উৎস সন্ধানে
মাঝে মাঝে কি হয় জানিনা। আজকাল একা একা সুটুঙ্গার ধারে গিয়ে বসি। বাঁধের উপর বসে আনমনে ঘাসগুলো ছিঁড়তে থাকি। হঠাৎ চিনচিন কিছু একটা জেগে ওঠে। আমাকে কেউ ছিঁড়ে খায়, নীরব ঘাসের ভেতর সেই ব্যথার প্রতিধ্বনি শুনি। ক্ষমা চাই। আবারও ক্ষমা চাই। ক্ষমা চেয়ে চেয়ে ভীষণ অপরাধবোধে ভুগি। বলি তোমাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে যে পাপ করেছি তার ক্ষমা হোক নীরবতা। তার ক্ষমা হোক জড়তা। তার ক্ষমা হোক মূক। একটা পাথরকঠিন শরীর। তার উপর লেগে থাকুক হাজার চাবুকের বক্ররেখা।
এরপর হাওয়াবদল হয়। এরপর সম্মুখে ছড়িয়ে থাকা বিস্তৃর্ণ বালুচর। পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে চলা। আর একটু এগোতেই একদম কাছাকাছি শুয়ে আছে দূষিত নারী। তার ঘোলা জলে আবছা দেখি মুখ। আবছা দেখি এই জীবন। বলি, যা নদী! তোর কাছে এসে আরও বেশি ভাঙ্গে বুক। আসলে এক দুরারোগ্য অসুখ বুকে আমাদের আয়নাযুগল গুটিয়ে নেয় আপনমুখ।
ফিরে আসি ছাউনি তলে। পাশ দিয়ে নেমে গেছে কংক্রিট বাঁধা সিঁড়িঘাট। দেখি শৌখিন বাবুরা শহরের, ধরছেন মাছ। ছিপ তার বের করছে লম্বা সরু জিভ। এখানেও শান্তি নেই। কি ভীষণ জীবন্ত ও হিংস্র এক প্রতারণা দেখি। মুখে খাবার তুলে দিয়ে কেটে নিচ্ছে ঠোঁট। যেমন, মোহজাল। যেমন, প্রেম। যেমন, অভিশাপ। যেমন, আত্মহত্যার টোপ।
বড় বিচিত্র এই অনুভব। অথচ তার কোনো চিত্র স্পষ্ট নয়। অস্পষ্ট। কুহক। ভাবনাগুলো সব বাকশূন্য হয় । একটু চুপচাপ থাকি। চুপের ভিতর ধীরে ধীরে খুব চাপ জেগে উঠতে থাকে । কিছু ভালো লাগেনা। ভালো লাগা খুঁজতে থাকি। এদিক ওদিক খুঁজি। খুঁজতেই থাকি। ভিতরে খুঁজি। বাইরে খুঁজি।খুঁজতে খুঁজতে একসময় ভুলে যাই কি খুঁজতে থাকি। বড় অদ্ভুত লাগে নিজেকেই। হেসে উঠি। কেন জানিনা আর একটু হাসতে ইচ্ছা হয়। আর একটু হাসি। আরও একটু হাসি। জোরে জোরে হাসি। একা একাই হাসি। শেষে পাগলের মতো অট্টহাসি হাসি। তারপর… দুম করে নেমে আসে ফুলস্টপ। কয়েক সেকেন্ডের একটা নৈঃশব্দ্য। চিতকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু কান্নাও এসময় বড় আত্মঅভিমানী। আত্মঅহংকারী। একহাত বুকে, একহাত মুখে রেখে একটা ওজন নিয়ে ঘরে ফিরি। ঘরে আমার জন্মদুঃখী মা। সকল দুঃখ চোখের গভীরে লুকিয়ে রেখে বলে “এলি খোকা! দেব বেড়ে ভাত!”
উফফ মা! সন্তান তোমার আজও শিখলো না বাঁচা। বিষাদের ভারে ন্যুইয়ে পড়ে সহজে, অথচ তুমি! সারাটাজীবন বিষাদ বইতে বইতে যেন এক বিষাদের নদী। তবু আজও, স্রোত বহে কলকল। আমি শুনি আর ভাবি, কি করে এত ব্যথা এত দুঃখ খাঁচায় বন্দী করে তুমি হেঁটে চলো মা, হেঁটেই চলো তোমার নারীত্বের উৎস সন্ধানে…
0 Comments