মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথায় দক্ষিণ দিনাজপুর (পর্ব – ২)
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার আনাচে-কানাচে কান পাতলে শোনা যায় মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথার মেলবন্ধন। জেলার আটটি থানাই কম বেশি মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথার সাক্ষ্য বহন করছে। আসলে সমগ্র দিনাজপুর জেলাই শ্রুতি, কিংবদন্তি, জনশ্রুতি, মৌখিক ইতিহাস, পুরাকথা ও কল্পকথার ভূমি। সেই ভূমিতে এখনও শোনা যায় নালেখা ইতিহাসের নানা অজানা, অচেনা কথা।
আত্রেয়ী নদী: দক্ষিণ দিনাজপুর তথা জেলা শহর বালুরঘাটের ‘ লাইফ লাইন ‘ হলো আত্রেয়ী নদী। কথিত মহাভারতের যুগে আত্রেয় নামে এক ঋষির নাম অনুসারে এই নদীর নাম হয়েছে ‘ আত্রেয়ী ‘। বেদব্যাসের ব্রহ্মসূত্রে এই ঋষির নাম পাওয়া যায়।
‘ স্বামিন: ফলশ্রুতে ইতি আত্রেয়: ‘ (৩/৪/৪৪)। এছাড়া দেবী পূরাণে আত্রেয়ীকে পুণ্যতোয়া নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একসময় জেলার বাউল এর লোককবি খেরু ঘোষের কাছে ছিল আত্রেয়ীর পাঁচালী। এটি অত্যন্ত মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য। আত্রেয়ীর বহমান জলের মতো আজও কিংবদন্তি, লোককথা লোকমুখে ঘোরে। তবে আত্রেয়ীর ধারক ও বাহক প্রতিবেশী বাংলাদেশ।
বোল্লা: জনৈক জমিদার বল্লভ মুখোপাধ্যায়ের নামানুসারে গ্রামের নাম বল্লভ থেকে বোল্লায় পরিণত হয় ( বল্লভ>বোল্লা)। বোল্লা স্থানটি পরিচিত বোল্লা কালীর পুজোর জন্য। জনশ্রুতি আছে যে জমিদার বল্লভ মুখোপাধ্যায়ের এক বংশধর জমিদারী কিস্তি শোধ করতে না পারায় জমিদারী উঠে যায় এবং তার জেল হয়। কারাগারে দেবী কালীর স্বপ্নে সেই জমিদার মুক্তিলাভ করেন। আর একটি লোক শ্রুতি শতবর্ষ পূর্বে তৎকালীন জমিদার মুরারী মোহন চৌধুরীর সঙ্গে কোম্পানির বিরোধ শুরু হয়। গ্রামবাসীরাও এই বিরোধে জড়িয়ে যায়। পরে দিনাজপুরের কালেক্টরও এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। রক্ষা কালী মা বোল্লার আশীর্বাদে জমিদার মামলা জিতে যান। ওই বছরই রাস পূর্ণিমার দিন শুক্রবার বোল্লা কালীর পুজো শুরু হয়। কিভাবে একটি ধর্মীয় ভাবনার সাথে মিথ, লিজেন্ড জড়িয়ে দেবীর মাহাত্ম্য ঐতিহ্যের মাধ্যমে জনমানসে প্রসারিত তা আজও বিস্মিত করে।
ফুলঘড়া: বালুরঘাটের বোয়ালদার অঞ্চলের অধীনে ফুলঘড়া গ্রাম। এই গ্রামের এক দেবীকে নিয়ে নানা কাহিনী, কিংবদন্তি। ফুলঘড়া গ্রামের জাগ্রত দেবী হলেন সর্পবাহিনী চতুর্ভূজা পদ্মা। দূর্গা পুজোর সময় দেবীর পুজো হয়। লোক বিশ্বাস দেবী মা গ্রামকে রক্ষা করেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী একবার ফুলঘড়া গ্রামে আগুন লেগে সবকিছু বিনষ্ট হয়ে যায়, গ্রামবাসীরা নিঃস্ব হয়ে যায়। তখন সকলে মিলে সর্পবাহিনী চতুর্ভূজা পদ্মার কাছে ধর্না দেয়। দেবীর নির্দেশে গ্রামবাসীরা ঘড়া ভর্তি মোহর পায়। গ্রামবাসীদের আবার স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। মৌখিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করে, এক দেবী মা’র আবর্তে একটি গ্রামের জীবন সংস্কৃতি কিভাবে প্রবাহিত হয়।
পতিরামের বিদ্যেশ্বরী দেবী: পতিরাম এক সময় থানা ছিল। সেই থানা বালুরঘাটে স্থানান্তরিত হয় ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। পতিরামের বিদ্যেশ্বরী কি বিদ্যার দেবী সরস্বতী ? এখানেই কি বাল্মীকি রামায়ণ লিখেছিলেন? দেবী সরস্বতী ও কালিদাসের কি সম্পর্ক? বেদের উৎপত্তি স্থল কি এই ভূমি? দেবকোট- বৃহদ্বটু কি এক সূত্রে বাঁধা? এই রকম নানা জটিল প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রয়াত গবেষক দেবব্রত মালাকার। জেলা জুড়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায় এবং সেটা স্বাভাবিকও।
যাইহোক, প্রাচীনকালে বৈদিক ব্রাহ্মণকুল যে নদীর তীরে বসবাস করত সেখানেই ছিল স্বরস্বতীর বাসস্থান। এটা একটা পুরনো জনশ্রুতি। দেবকোট ই নাকি একান্নতম শক্তিপীঠ। কালিদাস – বিদ্যেশ্বরী – শক্তিপীঠ সব মিলে মিশে গেছে। কিন্তু সেই মিলমিশ কি গবেষকের মস্তিষ্কপ্রসূত নাকি মৌখিক ইতিহাসেরই একটা অংশ তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে।
*প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
0 Comments