দিনাজপুরের চড়ক-কাহন

কৌশিক বিশ্বাস on

২৫ শে চৈএ ‘শিবজাগরণ’ থেকে এর পালা শুরু হলেও চৈত্রের শুরু থেকেই দিনাজপুরের বিভিন্ন ‘দেল’গুলো  কাঁধে করে পাটঠাকুর নিয়ে গৃহস্থের বাটি ঘুরে ঘুরে এই জাগরণের প্রাথমিক কাজ করার পর এসে উপস্থিত হয় চৈএের শেষদিন। তবে দিনাজপুরে কোথাও শেষদিন আবার কোথাও নতুন বছরের প্রথম দিন এই চড়ক অনুস্থিত হয়। সারা বৈশাখ মাস জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় এটি সংগঠিত হতে থাকে। বৈশাখ মাসের পর এটি চলতে থাকলে একে ‘হুজুগে চড়ক’ বলে। বৌদ্ধমতের কালচক্রযানের সাথে সেই অর্থে এটির কোন সম্পর্ক নেই। মহাযানে ‘কালচক্র’ একটি স্বতন্ত্র দেবতা। আলাদা তন্ত্র আছে সেখানে। গৌড়ের নিজস্ব তন্ত্রের একটি স্বতন্ত্র ধারা আছে এই চড়কে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই “হরগৌরী” র পূজার সাথেসাথে এই চড়কের সূচনা হয়। একটি মিথ অবশ্য প্রচলিত আছে আমাদের অঞ্চলে। ঊষা ও অনিরুদ্ধের প্রেমকাহিনী নিয়ে। বাণ অন্তজ কুলের রাজা হবার ফলে কৃষ্ণ ঠিক করেছিলেন যে, ঊষা অন্তজ কুলের হবার জন্য এবং সেই অনুযায়ী বংশধারার অন্তজ যোগ থাকার কারণে বছরের একটা দিন সমগ্র অন্তজকুল মহাসমারোহে ধর্মাচরণ করতে পারবে এবং পূজা পাবার যোগ্যতা অর্জন করবে। তাই চড়কের এই একটা দিনে সমস্ত নিম্নবর্গীয় মানুষজনদের বেশি অংশগ্রহণ দেখা যায়। এমনকি পূজা ও বিধি অব্রাহ্মণ দ্বারা করানো হয়। বুদ্ধিস্ট কসমোলজি তে সূর্য কে মানদণ্ড ধরে কাল গণনা করার প্রচলন ছিল। তাই ঘূর্ননকাল সম্পন্ন হবার সাথেসাথে পুরাতন কাল পেরিয়ে নতুনের সূচনা উৎসব হিসেবে এই চড়কের প্রচলন হয়ে আসছে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই। একটি শাল গাছের মোটা এবং সোজা গুড়ি সারাবছর পুকুরে জলে ডুবিয়ে রাখা হয়। একে গাছ বলে। এই গাছে পূজার দিন সকালে জল থেকে তোলা হয়। তারপর তেল,সিঁদুর দিয়ে সেটার পূজা করা হয়। দীর্ঘ একমাস কাল ধরে উপাসকদের নিরামিষ আহার গ্রহন করতে হয়। এদের ‘ভক্তা’ বলে। এই ভক্তাদের এইসময় সমস্ত বিধিনিষেধ সহ স্ত্রী -সঙ্গ থেকে বিরত থাকতে হয়। অনেকসময় এই ভক্তারা সাথে একটি বেতের লাঠি নিয়ে ঘোরে। গৃহস্থের বাড়ি,বাড়ি ঘুরে হবিষ্যান্ন সংগ্রহ করতে হয়। এই একমাস সময় কালে যে ভক্তার বাণফোঁড় হবে তাকে পিঠে ঘি বা সরিষার তেল মালিশ করতে হয়। তারপর চৈএের শেষদিনে পূজা হবার পর ভক্তা স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র মানে ধুতি ও গামছা পরে পূজাপূর্বক বাণ ধারণ করেন পিঠে। তারপর শুরু হয় তাকে গাছে ঝুলিয়ে চড়ক ঘোরানো। দুইহাতে কলা ও বাতাসা নিয়ে তিনি ঘুরতে শুরু করেন ঢাকের তালে তালে। এক এক করে সমস্ত ভক্তদের দিকে ছুড়তে থাকেন এই বিশেষ প্রসাদ “কলা-বাতাসা”। এই কলা প্রসাদ হিসেবে পাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সমস্ত ভক্তকুল। তাদের বিশ্বাস এই কলা প্রসাদ পেলে সমস্ত মনস্কামনা পূর্ন হয়। তিনবার বা তাঁর অধিক এই চড়ক ঘোরে প্রথা অনুযায়ী। কোথাও কোথাও এ উপলক্ষে বাণঝাঁপ, বটিঝাঁপ,কাটাঝাঁপ ইত্যাদিও হয়ে থাকে। এই চড়ক উপলক্ষে মেলার আয়োজন হয় দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায়। এ উপলক্ষে ‘ সং’ দের কাছ থেকে মাটি আশীর্বাদ হিসেবে নেওয়ার প্রথাটি আজও চালু আছে। গৃহস্থের বিশ্বাস এতে সব অমঙ্গল দূর হয়। ঠিক গোধূলি বেলায় এই চড়ক ঘুরিয়ে পুরাতন বছরের সমাপ্তি ও নতুন বছরের সূচনার আনুষ্ঠানিক রীতির মধ্যে দিয়ে কোথাও না কোথাও যেন  আপামর গৌড়বাসীর “আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে ” র আর্তিই ধ্বনিত হতে থাকে। বলে যায়- আসছে বছর আবার যেন হয়!!


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


কৌশিক বিশ্বাস

তরিকুল্লাহ সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ লেখক। বৌদ্ধ ইতিহাস, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখক।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।