মৌখিক ইতিহাস ও পুরাকথায় দক্ষিণ দিনাজপুর (পর্ব – ১)
ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে Historical Dates খুব গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে তা না পাওয়া গেলে সমস্যা হয় ঠিকই কিন্তু তা বলে সেই সময়ের ইতিহাসকে উপেক্ষা করা যায়না। ইউরোপীয় পণ্ডিতরা মনে করেন, আফ্রিকা দীর্ঘ সময় একটা অন্ধকারচ্ছন্ন অঞ্চল (Dark Continent ) ছিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত আফ্রিকার কোন লিখিত ইতিহাস ছিলনা। তবে এটাও মনে রাখতে হবে Afro-Asian Village Communities হল বিশেষত First Generation Learners.
তবে বর্তমান আফ্রিকান দেশগুলো যেমন কেনিয়া, নামিবিয়া, জিম্বাবয়ে, সাউথ আফ্রিকা সহ অন্যান্য দেশ গুলো বিভিন্ন মৌখিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে, যেমন Folklore, Rhymes, Melodies, Myths ইত্যাদি , যা দিয়ে তারা তাদের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনছে এবং পুরনো ইতিহাস পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
প্রকৃত পক্ষে Oral Histoy বা মৌখিক ইতিহাস ততটাই পুরনো ঠিক ইতিহাস যতটা । Jan Vasina তাঁর – ‘Classical Oral Tradition: A Study in Historical Methodology (1965)’ –এতে তিনি আফ্রিকার
Oral Tradition কে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন – Formulas, Names, Poetry, Stories and Commentaries. ‘American Oral History Association’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। Allan Navins আমেরিকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষের স্মৃতি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। পরবর্তীতে Folklore, Women’s History, Black History নিয়ে কাজ শুরু হয়। এছাড়া আফ্রিকান স্টাডিস এর কেন্দ্র হয় Oxford, Cambridge, Capetown সহ অন্যান্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয় যারা আফ্রিকার ইতিহাস পুনরুদ্ধারে ব্রতী হয়।
যাইহোক দুশো বছর ধরে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা চলছে। বাংলার প্রত্যেকটি অঞ্চলের ইতিহাস আছে। স্থাপত্য, ভাস্কর্য, পুরাকীর্তি, প্রত্নতত্ত্ব, ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য স্থান সবকিছুকে নিয়েই ইতিহাস গড়ে ওঠে। ইতিহাসবিদ মমতাজুর রহমান বলেছেন, “History is a movement of time”.
ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রামান্য গ্রন্থগুলি হল কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’( কাশ্মীরের ইতিহাস ), সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’, মিনাজ উদ্দিন সিরাজের ‘তাবাকৎ-ই-নাসিরি’, মির্জা নাথনের ‘বাহারিস্থান-ই-গায়েরী’ –তে স্থানীয় ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। এছাড়াও ‘বাঙালীর ইতিহাস’, ‘ বাখর গঞ্জের ইতিহাস’, ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
“Regional History are the backbone of National History.”
লোকসঙ্গীত, লোকনাটক, পাঁচালী, লোককথা, লোক গাঁথা, সবকিছুরই পরিপূর্ণ রূপ আঞ্চলিক ইতিহাস। অক্ষয় কুমার মৈত্র, রজনীকান্ত চক্রবর্তী, নিখিল নাথ রায়, রনজিৎ গুহ, দীপেশ চক্রবর্তী, চারুচন্দ্র সান্যাল প্রমুখ আরও অনেক নাম আছে যারা আঞ্চলিক ইতিহাস্ কে দীর্ঘ দিন ধরে লালন পালন করেছেন এবং এখনও করছেন। নিম্নবর্গের ইতিহাস , খেলাধুলার ইতিহাস, খাদ্যাভাসের ইতিহাস, পরিবেশের ইতিহাস, বনাঞ্চলের ইতিহাস – এই নতুন বিষয় গুলো বর্তমানে উঠে আসছে এবং ইতিহাস চর্চার এই ধারা গুলো ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে।
দুশো বছর ধরে আঞ্চলিক ইতিহাসের বিরাট তথ্য ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে। কোন অঞ্চলের ইতিহাস রচনার অন্যতম সমস্যা হল মৌলিক তথ্য সংগ্রহের অপ্রতুলতা । পেশাদার ঐতিহাসিকরা সেভাবে আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় আগ্রহী হননি । যেটুকু ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে সেটুকু ব্যাক্তিগত উদ্যোগে ও অধ্যাবসায়ে। ব্রিটেন ও রাশিয়াতে সরকারি উদ্যোগে ও আনুকূল্যে যত গ্রন্থ রচিত হয়েছে এ দেশে সেরকম চোখে পড়েনা। কত জমিদার / জোতদার পরিবারের নথি নষ্ট হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। সরকারী নিয়ম চক্রে মফস্বলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রাজ্য কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে তালিকাভুক্ত হয়না। সুখের কথা এটাই যে ১৯৫৩ সাল থেকে A.S.I (Archaeological Survey of India) ‘Indian Archaeology – A Review’ –তে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে । এতে স্থানীয় ইতিহাস বিশেষত জমিদার পরিবারের ইতিহাস, স্থানীয় মন্দির, মসজিদ, শিলালেখ, প্রত্নক্ষেত্র , মূর্তি, মুদ্রা ইত্যাদি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার মৌখিক ইতিহাস আঞ্চলিক ইতিহাসের ভাণ্ডার কে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে। বরেন্দ্রভুমির এই সুপ্রাচীন ভূখণ্ড ইতিহাসের নানান সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
ক্রমশ…
*দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
0 Comments