স্বপ্নের সাহস
যেদিন যেমন জোটে সেদিন তেমন রান্না হয়, এই আজ যেমন গরগরে করে মাগুর মাছের ঝোল রেঁধেছে টগর। ছেলেমেয়ে দুটো মাগুর মাছ খেতে বড় ভালোবাসে। না, ফ্যাকাসে রঙের থ্যাবড়া মাথাওয়ালা হাইবিড মাগুর নয়, জলের দেশের মেয়ে হয়ে টগর মাছ চিনবে না? ল্যাজা মুড়ো নিয়ে ছপিস বেরিয়েছে, নিজের পাতে মুড়ো আর ল্যাজা নিয়ে গাদার টুকরোগুলো ছেলে মেয়েকে সমান করে ভাগ করে দিয়ে ডাক দিল ‘খেতে আয়’।
এই মাত্র একটা বড় পেলেন উড়ে গেল, সেটা দেখার জন্য ছেলেটা রেলিঙ ধরে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, টগরের ডাকে খেতে এল। টগরের তেরো বছরের মেয়ে মধু আয়েষা’র সদ্য বিয়োনো ছেলেটাকে কোলে করে বারান্দার রোদে বসেছিল, পাশে আয়েষা ছেলের জন্য ছোট ছোট কাঁথা সেলাই করছিল। টগরের পাশের ঘরটাই আয়েষার , আগে ওর মা ফতেমা থাকত, সে মরে বেঁচেছে। এখন আয়েষা থাকে। লম্বা টানা বারান্দাটার একপাশে রান্না করে টগর, একসাথে দুবেলার, রাতে সময় কোথা! তারপর খাবার নিয়ে ঘরেই খেতে বসে। ঘর বলতে ওই একফালি জায়গা, চৌকিতেই আধখানা ঘর ভরা, বাকী আধখানায় বাকী সংসার।
মা আজ ঝোলটা খুব ভাল রেঁধেছিস রে, মধু বলে। টগর খুশি হয়ে ল্যাজা থেকে একটু মাছ ভেঙে মেয়ে আর ছেলের পাতে দেয়। খাক, ওরা খেলে মায়ের পেট ভরে। খেয়ে মধু আঙুল চাটছিল, ওর ফর্সা আঙুলে লাগানো নেলপালিশের দিকে তাকিয়ে টগরের চোয়াল শক্ত হল, বাঁ হাতে মেয়ের চুলের মুটি ধরে নাড়িয়ে বলল হতচ্ছাড়ি, তুই আবার নখে রঙ মেখেছিস। খুব শখ না রঙ মাখার! কি করবি? কি করবি রঙ মেখে? আমার মতো লাইনে নামবি? বেশ্যা হবি? মধুর চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে খালি ভাতের থালায়। ছেলেটা খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে। টগর জানে সোনাগাছিতে বেশ্যার মেয়ে বেশ্যা হয় কেউ আটকাতে পারে না , ছেলে গুলো হয় দালাল কিম্বা গুন্ডা বদমাই। কিন্তু সে কিছুতেই হতে তা দেবে না। নেলপালিশের শিশিটা হাতের কাছেই ছিল, ছুঁড়ে জানলা দিয়ে ফেলে দিল টগর। পঁয়তাল্লিশ টাকা গিয়ে পড়ল পাশের এঁদো গলিতে। মেয়েটা তখনো কাঁদছিল।
ঘরের এঁটোকাঁটা সাফ করে মেঝেতেই মাদুর পাতলো টগর আর তিনটে তেলচিটে বালিশ। বালিশের ঢাকার গায়ে অজস্র সেলাই। থাকগে, নিজেরাই তো শোয়। খদ্দেরের বালিশ আলাদা। মেয়েটা দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়েছিল, টগর মাথায় হাত রাখল। মেয়েটা দেখতে বড় সুন্দর, পরীর মতো। বাপের মতো হয়েছে বোধহয়, তবে কে বাপ তা টগরের জানা নেই। মানদা মাসি নাম রেখেছিল মধু। ছেলেটার গায়ের রঙ টগরের মতো মাজা মাজা, তার নাম রাজা। হ্যাঁ ভিখিরির ঘরেও রাজা জন্মায়। দুপুরে মাকে জড়িয়ে ধরে তারা শুয়ে থাকে, রাতে তো পায় না।
মধু বলে “মা আমি আর কোনদিনও সাজবো না দেখিস। পড়া করে, ভালো চাকরি করব, তোকে আর ভাইকে নিয়ে অনেকদূর চলে যাব। সেখানে কেউ আমাদের বেশ্যার ছেলে, বেশ্যার মেয়ে বলবে না।” টগরের চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। রাজা বলে মা আমি পাইলট হব পেলেন চালাবো, পাহাড়ের উপর দিয়ে সমুদ্রের উপর দিয়ে। কত দেশ দেখব। হীরেন মাষ্টার বলেছে ভাল করে পড়া করলে পাইলট হওয়া যায়।
-“তোর হীরেন মাষ্টার পেলেনে চেপেছে?” জিজ্ঞেস করে মধু।
-“হ্যাঁ রে, নইলে কি করে জানবে পাইলটের কথা। জানিস মেয়েরাও পেলেনে চাকরি করে, তুই করবি দিদি? আমি পেলেন চালাব, তুই পেলেনের লোকদের খাবার দিবি। আমরা একসাথে চাকরি করব, মা আমাদের টিফিন করে দেবে, আমরা একসাথে খাব। তখন তো আমাদের পয়সা হবে, রোজ মাগুর মাছের ঝোল রেঁধে দিবি, হ্যাঁ মা।”
টগর মাথা নাড়ে।
-“জানিস দিদি পেলেনের জানলা খোলা যায় না?”
-“যাহ, হাত বাড়িয়ে মেঘ ধরা যায় না নাকি?” টগর বলে।
ছেলেটা হাসে, বলে “তুই কিছুই জানিস না মা , দাঁড়া তোকে ছবি দেখাবো। সেই দিন কাগজে মালের বোতল মুড়ে আনলি না, ওতে ছিল। ইসকুরুপ দিয়ে বন্ধ করা জানলা।”
ছেলে মেয়ে দুটো বকে যায়, রাত জাগার ক্লান্তিতে টগরের চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে, সে ঘুমিয়ে পড়ে। সন্ধ্যে হলে আবার রঙ মাখতে হবে।
আয়েষা এখন কোন খদ্দের নেয় না, তাই সন্ধ্যে হলে, বইখাতা দিয়ে ছেলে মেয়ে দুটোকে আয়েষার ঘরে পাঠিয়ে দেয় টগর। তারপর গা ধুয়ে সস্তার গা দেখানো নাইলনের শাড়ি আর ম্যাচিং ব্লাউজ পরে, সায়ার দড়ি বাঁধে নাভির অনেকটা নীচে। বয়স ঢাকতে চোখে কাজল দেয়, ঠোঁটে লিপস্টি। সরু প্লিট করে আঁচল কোমরে গোঁজে। ঘরে তালা দিয়ে আয়েষার ঘরে উঁকি মেরে মেয়েকে বলে খবরদার বেরোবি না৷
মেয়ে নিয়ে টগরের বড় জ্বালা, তেরো বছরেই তাকে অনেকটা বড় দেখায়। গত মাসে এক বাবু কাজ সেরে বেরুনোর সময় মধুকে দেখে বলেছিল “পরদিন মেয়েটাকে দিস।” টগরের মাথায় খুন চড়ে গিয়েছিল। “শালা, হারামির বাচ্চা তোর নিজের ঘরে মেয়ে নেই?”
এক লাথি কষিয়েছিল লোকটার পিছনে, হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল বারান্দায়। মানদা মাসি ছুটে এসেছিল, সাথে আরো অনেকে। টগরকে ঝাঁঝিয়ে বলেছিল
-“খদ্দেরকে লাথি মারছিস হারামজাদি মাগী! বেশ্যার মেয়ে কি বড় হয়ে সতী নক্কী হবে!”
টগরের ইচ্ছে করছিল ছেলে মেয়ে দুটোর হাত ধরে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যেতে, কিন্তু বেশ্যাদের কি কোথাও ঠাঁই হয়?
নীচে নেমে টগর এসে দাঁড়ায় তার নির্দিষ্ট জায়গায়। এ পাড়ায় সবার একটা নিজস্ব দাঁড়াবার জায়গা আছে।খদ্দেররা জানে ঠিক কোন জায়গায় কাকে পাওয়া যায়। যেমন বাজারে আমরা জানি ভালো রেওয়াজি খাসি কার কাছে মেলে, আর কার কাছে রসালো আম, তেমনি।টগরের পাশেই দাঁড়ায় মালতী। দুজনের বাড়িই সুন্দর বনের দিকে, দ্যাশের লোক।
-“কাল তোর কটা হয়েছিল?”
-“দুটো, তোর?” মালতীকে পাল্টা প্রশ্ন করে টগর।
-“আমার একটাও না। দেখছিস না পাড়া খালি, খদ্দের নেই,” মালতী বলে।
সত্যি, টগর দিনদুয়েক দেখছে পাড়ায় লোক কম। এখন মালতী বলাতে মনে হল হ্যাঁ ঠিকই।
জিজ্ঞেস করল “কেন?”
-“মরণ, তুই কোন দেশে থাকিস! দেশে চীন থেকে ভাইরাচ এয়েচে। ছুঁলেই জ্বর হবে কাশি হবে লোক মরে যাবে।”
-“তুই কোথা থেকে জানলি?” মালতীকে জিজ্ঞেস করে টগর, তার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। খদ্দের না এলে ছেলে মেয়ে দুটোকে কি খেতে দেবে!
-“খবরে দেখলাম। খুশবুর ঘরে টিভি আছে, সেইখানে।”
লক্কা পেরিয়ে যাচ্ছিল সামনে দিয়ে। টগর ডাকলো, শোন লক্কা। যদিও এই ছেলেটাকে দুচোখে দেখতে পারেনা টগর, ওর নজর মধুর দিকে। মাঝে মাঝে দাঁত কেলিয়ে টগরকে শাশুমা বলে। তখন টগর থুতু ফেলে বলে ভাগ শালা হারামি। ভাগ বললেও সে যায় নাকি!
বলে “যা একখানা মেয়ে বিইয়েছনা, পুরো ঐশ্বর্য রাই। ওই মেয়ে আবার পড়া শিখছে, শেখাও মাসি শেখাও, তারপর কলগার্লের লাইনে ফিট করে দেব। এক ঘন্টায় দশ হাজার। ” টগর ঢোক গেলে, দশহাজার সে একসাথে চোখে দেখেনি। তারপরেই শক্ত হয়ে বলে “তোর বোনকে কর কলগার্ল, আমার মেয়ের দিকে তাকালে চোখ গেলে দেব।”
আজ সেই লক্কা শাশুমা বলে দাঁত বার করে এগিয়ে আসেনি। টগর ডেকেছে।
-“খবর ভালো নয়, লকডাউন হবে।” লক্কা বলে।
টগর আর মালতী হাঁ করে লকডাউনের মানে বোঝার চেষ্টা করে।
-“আর দুদিন পরে সব কারবার বন্ধ হয়ে যাবে মাসি। ঘরে থাকতে হবে, বেরোনো যাবে না। চাল, ডাল কিনে রাখো।” লক্কা আর দাঁড়ায় না।
গোটা দেশ বন্ধ হয়ে যাবে! লোকে খাবে কি! দিন আনি দিন খাই লোকেরা কি করবে! ভিখিরিরা কার কাছে হাত পাতবে! টগর আর দাঁড়ায় না, আয়েষাকে খবর দিতে হবে। কটা টাকা জমানো আছে, তাতে আর ক কেজি চাল হবে? আর তারপর!
টগর কেন, সোনাগাছির তিন পুরুষের বেশ্যাও এমন দিন দেখেনি। সন্ধ্যে বেলা খাঁ খাঁ গলি, কাবাবের গন্ধ নেই, মদের বোতলের গড়াগড়ি নেই। মাতালের চিল্লানি নেই, বেলফুলের হাঁক নেই, চটুল হিন্দি গান নেই, রঙ মাখা মেয়ের দল নেই। তারা এমনিই বিকেল বেলা সব নেমে দাঁড়ায়, রঙ মাখতে হয়না, গা খুলে দাঁড়াতে হয় না। ঘরের নাইটি পরেই গল্প গাছা করে, ওই এক চিলতে ঘরে আর কাঁহাতক বন্ধ থাকা যায়। টগর রোজ ডাল ভাত আলুভাতে রাঁধে। জমানো টাকায় চাল কিনেছিল। তারপর লক্কা দিয়ে গিয়েছে অনেকটা চাল, ডাল। হাতধোয়ার সাবান, পার্টি থেকে পাওয়া। টগর আয়েষাকে দিয়েছে। কোনরকমে জুটে যাচ্ছে ভাত। ছেলে মেয়ে দুটো খুব খুশি। এখন রাতে তারা তিনজন গা ঘেঁষে চৌকিতে শোয়। ওদের ইসকুল বন্ধ। বাড়িতে পড়ে। টগর চার কেলাস অবধি পড়েছে, ইংরেজি জানেনা। রাজা শেখায়, বল মা “ব্যাট মানে বাদুর, ম্যাট মানে মাদুর।” টগর বলবে কি হেসেই মরে, মরতে বসেছে এখন ইংরেজি শিখে কি হবে। মেয়ে বলে শেখার কোন বয়স নাই রে মা। তুই যাবি পড়তে? আমি ‘অদিতি’দি কে জিজ্ঞেস করব? টগর মাথা নাড়ে। বলে তোরা পড় তাইলেই আমি খুশি। এখন আর কোন ভয় নেই, মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে হয়না। কেউ ছিঁড়ে খেতে আসবে না। ওদের পড়তে বসিয়ে দিয়ে খুশবুর ঘরে খবর দেখতে যায় টগর।
খুশবুর ঘরে ঠান্ডা মেশিন আছে, টিভি আছে। ওর মালদার বাঁধা বাবু লাগিয়ে দিয়েছে, সে মোটা মানুষ গরম সইতে পারেনা। তবে সে এখন নিপাত্তা তার আর ফোন লাগছে না। খুশবু মন মরা হয়ে থাকে, তার চোখের কোনে ঘন কালি । সে বিলিতি মাল ছাড়া খেতে পারেনা, বাবু অভ্যেস করিয়েছে। এখন মদের দোকান বন্ধ, গিদেরি খুশবু খিঁটখিঁটে হয়েছে। তবে তার টিভিটা সারাক্ষণ চলে, টগর গিয়ে বসে।খবরে বলে দ্বিতীয় দফায় লকডাউন হবে, মানে আরও একমাস। শুনে ঘরের আর সবাই হা হুতাশ করতে থাকে। টগর আর বসে না, গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে ঘরে ফিরে আসে।
হ্যাঁরে হেলিকাপটারের মাথায় পাখা থাকে, পেলেনের মাথায় থাকে না কেন? ছেলেকে জিজ্ঞেস করে টগর। মেয়েটা বিজ্ঞান পড়ছিল, ছেলেটা ভূগোল, পছন্দের আলোচনা পেয়ে তারা মায়ের কোল ঘেঁষে বসল। ছেলেটা তার উড়োজাহাজ নিয়ে যাবতীয় জ্ঞান উজাড় করে দিতে থাকলো, মেয়েটাও তাতে তাল দিল। টগর মনে মনে ভাবলো স্বপ্নটাকে আরো কটা বছর যে করেই হোক জিইয়ে রাখতে হবে, তার ছেলে মেয়ে দুটোমানুষ হওয়া অবধি বেশ্যা পাড়ায় লকডাউন হলে বেশ হয়।
0 Comments