টু-পার্সেন্ট
(১)
কোথাও এতটুকু ছায়া নেই — পৃথিবীটা পুরো খাঁ-খাঁ করছে ! দরদর করে ঘামতে ঘামতে মন্টু মাস্টার রেল-পোলের নীচে এসে দাঁড়ায় । চশমার কাঁচ ঘামে ঝাপসা ঠেকছিল, চোখে ঘাম চলে আসায় তীব্র বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে সে রুমাল খোঁজে । হাতড়ে হাতড়ে পায় না, বোঝে উত্তেজনায় রুমালটা ফেলে এসেছে বাড়িতেই । রেল-পোলের নীচের অন্ধকারটুকু চোখে সয়ে গেলে অনুভব করে একটা কাঁচাপাকা দাড়িওলা, হাফহাতা ফতুয়া আর হাঁটু অবধি গোটানো লুঙ্গি পরা একটা লোক পিটপিটে চোখে তাকেই দেখছে ! যদিও তার মাথার পাশ বরাবর কানের উপর দিয়ে একটা মোটা গামছা এই গরমেও ভালো করে জড়ানো – তাতে মুখ যেমন অস্পষ্ট হয়েছে, তেমনই রেল-পোলের নীচের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে লোকটার শরীরের নীচের অংশ প্রায় দেখাই যাচ্ছে না ।
“ট্রেন প্যাসেঞ্জার নাকি ! তা এখানে কেন ? টাইম তো হয়ে এলো তিনটে বারোর লোক্যালের !” — সস্তা হাতঘড়ির ফাঁকে জমতে থাকা ঘাম শার্টে ঘষে সময় দেখে বলে ওঠে মন্টু মাস্টার ।
“রুমাল দেব ? আছে …” — দন্ত বিকশিত করে বেহায়ার মতো হেসে লোকটা প্রস্তাব দেয়, তারপর যোগ করে, “ট্রেন ধরতে হলে কি আর এখেনে বসে থাকি ?”
“আমারও সেটাই প্রশ্ন — এই ঠিক-দুপ্পুরবেলা এখানে করছেন-টা কী ?”
লোকটা উত্তরে কিছু বলে, কিন্তু ঠিক সেইসময় পোলের ওপর সশব্দে ট্রেন এসে পড়ে । সবসুদ্ধু কেঁপে ওঠে যেন ! অদূরে স্টেশনে থামে ট্রেনটা — কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে ফের হুইসিল তুলে চলে যায় ।
“দিন দেখি রুমাল-টা, এককাপ চা খাওয়াবোখন কখনো ।” — প্রায় নির্লজ্জের মতোই লোকটার কাছে হাত পাততে হয় নিরুপায় মন্টু মাস্টারকে । অনেকদিন ইস্ত্রি না-করা, কোঁচকানো জিন্সটা একটু তুলে বসে পড়ে সে ।
রুমালটা এগিয়ে দিয়ে লোকটা যে মন্তব্য করে, তাতে চমকে ওঠে মন্টু মাস্টার, লোকটা বলে ওঠে, “প্রোফেসর সাহেব লোকটাকে কেমন বুঝলেন ?”
“আ-আপনি জানলেন কী করে !” সন্দেহে ভুরু কুঁচকে যায় তার । আসলে কয়েক খেপে প্রোফেসরের থেকে কমিশন নিচ্ছে সে – কেউ এ ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও জানে না । টিউশন করে ক-দিনই বা পেট চলে ? সমাজে যারা মুখ লুকিয়ে কুকর্ম চালিয়ে যেতে চায়, তাদেরই মিডলম্যান সে । এভাবেই কোনোমতে সংসার চলছে তার । কিন্তু এই প্রোফেসর-কে সে ভয়ই পায় । অন্য সকলের সঙ্গে দরাদরি চললেও প্রোফেসরের কাছে সে মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলতে পারে না । কিছু বলতে গেলেই ঘাড়ের উপর ভারী হাতটা রেখে প্রোফেসর নিষ্ঠুর গলায় বলেন, “সাবধান মন্টু বাবু, আমি না শুনতে ভালোবাসি না… ”।
মন্টু মাস্টারের চিন্তার জট ছিঁড়ে লোকটা ঘুরিয়ে মন্তব্য করে, “জলের মতো সহজ — ভদ্দরলোকের ঘাম কখন হয় ?” তারপর মুচকি হেসে বলে, “মাস্টার … তাই না ?”
“সেটাও আমায় দেখেই বোঝা গেল ?”
“আজ্ঞে ! আপনার ছাত্তর পেটানোর বাতিক আছে । আর ভুলে যাওয়ারও । কবিতা টবিতা লেখেন নিশ্চই ?” — বিশ্রী খিকখিক হাসিতে মাথা গরম করে দিয়ে বলে ওঠে লোকটা ।
“নাম কী মশাইয়ের ?” — ভাববাচ্যে প্রশ্ন রাখে মন্টু মাস্টার ।
“নামটা বললে আপনার পেত্যয় হবে না !”
“শুনিই না — ”
“একান্ত শুনবেনই ? তাহলে বলি — অধমের নাম, সাইকো সনাতন ! ইয়ে বুঝতেই পারছেন ঐ ‘সাইকো’-টা লোকে ভালোবেসে আমার নামের আগে জুড়ে দিয়েছে । তাতে আপত্তি নেই — এ একরকম আপনাদের ইসকুলের ভাষায় সাট্টিফিকেট — বুঝলেন কি-না !”
“আমি ইস্কুলে করি না, করলে এই সময় সেখানেই থাকতুম । এমনি বাড়িতে ছাত্র পড়াই । তা মশাই করেন কী ?”
“আবার বিপদে ফেললেন । নিজের মুখে এসব কুকথা বলা যায় ? লজ্জা নাগে না ! আমি ওই চুরি – ছিনতাই – পকেটকাটা এইসব করি আর কি !”
“মাইরি !” — বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলে ফ্যালে মন্টু মাস্টার — তারপর লোকটার পাশে জিন্সটা একটু টেনে তুলে, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলে, “সত্যি ?”
“এসব ব্যাপারে মিথ্যে বলা যায় বলুন ? গুরুর বারণ আছে না ! তবে সাইকো নামটা অন্য কারণে পাওয়া !”
কৌতূহল চাপতে না পেরে মন্টু জিজ্ঞাসা করে — “কারণটা কী জানতে পারি ?”
“ঐ একটা খুন হয়ে গেল আর কি এই হাতে…” — অম্লান বদলে বলে লোকটা ।
“গাঁজাখুরি গল্পের একটা সীমা আছে !” — বিকৃত মুখে রাগ এনে বলে মন্টু মাস্টার ।
“এতে এতো অবিশ্বাসের কী আছে মশাই !” — সনাতন একরোখা ভঙ্গিতে জবাব দেয়, — “সিঁধ কাটতে গিয়ে পড়লুম ধরা — চোরের মার মারলো, বেশ কথা — তারপর সেই মারের ভিডিও তুলতে লাগলো মোবাইলে ! গেল মাথা গরম হয়ে — দশজনের সামনেই যে লোকটা ভিডিও করছিল, দিলুম তার মাথায় বসিয়ে একখানা থান ইঁট । কেউ ভাবতে পারে নি বুঝলেন — যে মার খেতে খেতে ওরম মেরে দেবো ! কিন্তু শালা মোলো না ! কড়া জান — দিব্যি হসপিটালে গিয়ে মাথায় ফেট্টি বেঁধে দুদিন বাদে ফিরে এল ! মাঝখান থেকে আমার চারদিন জেলে কেটে গেলো !”
“মানে ! তাহলে খুন-টা কে হলো ?” — বিরক্তিতে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে মন্টু মাস্টার ।
“বলছি — তারপর তো জেল থেকে বেরোলাম — ও শাল্লা ! সে মাল দেখি দিব্যি রাস্তায় ঘুরছে ! পিছু নিলাম, সাঁঝের বেলায় পাড়ায় ঢুকলাম । কদিন আগে ঐ পাড়াতেই মার খেয়েছি বলে একটু ভয় ভয় লাগছিলো — কিন্তু ও কিছু না — ভয় পেলে আমাদের চলে বলুন ! তা ওই রাত পড়তেই ঢুকে পড়লাম গোটা মাথা-মুখ গামছায় ঢেকে । শালার ব্যাটা শালা দেখি, বসে বসে মাছ ভাজা খাচ্চে ! টিভি চলিয়ে সাঁটাচ্চে ! বুড়ি মা অসাড় হয়ে সোফায় ঘুমাচ্ছে । হেব্বি সুযোগ বুঝলেন ! চারপাশে ভালো করে খুঁজেও জুত মতো কিছুই পেলাম না ! শিকার একবার ফসকে গেছে — বুঝলেন না ! ‘সাইকো’ নামের মান-টা তো রাখতে হবে, না-কি বলুন ! তাই চট করে একটা বুদ্ধি বের করলাম । সাইকেলের চেন পেয়ে গেলাম সেই বাড়ির অন্ধকার বারান্দায় । মাল দেখি একটা ভাজা মাছ নিয়ে কাঁটা বাচছে । একটু করে খাচ্চে, কাঁটা ছাড়াচ্চে আর লাল জলে টান দিচ্ছে ! বুঝলেন কি-না ! তা চেনটা ভালো করে পেঁচিয়ে পিছন দিক থেকে টান দিতেই মিনিট পাঁচেক ছটফটিয়ে মাল থেমে গেলো ! ভাবলাম কদিন আগে এতো ক্যালালো ! একটু খাতির না করে ছেড়ে দেবো ? কিন্তু কীভাবে কী করি ! অনেক ভেবে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো ! ভাবলাম, মাছের তেলে মাছ ভাজলে কেমন হয় ?”
“মানে ?” — আতঙ্কে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া গলায় কোনোমতে বললো মন্টু মাস্টার । সে বুঝেছিল ‘সাইকো’ নামের ইতিহাস সুদীর্ঘ । তাছাড়া তার বারবার মনে হচ্ছিলো, লোকটার কথাগুলো যেন হাওয়ায় দূর থেকে ভেসে আসা হাহাকারের মতো শোনাচ্ছিলো, যেন সে সামনে বসে আছে কিন্তু কথাগুলো ভেসে আসছে দূর থেকে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে !
“মানে আর কিছুই নয়, মাছের কাঁটাগুলো তো পাতে পড়েই ছিল । তা ওগুলোই গোটা মুখে গুঁজে গুঁজে সাজিয়ে ডিজাইন করে, দিলাম আর কি ! তা সে বিচ্ছিরি ব্যাপার বুঝলেন ! সে রক্ত-মক্ত একশা । তারপর ঐ মদটুকু খেয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেলাম ।” – নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো সনাতন ।
(২)
বেলা পড়ে আসছিলো । হতবুদ্ধি মন্টু মাস্টার ভিজে রুমালটা নিয়ে আপ্রাণ মুখে বুলোতে থাকে — কিন্তু ঘাম যেন ফুরোতেই চাইছে না ! কতগুলো প্রশ্ন তাকে জেরবার করে তুলছে — সে যে প্রোফেসরের সাথে এখানে দেখা করবে এই লোকটা জানলো কী করে ? এই লোকটা কি সত্যিই খুনী ? কিন্তু তার চেয়েও ভয়ঙ্কর চিন্তা মাথায় আসে তার, জিজ্ঞেস না করে পারে না — “আর ঐ লোকটার বৃদ্ধা মার কী হলো !”
“মুশকিলে ফেললেন — এসব নিজের মুখে বলা যায় ! বালিশ ছিলো তো — বুড়ি মানুষ — নির্বিঘ্নে হয়ে গেলো ।”
ধড়মড় করে উঠে পড়তে পড়তে মন্টু মাস্টার বলে ওঠে, “তবে যে বললে একটা খুন মোটে !” তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো ।
“বসুন” — আদেশের সুরে বলে সনাতন — “ওটাকে খুন বলা চলে না — বুড়ো মানুষ — বয়স বোধহয় সত্তর পেরিয়েছে – বালিশটা মুখে ঠেকিয়ে রাখতেই মুক্তি পেলেন — চা-বিস্কুট খাবার মতোই সরল কাজ । আর বলিহারি আপনাদের যুক্তিবোধ – খুন একটা না দশটা, তাই দিয়ে কি পাপের ওজন মাপবেন ! তবে হ্যাঁ, আজকের কাজটা কঠিন ছিলো ।”
“কী কাজ ?” — এহেন পরিস্থিতিতেও প্রশ্নটা না করে পারে না মন্টু মাস্টার । কাছেপিঠেই কোথাও ছুঁচোর ডাকের মতো শব্দ হচ্ছে । সেই সঙ্গে সে খেয়াল করে সুড়ঙ্গের মতো অন্ধকার পোলটায় ক্রমশ হেলে পড়া সূর্যের আলো একটু একটু করে ঢুকছে আর সেই আলোতেই — ওটা কী ! কী ওটা ? মন্টু মাস্টারের বুকের মধ্যে যেন কেউ ওর হৃদপিন্ডটা লক্ষ্য করে দু-মণ পাথর ছুঁড়ে দেয় ! ওটা কি একটা লাশ ? হ্যাঁ তো — লাশই তো ! কার ? প্রোফেসরের ! ভালো দেখা যাচ্ছে না ! তবে কি — তবে কি সনাতন-ই প্রোফেসরকে খুন করেছে ? আহা অমন বলশালী লোকটা ! অত বড়ো চেহারার লোকটাকে এই মাঝারি উচ্চতার, সাধারণ চেহারার লোকটা মেরে ফেললো ! আর তাছাড়া এই এতক্ষণ তারা কথা বলে চলেছে, তাকে এতটুকু টের পর্যন্ত পেতে দেয় নি ! কী সাংঘাতিক ! ওফফ্ !
(৩)
মন্টু মাস্টারের ঘাম বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো — এবার তার মনে হলো যেন শীত শীত করছে — সূর্য ঢলে পড়ছিলো — বাইরে আলো-তে চারদিকের ধান ক্ষেত তখনো আলোকিত হয়ে থাকলেও রেল পোলের নীচেটায় তখন ফের অন্ধকার ঘনিয়েছে । মন্টু মাস্টারের কানে আসে পাখি ডাকার শব্দ – ওরা বাসায় ফিরছে । আর সেই সঙ্গে আরো দুটো শব্দ — হাত ঘড়ির সেকেন্ডের বিরতিতে টিকটিক আর ওর নিজের বুকের ঢিপঢিপ — দুটোই যেন তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো । সারাদিনের অসহ্য গুমোটের পর তখন মেঘ করে আসছিলো । ঠিক এইসময়ে তার মনে হলো বেশ কিছুটা দূরে ক্ষেতের আলপথে একটা বউ মতো কেউ একটা বাছুর নিয়ে যাচ্ছে — মন্টু মাস্টার শরীরের সমস্ত শক্তি গলায় জড়ো করে চিৎকার করে উঠলো “বাঁচাও — বাঁচাও !”
কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস ! পাঁচটা সতেরোর ট্রেনটা ঠিক সেই সময় মাথার উপর দিয়ে, পোল কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেলো । মন্টু মাস্টার হতবুদ্ধি হয়ে পোলের উল্টো দিকে তাকালো । সরু লম্বা সুড়ঙ্গের ওপারের ক্ষীণ আলোতে তার মনে হলো লাশ-টা নড়ছে । মন্টু মাস্টারের হাত-পা কাঁপতে লাগলো । অসহায়ের অবলম্বন খোঁজার মতো করে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে কোনোমতে বলতে পারলো, “ও কী ! প্রোফেসর কি বেঁচে আছেন !”
“অপঘাতে মরেছে তো — উঠবে জানতুম । এনারও কড়া জান কি-না ! মরেই গেছে — কিন্তু মরে গেলেই তো আর সব চুকেবুকে যায় না, তাই না !”
“তার মা-মানে-এ ?”
“তার মানে আত্মা-টা তো থাকেই — তাই না ! সে কোথায় যাবে বলুন ! এসব তো আমারও অজানাই ছিলো — আজই জানলুম ।” – খিকখিক্ শব্দে হেসে বলে সনাতন । বহুদূর থেকে ভেসে আসে শাঁখ বাজার ক্ষীণ শব্দ । কোথাও একটু গরুর ডাকও শোনা যায় । গ্রামের এই অঞ্চলটা লোকজন এড়িয়েই চলে । তাই প্রোফেসর ওকে এখানেই ডেকেছিলেন — উনি নামী মানুষ — কিন্তু শখ ষোলো আনা — কুসুম বাগদির সাথে একটা বন্দোবস্ত না করতে পারলে সমাজে জানাজানি হয়ে যেতো ! বাচ্চা-টাকে দেখতে হয়েছে তো পুরো প্রোফেসরের মতো — বেজন্মার মুখটা পুরো বাপের মুখ কেটে বসানো ! কতদিন আর কুসুম তার স্বামী-ননদদের চোখে ধুলো দেবে ! নেহাৎ তার শ্বশুর-শাশুড়ী গত হয়েছেন, তাই রক্ষে । অভিজ্ঞ চোখে এসব ঝটপট ধরা পড়ে যায় । তাই হাতব্যাগে হাজার চল্লিশ টাকা আনার কথা ছিলো প্রোফেসরের । এটা তৃতীয়বার । মিডলম্যান মন্টু মাস্টারের টু পার্সেন্ট কমিশন । কিন্তু দেখো দেখি কী বিপদ ! এই বাঞ্চোৎ সাইকো-টা কোত্থেকে এসে পড়লো ! টাকাটাও নিশ্চিত ঐ হাতিয়েছে ! লোভ — ঐ টাকার লোভটাই মন্টু মাস্টার-কে এতক্ষণ এই অন্ধকার সুড়ঙ্গে বসিয়ে রেখেছে । তার খালি মনে হচ্ছে, এখনো একটা সুযোগ আছে ফিফটি-ফিফটির !
কিন্তু তার হঠাৎ মনে হয়, সূর্যের অস্তরাগের মৃদু আলোয় সনাতনের মুখে যেন একটা মনখারাপের কষ্ট লেগে আছে — অস্বাভাবিক মনে হয় । পাঁচটা সাতান্নর ফিরতি ট্রেন-টা বেরিয়ে যায় । সাতটা বত্রিশের আগে আর ট্রেন নেই ।
“এতগুলো টাকা …” — যেন মন্টু মাস্টারের মনের সুগুপ্ত বাসনা পড়ে ফেলেই বলে ওঠে সনাতন, “চোরের চোখ তো — কারোর ব্যাগে ভারী মাল থাকলেই ঠিক টের পাই — কিন্তু এ ব্যাটা দশাসই । শালার ব্যাটা শালা, আমি এক ঘা দিই তো সেও দু ঘা দেয় । মুখ থেকে মাথা পর্যন্ত পাশাপাশিভাবে কানদুটো ঢাকা দিয়ে রাখা প্যাঁচানো গামছাটা এতক্ষণে খুলে হাতে নেয় সনাতন — তার ডান কানের পাশ থেকে ঘাড় অবধি যেন অনেকটা ফাঁক হয়ে আছে বলে মনে হয় ! সনাতন পিছন ফিরে পোলের অন্য প্রান্তে তাকিয়ে কাকে যেন ডাকে — “কর্তা, আসেন — আর লজ্জা পেয়ে কাম কি ?”
“শালা মেরে দিলি আমারে ! কতো কষ্টে সব গুছিয়ে এনেছিলাম — সব শেষ করে দিলি !” — মন্টু মাস্টার-কে স্তম্ভিত করে দিয়ে প্রোফেসরের সূক্ষ্ম দেহ তাদের সামনে টলতে টলতে এসে উপস্থিত হয় — উবু হয়ে বসে । তারপর ধীরে ধীরে দেহ-টা জমাট বেঁধে ঠিক আরেকখানা প্রোফেসর হয়ে যায় । নাক-ভাঙা, ঠোঁট-থ্যাঁতলানো, মাথা খুবলোনো প্রোফেসরের পিশাচ মূর্তি । দূরে লাশটা পড়েই থাকে ।
“মন্টু বাবু কিছু বুঝছেন ?” — দুঃখিত গলায় প্রশ্ন করেন প্রোফেসর ।
“নাহ্ বেচারা মাস্টার পুরো ঘেঁটে গেছে — আসুন তবে রহস্য উদ্ঘাটন করা যাক্ ”— এই বলে সনাতন উঠে দাঁড়ায় । স্তম্ভিত মন্টু লক্ষ্য করে, সনাতনের পায়ের পাতা থেকে কোমর অবধি কেমন গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলোর মতো হয়ে উঠেছিলো — একটু একটু করে সেগুলো জমাট বেঁধে যায় । তারপর সনাতন আর প্রোফেসরের দুই সূক্ষ্ম শরীর তাকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে, মন্টু মাস্টার সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে হেঁটে যায় । লাশ তো একটা নয় — দুটো । হ্যাঁ ! একটা ভারী শরীর — উলটো ভাবে — নিশ্চিত প্রোফেসরের — আর তার নীচে চাপা পড়ে ও কে ! কানের পাশ থেকে ঘাড় বরাবর শূন্যতা ! ও কি সনাতন !
সভয়ে অবিশ্বাসের চোখে সে উলটো দিকে ফিরে তাকায় — সাইকো সনাতন আর প্রোফেসরের যুগল মূর্তি তখন তার দিকে ফিরে ভয়ংকর অট্টহাস্যে ফেটে পড়ছে — দুজনের হাতেই নোটের তাড়া — দুজনেই সমস্বরে বলছে, “মন্টু মাস্টার ! টু পার্সেন্ট নেবে না ? নেবে না তোমার টু পার্সেন্ট ?”
0 Comments