মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথায় দক্ষিণ দিনাজপুর (পর্ব – ৪)
পুরাকথা, কল্পকথা ও মৌখিক ইতিহাসের গর্ভভূমি দক্ষিণ দিনাজপুর। কিংবদন্তি, লোকশ্রুতি, জনশ্রুতি অনেক সময় জীবনসংস্কৃতির পথেয় হয়েছে। স্মৃতি ও শ্রুতির মেলবন্ধনে তৈরী হয়েছে ইতিহাসের নানা গল্পগাঁথা। ইতিহাসের উজানে পারি দিয়ে দেখা যাক মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথা আমাদের জীবনকে কিভাবে আবর্তিত করে রেখেছে।
ধল দীঘিঃ গৌড় বাংলার অত্যাচারী শাসক কায়কাউস একদিন সকালে নগর ভ্রমনে বেরিয়ে দেবকোটের সবচেয়ে বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী অনুরুদ্ধের কন্যা সুধন্যাকে দেখতে পান। সুলতান গুপ্তচর পাঠিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। সুধন্যা আতঙ্কিত হয়ে পীর আতাউল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু শেষে বিষপান করে সুধন্যা আত্মহত্যা করেন। কায়কাউস আতাউল্লার প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করতে পারেননি। এই ঘটনার পর সুলতান সম্পূর্ণ বদলে যান এবং তিনি একটি দীঘি খনন করেন, সেটি ধলদীঘি নামে পরিচিত। কখনো কখনো মিথ, কিংবদন্তি, জনশ্রুতি ইতিহাসের সঙ্গে মিশে ইতিহাস রচনার উপাদান হয়ে ওঠে।
দেবগ্রামঃ এটি কুমারগঞ্জ থানার অন্তর্গত। দেবগ্রাম অর্থাৎ দেবতার গ্রাম, যেখানে দেবদেবীর অধিষ্ঠান। এখানে ১০৭টি মন্দিরের কথা শোনা যায়। স্থানীয় জনশ্রুতি যদি ১০৮ টি মন্দির থাকতো তবে এটি কাশীধাম বলে পরিচিত হত। মোহনা, দেবগ্রাম, দাউদপুরে একাধিক মন্দির আছে। ভগ্নপ্রায় মন্দির গুলোতে কিছু টেরাকোটার কাজ ও রয়েছে। এই অঞ্চল থেকে বেশকিছু গৌরীপটও পাওয়া গেছে। দেউলময় দেবগ্রামে কিংবদন্তি ও ইতিহাস হাতছানি দেয়।
শমীবৃক্ষঃ হরিরামপুরের বৈরাট্টাতে রয়েছে সুপ্রাচীন শমীবৃক্ষ। জনশ্রুতি, পান্ডবরা বিরাট নগরে (বর্তমানে বৈরাট্টা) প্রবেশের সময় তাদের অস্ত্রশস্ত্র শমীবৃক্ষে লুকিয়ে রেখেছিল। মহাভারতে উল্লেখ আছে –
” অর্জ্জুন বলেন, এই দেখ শমীদ্রুম।
ভয়ঙ্কর শাখা তার পরশিছে ব্যোম।।
আরহিতে না পারিবে অন্য কোন জন।
ইহাতে রাখি যে অস্ত্র, যদি লয় মন।।”
তবে এই শমীবৃক্ষকে নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। এর বয়সও নিয়ে বিতর্ক। এটা কি প্রজাতির গাছ তা নিয়েও বিতর্ক। অনেকে বলেন তমাল গাছ। অনেকে বলেন মেদিনীপুর অঞ্চলে এই গাছ দেখা যায়। কিন্তু জনশ্রুতি, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তি ও মৌখিক ইতিহাসে আজও এটি শমীবৃক্ষ।
করঞ্জীঃ শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্রে যখন কংসরাজের দেহ খণ্ডিত হয় তখন তার একটি অংশ কুশমন্ডি থানার করঞ্জী গ্রামে পড়েছিল। করঞ্জীতে রয়েছে অজস্র পুরাকীর্তি। অনেকে একে পাল রাজা ধর্মপাল এর রাজধানী করঞ্জা বলে অনুমান করেন। এখানে ত্রয়োদশ শতকের একটি ত্রি বিক্রমের মূর্তি পাওয়া গেছে। প্রতিবছর মাঘ মাসের পূর্ণিমাতে এখানে কংসব্রত উৎসব পালিত হয়। এখানে লোকশ্রুতি ও জীবনসংস্কৃতি মিলে মিশে গেছে।
মহীপাল দীঘিঃ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুশমন্ডি থানার অন্তর্গত মহীপাল দীঘি পাল রাজা মহীপালের স্মৃতিবিজরিত। লোকশ্রুতি, বরেন্দ্র বিজয়ের পর রাজা মহীপাল স্থির করেন যে তিনি প্রজাদের মঙ্গলের জন্য একটি দীঘি খনন করবেন। মহারাজ তার মা’কে প্রস্তাব দেন যে তিনি একনাগাড়ে যতদূর হেঁটে যাবেন ততদূর পর্যন্ত দীঘি খনন করা হবে। রাজমাতা হাঁটতে শুরু করলেন কিছুদূর যাওয়ার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁর পুত্র কয়েক ফোঁটা সিন্দুর জল মায়ের পায়ে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, মা তোমার পায়ে রক্ত লেগে আছে। রাজমাতা হাঁটা বন্ধ করে ওখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। দীঘির শেষ সীমানা চিহ্নিত হয়ে গেল। এরকম কত গল্পগাথা ইতিহাসকে জড়িয়ে আছে। এভাবেই মৌখিক গল্পগাথা ইতিহাসে ঢুকে জীবনসংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে।
*তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
0 Comments