সে আর একটি কুকুরের গল্প
আশ্চর্য ঘটনাটা হল,বুড়িগঙ্গার বাদামতলী ঘাটে আবার মাঝরাতে ভেসে উঠল পরাণ মাঝির নৌকা। আকাশে তখন মস্ত বড় চাঁদ, ফুরফুরে হাওয়াই ভাসছে পোড়া পোড়া গন্ধ।
ঠিক বহুবছর আগে পরাণ মাঝির লাশ যেখানে ভেসে উঠেছিল, সেখানেই ভাসছিল নৌকাটা।
ভয়ে ভয়ে এতক্ষণ সাঁতরে আসা হাতের সামনে ফাঁকা একটা নৌকা দেখে ঘাবড়ে গেল সে।এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। উঠে পড়ল । নৌকার পেটে দুটো পুঁটলি। একটা আবার নড়ছে। ভয়ে আবার জলেই ঝাঁপাতে যাবে এমনসময় পুটলিটা হাড় জিরজিরে কুকুর হয়ে ঠান্ডাগলায় বলল, ভয় পেও না! বরং চুপচাপ কানপেতে আমাদের কথা শুনে যাও!
— আমাদের!
কুকুরটা ফিসফিস করে বলল, আমি কথা বলছি বলে ঘাবড়ে যাওনি দেখে ভাল লাগল। শোন এই নৌকাটা দরকার পড়লেই ভেসে ওঠে। আপনার মত কত মানুষজন পার করি….।সেই রাত্রিরে সুতা মজুরের কাছে বিদায় নিয়ে আসবার পথে গোরা সৈন্যর গুলিতে শুধু মাঝির মরেনি তার সংগে আমিও.. । গুলি লেগেছিল, বুকে, দুজনেরই। আমাদের যখন এই বুড়িগঙ্গায় চ্যাংদোলা করে ফেলে দিল তখন আমরা জীবিত ছিলাম। ভাসতে ভাসতে আমরা কথা বলছিলাম।অনেক কথা, দেশ,ধর্ম,খিদা,গান কত কী! একসময় মাঝিকে হারায়ে ফেললাম অতল জলে। তাকে আর পাইনি।ছিল তার লাশ।আমার বডির পাশে।বহু কষ্টে তার নৌকা আর পুটলিটা পাই।
— ওহ্!
— এই যে দেখছ পুঁটলিটা।বিবি আর তার ছাওয়ালের জন্য জামা কাপড় কিনেছিল মাঝি ঈদের আগে। এই পুঁটলিটা কথা বলতে পারে তবে ও খুব লাজুক।
তিনদিন হল পেটে কিছু পড়েনি। সে পালাচ্ছে জীবন নিয়ে। দূর্বল শরীরের জন্যই এমন আবোলতাবোল কিছু দেখছে বলে নিশ্চিত হল ।এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না ভেবে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতেই পুটলিটা খিক খিক করে হেসে বলল, কেমন আছেন ব্লগার ভাই! ভয় পাচ্ছেন ক্যান?
ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে। মনে মনে ঠিক করল আবার ঝাঁপ দেবে। দূরে কোথাও চলে যাবে তার মাতৃ ভূমি ছেড়ে। বাঁচবে, লিখবে স্বাধীন।
পারল না। নৌকাটা বলে উঠল, আমার ভেতরে সুতা মজুরের আত্মা আসার পর স্পিডি হইচি। শান্ত হইয়া বসেন। ওই যে দেখতিছেন সামনে ফকফকা আলো, আপনাকে ওই খানে নিয়া যাবো। বসেন।মাঝিভাই থাকলে আপনারে এই চাদনি পসর রাতে একখান গান শুনাইতে পারত, গানে আপনের সাহস বাড়ত।
কুকুরটা বলল, আপনি ধরেন দিকিনি…
পুঁটলিটাও বলল, ধরেন, ধরেন… গান ধরেন…
সুতামজুর ভয়ে ভয়ে গান ধরে….
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
বাতাস গেয়ে ওঠে….
হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
জারি গান, বাউল গান
আনন্দের তুফান
নৌকা গায়……
গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম
বর্ষা যখন হইত,
গাজির গান আইত,
রংগে ঢংগে গাইত
আনন্দ পাইতাম…..
নৌকাটা ধীরেসুস্থে আলোর দিকে এগিয়ে চলল। বাতাস ফিসফিস করে বলছে, আদাব,আদাব….
0 Comments