ইটের ভিতরে কীটের মত কাটায় এরা রাত গো
” সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ গো
পাত ভরে ভাত পাই না, ধরে আসে হাত গো”
গানটির দু লাইনের বেশি আর গাইতে পারেনি মৌজা ধলতারার টিন মিস্ত্রি উৎপল দাস । হ্যাঁ, আমরা ঘরে বসে পোষ্য আদর করা কিংবা যারা লকডাউনে নিজস্ব ছিমছাম ঘরে নৃত্য পরিবেশনার দ্বারা হাজার হাজার ফলোয়ারের মন জয় করছেন সেইসব সেলিব্রিটির কথা বলিনি । আমি বলিনি তাদের কথা যারা বেতনের কথা চিন্তা করতে করতে দুপুরের ভাত-ঘুম সেরে বিকেলের দিকে নেটফ্লিক্স কিংবা অ্যামাজন প্রাইমে ডুবে থাকেন । আমি বলছি তাদের কথা যারা লকডাউন সিজন এক কোনোক্রমে কাটিয়ে উঠতে পারলেও লকডাউন সিজন দুই-তিনে ভয়ানক ভাবে বেঁচে আছেন। একে বেঁচে থাকা বলা যায় কিনা সন্দেহ ।
পাঁচ দশকের বৃদ্ধ বলে ওঠেন ,বাপের জন্মে এমন অসুখ দেখিনি কোথাও যাওয়া বারন ,মেশা বারণ । এমন অবস্থায় কাজ কেউ দেবে ? এই সময় কেউ কাজ দিচ্ছে না। একেবারে কাজ বন্ধ।
তাছাড়া প্রতিবছর গোমিজ মিঞার বাড়িতে কাজ করি। বেশ পয়সাওয়ালা লোক ও বললো, উৎপল এবার কাজ হবেনা। সমস্ত কিছু বন্ধ। আমদানি বন্ধ । টিনের দাম অনেকটাই । এবার থাক । তা ওর মত বড় লোকেরা যখন পারল না, অন্যেরা কি পারবে ?
প্রশ্নটা সামলে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সামলে নিয়ে আবার জানতে চাইলাম, এই যে আপনি কাজ পাচ্ছেন না তো কিভাবে দিন কাটছে আপনার?
‘খাবারের খোঁজে । রেশনের দোকানে এই লাইন থেকে দুই কেজি কিংবা পাঁচ কেজি চাল পাবো সেই দিয়ে দুই-তিন দিন চলে যাবে । তারপর নুন তেলের ব্যবস্থা করতে হবে। চালে আর কত খরচ হয় । যা খরচ তা তো ওই সবজি মশলা পাতির। অবশ্য বইয়ের একাউন্টে ৫০০ টাকা ঢুকেছে । ও ব্যাংক এ লাইন দিয়েছে। ওই দিয়ে হয়তো কয়েক দিন চলে যাবে।
তারপর?
তারপর কি হবে জানিনা। ‘
না জানাটা অপরাধ নয় বরং বেশি জানাটাই অপরাধ। তারা জানে না নূন্যতম সহায়কমূল্য ,তারা জানে না ফুড ফর ওয়ার্ক প্রোগ্রাম, জানে না বন্টন ব্যবস্হা। শুধু জানে গতরের শক্তি দিয়ে কাজ করে যে টাকা আয় হবে তা দিয়ে রান্না হবে এবং সকলে একসঙ্গে বসে খাবে। আবার ও জানতে চাইলাম, কাকা, এই যে এখন বাজারে লোন দেয় অনেক সংস্থা ,আপনারা কেউ বন্ধন উজ্জীবন কিছু নেননি ?
‘আর বলেন না, এইটুকু বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল, তারপর বলতে শুরু করল, ওইটা হল আমাদের যম। মেয়ে জামাই একদিন এসে বলল বাবা এখন তো আর রিকশা কেউ চালায় না। তুমি বন্ধন তুলে আমাদের একটা টোটো কিনে দাও। আমার মাসে মাসে তোমায় টাকা দিয়ে যাবো। তা দিয়ে বন্ধন শোধ করো। টাকা তুলে দিলাম। প্রথম দুমাস দিয়ে ছিলো । তারপর আর দেয় না। একটায় মেয়ে কি করব বলুন। প্রতি সপ্তাহে বন্ধন আসে আবার চলেও যায় কিন্তু যা নিয়ে যায় সেটার পরে আর কিছু থাকে না। বাজার করার টুকুও না।
শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল । আসলে এই অভাবের ইতিহাসটা ভারতে খুব নতুন নয়। কিছু সমস্যা থাকে যার উৎস খুঁজতে গেলে যেন হারিয়ে যেতে হয় । তেমনি একটি সমস্যা হল খাদ্যাভাব । যাকে বলা যেতে পারে খাদ্যনিরাপত্তার অভাব । আমাদের সমাজে সামাজিক বৈষম্য আছে কিনা জানিনা । সংবিধান আমাদের সামাজিক বৈষম্য কতটা দূর করতে পেরেছে তাও জানিনা। হয়তো অনেকটাই দূর করতে পেরেছে কিন্তু আর্থিক বৈষম্য দিনকে দিন বাড়ছে বৈ কমছে না । একদল মানুষ আছে ,যদিও সংখ্যায় তারা খুবই কম ,টাকা কিভাবে খরচ করবেন ভেবে পায়না আর একদল এমনই দরিদ্রের শিকার যে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। শুধু পাতে একটু খাবার পড়ুক তার জন্যই লাইন। খুব বৈচিত্র্যময় খাদ্যভান্ডার তাদের থাকে না যেটা থাকে তা খুব একঘেয়ে খাবার।
কি আর জিজ্ঞেস করবো ভেবে পেলাম না। শুধু তার চাউনির দিকে তাকালাম। একটি ভিজে নোনা বাতাস তার চোখ স্পর্শ করে আছে। বয়েস অনেক আগেই তার হাসিখুশি চেহারাটাকে বদলে দিয়েছে। আর এই লক ডাউন তাকে অন্য রকম এক মানুষ করে দিয়েছে। আনমনা হয়ে আমিও সেখান থেকে রওনা দিলাম । অন্য এক লক ডাউনের ইতিহাস খুঁজতে। অন্য এক তারকার অন্দরমহল দেখতে।
“ইটের ভিতরে কীটের মত কাটায় এরা রাত গো
সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ গো
পাত ভরে ভাত পাই না, ধরে আসে হাত গো “
0 Comments