মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথায় দক্ষিণ দিনাজপুর (পর্ব – ৩)

ড. সমিত ঘোষ on

মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথার মেলবন্ধন দক্ষিণ দিনাজপুরের ইতিহাসকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথার আঙ্গিকে জেলার আঞ্চলিক ইতিহাসও বলিষ্ঠ রূপ নিয়েছে। আজকের মৌখিক গল্পগাথা ও পুরাকথায় রয়েছে —

তপন দীঘিঃ পাল-সেন যুগের স্মৃতি ও শ্রুতি নিয়ে আজও বহমান তপন দীঘি। ইংরেজ সাহেবদের বর্ণনায় এই দীঘির উল্লেখ আছে। তপন দীঘিকে অনেকে তর্পণ দীঘিও বলে। সেন রাজা লক্ষণ সেনের তর্পণঘাট লিপি তপন দীঘির পাড়েই পাওয়া গেছে। এই দীঘিকে ঘিরে নানা জনশ্রুতি, কিংবদন্তি আছে। যেমন- (১) এক সময় তপন দীঘির পার্শ্ববর্তী অঞ্চল প্রভাবশালী পরশুরামের শাসনাধীন ছিল। পরশুরাম ছিলেন শিব ভক্ত ব্রাহ্মণ। মহাদেব তাকে পরশু (কুঠার) দান করেছিলেন। এদিকে চিত্ররথ নামে জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হলে পিতৃ (জন্মদগ্নি) আদেশে পরশুরাম নিজ মাতাকে হত্যা করেন। পরে অনুতাপে তর্পণ দীঘির পাড়ে তপস্যা করতে থাকেন। (২) অসুররাজ বাণ নামে একজন রাজা তপন দীঘিতে তর্পণ করতেন। রাজা বাণ এই দীঘির তীরে প্রার্থনার দ্বারা শিবকে সন্তুষ্ট করতে ৯৯৯ টি হাত কেটে দেন। পরবর্তীকালে বাণ রাজার বিরুদ্ধে প্রজারা বিদ্রোহ করে তাকে পরাজিত ও নিহত করে। নিহত সেনাদের আঙ্গুল কেটে তপন থানার করদহ নামক স্থানে দাহ করা হয়। একথাও শোনা যায় যে বাণ রাজা রানীর নির্দেশে এই দীঘি খনন করেন।

tapan dighi
তপন দীঘি

যাইহোক উনিশ শতকের প্রথম দিকে বুকানন হ্যামিল্টন তপন দীঘির মাপযোগ করেন। লক্ষণ সেনের লিপি থেকে জানা যায় যে দীঘিটি ১১৮১ খ্রিস্টাব্দে খনন করা হয়। দীঘির পাড় জুড়ে শুধুই ইতিহাসের গন্ধ।

বাণগড়ঃ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরাক্ষেত্র হলো গঙ্গারামপুর থানার রাজিবপুর মৌজার বাণগড়। পৌরাণিক কাহিনী থেকে শুরু করে জনশ্রুতি, লোকশ্রুতি কিংবদন্তি, মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকাহিনীর বিচিত্র সমাহার বাণগড় ঘিরে। বাণগড়ের ইতিহাস সুপ্রাচীন। বাণগড়, বাণরাজা, ঊষাহরণ, ঊষাতটি, কালদীঘি, ধলদীঘি নিয়ে মৌখিক ইতিহাসের রত্নভান্ডার রয়েছে সমগ্র বাণগড় জুড়ে।

bangarh watch tower
বাণগড়ের ওয়াচ টওার

জনশ্রুতি, লোকশ্রুতি ও পুরাকথার আকর ভূমি বাণগড়। বাণগড় নামের সঙ্গে জুড়ে আছে রামগড়, কোটিবর্ষ, বানপুর, শোণিতপুর, উমা বন, ঊষা বন, পুন্ড্রবর্ধন, বরেন্দ্রভূমি, দেবকোট বা দেবীকোট তথা আরও অনেক নাম। সব নামের মধ্যে রয়েছে ইতিহাসের মিষ্টি গন্ধ। বলিরাজের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বাণ এই অঞ্চল শাসন করতেন। পৌরাণিক রামগড়ের সঙ্গে অসুররাজ বাণের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত যে একসময় কোটিবর্ষে ভেত্রবর্মণ নামক একজন শাসককে পাওয়া যায়। যাইহোক বাণের নামে রাজ্যের নাম হয় বাণগড়।

ঊষা/ ঊষাহরণ/ ঊষাতিটিঃ বাণ রাজার কন্যা ঊষা শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের প্রতি প্রেমাসক্ত হন। শেষে বান রাজার মেয়ে ঊষার সঙ্গে অনিরুদ্ধের বিবাহ সম্পন্ন হয়। অনিরুদ্ধ ঊষাকে হরণ করে নিয়ে গিয়ে বিবাহ করেন। বর্তমানে একটি সড়ক রয়েছে যার নাম ঊষা হরণ সড়ক। পুনর্ভবা নদীর বিপরীতে একটি জমিতে একটি উঁচু স্থান আছে। অনেকে একে উষাতিটি বলে অর্থাৎ ঊষার বাড়ি। বাণগড়ে চারটি গ্রানাইটের স্তম্ভ রয়েছে এগুলিকে অনেকে ঊষা-অনিরুদ্ধ -এর বিয়ের ছায়া মন্ডপ বলে। ভিন্নমতে এটি একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। এ. এস. আই. এর উদ্যোগে অধ্যাপক কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামীর নেতৃত্বে যখন প্রত্নখনন (১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে) শুরু হয় তখন নানা পুরা বস্তু উঠে আসে। বাণগড়ের একটি ঢিবি থেকে খননের সময় কিছু মাটির থালা, ভাঙ্গা গ্লাস উঠেছিল, একজন বয়োজ্যৈষ্ঠ মহিলা বলেছিলেন ঊষা-অনিরুদ্ধ -এর বিয়েতে প্রচুর লোকজন নিমন্ত্রন খেয়েছিলেন।ঐসব থালা, গ্লাস তারই স্বাক্ষ্য বহন করে। এই সব মৌখিক কথা কখনো কখনো ইতিহাসের আলোচনার উপজীব্য হয়ে ওঠে।

bangarh pillar
বাণগড়ের চারটি গ্রানাইটের স্তম্ভ

কালদীঘিঃ বাণগড় সংলগ্ন অঞ্চলে দুটো দীঘি আছে – কালদীঘি ও ধলদীঘি। লোকশ্রুতি যে বাণরাজার সহধর্মিনী কালোরানী। তার নাম থেকেই দীঘির নাম কালদীঘি। দেবকুল ও অসুরকুলের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। বাণরাজা অনিরুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ও যুদ্ধে পরাজিত হন। এই সময় বাণের পুত্র সম্বর নগরবাসীকে জলপথে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। কালোরানী শেষবারের মতন রাজপ্রাসাদের দিকে তাকিয়ে ময়ূরপঙ্খীতে ওঠেন। তখন শত্রুরা চারিদিকে ঘিরে ফেলেছে। কালোরানী হুকুম দিলেন ময়ূরপঙ্খীর পাটাতন খুলে দিতে। মাঝিরা পাটাতনের কাট কাঠ খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজকীয় নৌযানের ভিতর হুঁ হুঁ করে জল ঢুকতে থাকে। ধীরে ধীরে নৌকা জলের মধ্যে ডুবে যায়। এইভাবে কালোরানী দীঘিতে আত্মঘাতী হন।


ক্রমশ…

*দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


ড. সমিত ঘোষ

শিক্ষক গবেষক সমিত ঘােষ প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে ইতিহাস চর্চায় রত। ইতিহাসের সঙ্গেই তাঁর দিনযাপন। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে তিনি নানা প্রবন্ধ লিখেছেন। ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল কয়েকটি জার্নালেও তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখির জন্য তিনি পেয়েছেন বেশ কিছু সম্মাননা। ২০১৫ সালে মালদা থেকে সংবেদন কর্তৃক সম্মানিত হয়েছেন ‘বিমলা বর্মন স্মৃতি স্মারক' পুরস্কারে। ২০১৮ সালে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রেস ক্লাবের তরফে পেয়েছেন রাধামােহন মােহান্ত স্মৃতি স্মারক’ সম্মাননা। মুক্তধারা পত্রিকা থেকে পেয়েছেন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সেরা গবেষক ২০১৯'সম্মাননা। তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল "Transformation of the Rural Society of North Bengal from the Permanent Settlement to the Operation Barga with Special Reference to Malda and West Dinajpur (1793-1978) '-এ পর্যন্ত লেখকের পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে— ‘আর্থ-সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গে দক্ষিণ দিনাজপুর (২০০৬), ‘উত্তরবঙ্গের ইতিহাস (২০০৯), “দিনাজপুরের বিপ্লবী আন্দোলন’ (২০১২), ‘দক্ষিণ দিনাজপুরের পুরাকীর্তি,সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাস’ (২০১৪), 'উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও পুরাকীর্তি' (২০১৯)। 'দক্ষিণ দিনাজপুরের পুরাকীর্তি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাস' গ্রন্থটি ২০১৭ সালে টাঙ্গন লােকমঞ্চ পুরষ্কারে ভূষিত হয়। লেখক দক্ষিণ দিনাজপুর হেরিটেজ সােসাইটির সম্পাদক।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।