে ডোরাকাটা পোশাকে তাকে অচেনা লাগে, ক্লান্তির ছাপও খানিক তার চোখেমুখে। আবুও দেখতে পায় ‘ নেশতি’ র কানের দুল গুলো এবারে আর নেই। সে টের পায় অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে দ্রুত তাদের জীবনে।
‘ চিন্নীর ঘাড়ের কাছে আলতো চাপড় মেরে বলো আবু তাকে ভোলেনি…’ আবুর গলার ক্লান্ত আওয়াজটা ঘুরপাক খায় শূন্য আস্তাবলটায়।
জেল হাসপাতালে টিবি হয়ে আবু’র আর ফেরা হলনা ঘরে। অশ্রুত আর অব্যক্ত অনেক কথাই রয়ে গেল অনুচ্চারিত। ‘ নেশতি’ র চোখে এখন আর জল আসেনা। সবটাই শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে এতদিনের অপেক্ষার অবসানে।
আবু’র বন্ধু ডিনো’র কাছে গাড়িটা দেওয়া আছে। ওই চালায় আজকাল। পাঁচ টাকা রোজ অন্তত যেমন সে ভাড়া পায় দিয়ে যায় ‘ নেশতি’র হাতে । সে বুঝতে পারে ডিনো’র চাহনিতেও বদল আসছে আজকাল। একদিন তো সরাসরি সে বিয়ের প্রস্তাব দেয় ‘ ‘নেশতি’ কে। শুনেই বেআদবটার মুখের ওপর চড় কষাতে ইচ্ছে করলেও সে নিজেকে সামলে নেয়। অত্যন্ত
ধীরগলায় কেটে কেটে সে বলে ওঠে
‘ আমার আর বিয়ে করার ইচ্ছে নেই!’
পরদিন থেকে ওই পাঁচটা টাকাও অনিয়মিত হয়ে গেল স্বাভাবিক কারণেই। বাধ্য হয়েই গাড়িটা ওর থেকে ফেরৎ চেয়ে নিয়ে আর একজন দোস্ত ‘মাজহা’ কে চালাতে দিল ‘নেশতি’। প্রথম ক’দিন ঠিকঠাক চলল বটে কিন্তু তারপর একই ঘটনার আর এক বেআব্রু প্রকাশ ঘটে যায়। একদিন টাকা দিতে এসে রাত করে মাতাল হয়ে ফেরে ‘মাজহা’। টাকা দেবার অছিলায় কব্জা করতে চায় ‘ নেশতি’ র দেহটাকে।
এরপর সাত আট দিন গাড়ি আর বের হয়না।
‘ নেশতি’ টের পায় তাকে ঘিরে গুঞ্জন উঠছে মহল্লায়। সবার লোভী দৃষ্টি ঘুরপাক খায় তার রক্ত মাংসের শরীরটার ওপর ক্লিন্ন মাছির মত।
সে অনেক ভাবে। একাকিত্ব আর অনোন্যপায় অবস্থা তাকে সাহস যোগায়। ‘নেশতি’ ঠিক করে এবার সেই গাড়ি চালাবে। হ্যাঁ, সেই আবু’র প্রিয় চিন্নী’র ভার নেবে। মাঝেমধ্যে আবুর সাথে বেড়াতে গিয়ে কখনো সখনো সেও টাঙ্গা চালাতো। এবার সে বিদ্যে কাজে লাগবে।
নিজের হাতে মেজে ঝকঝকে পেতলের সাজ পড়ানো টাঙ্গাটা নিয়ে যেদিন ‘নেশতি’ এসে বাজারের স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল ঠিক এক শাহজাদীর মত, সবাই সেদিন হাঁ করে দেখতে লাগল। ‘মেয়েছেলে’ হয়ে সে যে টাঙ্গা চালাবে এ যেন ভাবতেই পারেনি কেউ এতদিন।
প্রথমে প্রথম নিজেরও অসুবিধা হত বৈকি। সকাল সাতটা থেকে দুপুর বারোটা আবার তারপর দুটো থেকে ছ’টা রোজই সে টাঙ্গা চালাতে লাগল। রোজকারটাও মন্দ হত না শুধু কখনো কখনো পিছনে বসা যাত্রীদের ছুঁড়ে দেওয়া টুকরো অভব্য কথাগুলো শুনে গা জ্বলত ঠিকই তবে একটু একটু করে তাও মানিয়ে নিতে শিখল। এমনকি অন্য কোচম্যানরাও সুযোগ পেলে যে অশ্লীল ইঙ্গিতটা দিতেও ছাড়েনা তাকে সেটারও জবাব দিল সে শক্ত হাতে তার টাঙ্গাটাকে নিয়ে রোজ পথে নেমে। ‘নেশতি’ তার টাঙ্গা চালাতে চালাতে টের পায় আবু যেন তার পাশেই হাসিমুখে বসে আছে পুরোসময়টা আর ফিরদৌস ঈত্বরের গন্ধটা ঢেকে আছে ‘নেশতি’কে সবকিছুর থেকে আড়াল করে।
মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের বড়বাবু অপাঙ্গে তার যৌবন ভরন্ত শরীরটা আগে আপাদমস্তক মেপে নেয়। তারপর পিচিক্ করে পানের পিকটা ডাস্টবিনে ফেলে জিজ্ঞাসা করে
‘ এ টাঙ্গা তোমার? লাইসেন্স কৈ দেখাও ?’
নেশতি বলে পুরো ঘটনাটা। আবুর কথাও বলে সে।
‘ মেয়েছেলেকে টাঙ্গা চালানোর লাইসেন্স দেওয়া হয়না!’
বিশ্রী চোখের ইঙ্গিতে লোকটা উত্তর দেয়।
অফিসে সবার চোখের দৃষ্টিতে বেআব্রু হতে হতে নেশতি’র গা গুলিয়ে ওঠে। তবুও কিন্তু সাহস করে গলায় জোর এনে সে বলে –
‘ বাবু! মেয়েরা তো অনেক কাম কাজই তো করে, বাজারে মোট বয়, মজদুরি করে, খিদমত খাটে, এমনকি খাদানে নেমে কয়লাও তোলে…..আর টাঙ্গা চালালেই দোষ? দয়া করুন সাহাব! টাঙ্গা না চালালে খাব কি? চিন্নীর খোরাকি এ বাজারে আসবে কোত্থেকে!’
পান খাওয়া লালচে দাঁত বের করে মিটিমিটি হেসে মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের বড়বাবুটি এবার একটা অশ্লীল হাসি হেসে বলে –
‘ এ্যাই তো ঠিক বুঝেছ! বাজারেই…হ্যাঁ বাজারের কোণায় একটা ঘর নিয়ে…হেঁ….হেঁ..রোজকার করনা কেন! এর চেয়ে বেশীই কামাবে….কম নয়! ‘
আবু’ র টাঙ্গার লাইসেন্সটা ছাপ মেরে বাতিল করে দেয় মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের বড়বাবু।
নেশতি আস্তে আস্তে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরে কয়েকজন দালাল ঘুরছিল। টাঙ্গা আর চিন্নীকে সস্তাদরেই কিনে নিয়ে ওর হাতে কয়েকটা নোট গুঁজে দেয় সাথে সাথেই।
ভরদুপুরবেলায় শুনশান কবরস্থানটায় এসে নেশতি একবার আবু’ র কবরের কাছে এসে বসে। বাইরে তখন তীব্র রোদে দশদিগন্ত জ্বলছে দোজখের আগুনে। নেশতির ঠোঁট দুটো কেবল নড়ে আর বিড়বিড় করে বলে –
তোমার নেশতি’র আজ এন্তেকাল হয়েছে গো..ওই মিউনিসিপ্যালিটি অফিস থেকে ফেরবার পর…এন্তেকাল হয়েছে!
পরদিন সে মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে দরখাস্ত করে। এবারে আর তাকে খালি হাতে ফিরতে হয়নি। বাজারের কোণের মহল্লায় একটা ঘর মিলেছে তার ব্যবসা করার জন্য, শরীর বিক্রী করার লাইসেন্স হিসাবে।
(সাদাত হাসান মান্টোর ছোট গল্প ” Licence ” – এর অনুবাদ )
0 Comments