মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথায় দক্ষিণ দিনাজপুর (শেষ পর্ব)
রঘুনাথের মেলাঃ
রঘুনাথের মেলা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার ‘মানদা’তে অনুষ্ঠিত হয়। পরে জনৈক সেবাইত সেখান থেকে মাটি নিয়ে এসে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট এর উত্তর চকভবানীতে পুজো শুরু করেন। বর্তমানে মন্দিরটি যেখানে অবস্থিত সেটি রঘুনাথপুর ও ডাকরা মৌজার অন্তর্গত। বছরে একবার রামনবমী উপলক্ষে মন্দিরে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। ভোরবেলা থেকে ভক্তরা আত্রেয়ী নদীতে স্নান করে পুজো দেন। এই পুজো সম্পর্কে নানা কিংবদন্তি আছে। অনেকে বলেন যে এখানে দেবতার কাছে মানত করে অনেকের মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। পুজোর দিন সকাল থেকে অনেক অন্ধ লোককে মন্দিরে জমায়েত হতে দেখা যায়। অনেকে ‘ধরনা’ দিয়ে ঠাকুরের কাছে মানত করে। স্থানীয়রা বলেন অনেকেই এভাবে তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছেন।
বাসন্তী পুজোর নবমী তিথিতে রামনবমী পুজো হয়। রামচন্দ্র রাবণ বধের আশীর্বাদ লাভের উদ্দেশ্যে অকালে দশভুজার আহ্বান জানিয়েছিলেন, শরৎকালে। মায়ের পায়ে অঞ্জলি দেবেন বলে ১০৮ টি নীলপদ্ম জোগাড় করেছিলেন তিনি। ১০৭ টি পদ্ম অঞ্জলি দেওয়ার পর রামচন্দ্র দেখেন, আর পদ্ম নেই সেখানে। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় সব লোক তাকে ‘কমলাক্ষ’ বলে। তখন তীক্ষ্ণ অস্ত্রে নিজের একটি চোখ উপড়ে ফেলে মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিতে উদ্যোগী হন তিনি। এমন সময় দেবী দশভুজা আবির্ভূতা হন রামচন্দ্রের সম্মুখে। দেবী মহামায়া বলেন, তোমার সত্যনিষ্ঠা পরীক্ষা করবার জন্যই আমি তোমার পদ্ম হরণ করেছিলাম। দেবী সেই নীল পদ্ম ফিরিয়ে দেন রামচন্দ্রকে আর বর দেন রাবণ বধের। সেজন্য এখনো অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন যে শুদ্ধমনে যদি ঠাকুরকে ডাকা হয় তাহলে অন্ধত্ব নিশ্চয়ই ঘুচবে।
পৌরাণিক কাহিনী অনেক সময় মৌখিক ইতিহাস ও পুরা কথায় মিশে যায় এবং ইতিহাসের উপজীব্য হয়ে ওঠে। আর সেই ইতিহাস আমাদের জীবন সংস্কৃতিতে মিশে সুগন্ধ প্রদান করে।
বুড়াপীরঃ
গঙ্গারামপুর থানার নারায়ণ পুর মৌজার পিরপাল গ্রামে রয়েছে বুড়াপীর এর সমাধি। এখন প্রশ্ন এই বুড়াপীর কে? এই প্রশ্নের দুটো অভিমুখ। এক – অনেকে বলেন এই মাজার পীর বাহাউদ্দিনের। দুই – এই মাজার বুড়াপীর ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির। জনশ্রুতি দেবকোটে বখতিয়ার মারা গেলে তাকে পিরপাল গ্রামে সমাধিস্থ করা হয়। প্রতিবছর পীরের এই মাজারে বিশেষ পুজো হয়। অনেকে মানত করে। পীরের মাজারে চাদর চড়ায়, মাটির ঘোড়া মানত করে, সিন্নি উৎসর্গ করে। এখানে একটা প্রথা আছে যেহেতু বুড়াপীর শুয়ে আছে সেজন্য এখানকার অনেকে এখনও খাট বা চকিতে শোয় না, মাটিতে ঘুমায়। একজন দুর্ধর্ষ তুর্কী বীর বখতিয়ার কিভাবে পীর-এ রূপান্তরিত হলেন সেটা অনেককেই ভাবায়।
ব্রহ্মপুর দীঘিঃ
কুমারগঞ্জ থানার গোপালগঞ্জে অবস্থিত ব্রহ্মপুর দীঘি। ব্রহ্ম হলেন বিশ্বআত্মা। বৈদিক সাহিত্যে ব্রহ্ম অর্থ কোথাও ব্রাহ্মণ কোথাও ব্রাহ্মণত্ব। আবার বেদবাক্য অর্থে ব্রহ্ম। কথিত যে ব্রহ্ম নামে এক মহাবীর গভীর জঙ্গলাকীর্ণ এই অঞ্চলে বসবাস করতেন। অন্ধকারাচ্ছন্ন এই গ্রামে তিনি বিভিন্ন ধর্মের মানুষজনকে এনে বসতি গড়ে দেন। কিন্তু ওই গ্রামে জল কষ্ট ছিল। জলকষ্টে গ্রামে হাহাকার ওঠে। গ্রামবাসীরা সমবেত হয়ে মহাবীর ব্রহ্মের কাছে জলকষ্ট নিবারনের জন্য প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মের কৃপায় মহাবীর জলকষ্ট নিবারণের জন্য একটি দীঘি খনন করে গ্রামবাসীদের উৎসর্গ করেন। গ্রামবাসীরা মহাবীর ব্রহ্মকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে জনপদের নামকরণ করে ব্রহ্মপুর। দীঘির নাম হয় ব্রহ্মপুর দীঘি। প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার দীঘি গুলোর খননের পেছনে নানা মৌখিক ইতিহাসের গল্প আছে।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা হল মৌখিক ইতিহাস, পুরাকথা, প্রত্নকীর্তি ও পুরাতত্ত্বের স্বর্গভূমি। মাটির নিচে প্রোথিত আছে ইতিহাসের নানা পুরাগল্প, পুরাকথা ও কিংবদন্তি। ক্ষেত্রসমীক্ষায় আজও খুঁজে পাওয়া যায় ইতিহাসের ইতিকথা। কোদালের কোপে মাটির প্রোথিত ইতিহাস আজও জীবন্ত হয়ে ওঠে। দীঘি সংস্কার বা পুকুর খননে পুরনো ইতিহাস কথা বলে। কোন নির্মাণের ভিত খুঁড়তে গিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস রঙিন পাখনা মেলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ইতিহাস এই ভাবেই বয়ে চলেছে।
তথ্যসূত্রঃ
১. প্রত্নতীর্থ পরিক্রমা – কৃষ্ণগবিন্দ গোস্বামী
২. আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা ও গ্রন্থপঞ্জি – যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী
৩. লোকসংস্কৃতি লৌকিক দেবতা – ধনঞ্জয় রায়
৪. বাংলার লৌকিক দেবতা – গোপেন্দ্র কৃষ্ণ বসু
৫. আর্থ-সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গে দক্ষিণ দিনাজপুর – সমিত ঘোষ
৬. বাঙালির ইতিহাস – নীহাররঞ্জন রায়
৭. দক্ষিণ দিনাজপুরের পুরাকীর্তি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাস – সমিত ঘোষ
৮. পশ্চিম দিনাজপুর মধুপর্ণী বিশেষ সংখ্যা, ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ
৯. বাংলার লোকসংস্কৃতি – আশুতোষ ভট্টাচার্য
১০. স্বদেশচর্চালোক, বাংলার দীঘি জলাশয়
১১. উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও পুরাকীর্তি, প্রথম খন্ড – সমিত ঘোষ
১২. আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, আজকাল, উত্তরবঙ্গ সংবাদ প্রাসঙ্গিক সংখ্যা
১৩. দীর্ঘ ২০ বছর ধরে দক্ষিণ দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষেত্রসমীক্ষা
১৪. Eastern Bengal District Gazetteers, Dinajpur – F.W. Strong
১৫. West Bengal District Gazetteers, West Dinajpur – J.C. Sengupta
১৬. ব্যক্তি ঋণঃ
(ক) প্রফেসর আনন্দ গোপাল ঘোষ, অবসৃত অধ্যাপক, বঙ্গরত্ন, ইতিহাস বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।
(খ) মন্দিরা ভট্টাচার্য, অবসৃত অধ্যাপিকা, ইতিহাস বিভাগ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।
*পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
0 Comments