বিপদ
নিরিবিলি পড়ে চলে গেছে। আজকেও শ্রীভূষণের গা ঘেঁষেই বসেছিল। ছানার প্লেট দিতে এসে কামিনী আজ আবার দেখেছে। প্রথম থেকেই কামিনীর ধারণা নিরিবিলি রবিঠাকুরের কৃষ্ণকলি নয়, কালিদাস দেখলে তন্বী শ্যামা শিখরিদশনাই বলতেন।
কামিনী দ্বিতীয় পক্ষ। রেলদুর্ঘটনায় নিজের মানুষ মারা যাওয়ার বছর চারেক পরে বয়েসের ব্যবধান মেনে নিয়েই দ্বিতীয়বার বিয়ে। নিজের তরফে সন্তান নেই। শ্রীভূষণের একটিই ছেলে। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। বিয়েতে আসেনি।
শ্রীভূষণ বাংলার মাস্টার। অবসরের দুবছর আগে কামিনীর সব কিছু জেনে আর নিজের সবকিছু জানিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসে। অবসরের পর এখন টিউশনি। কলেজের ছেলেমেয়েরা বাড়িতেই আসে।
নিরিবিলি শুরুতে হপ্তায় একদিন করে পড়তে আসত। দুর্গাপুজোর পর থেকে দুদিন করে আসছে।দুদিন অন্য কেউ আসে না। কামিনীরও বাংলা ছিল অনার্সে।
শ্রীভূষণ অগোছালো মানুষ। বই কেনা আর বই পড়া ছাড়া অন্য নেশা ছিল না। দাড়ি কাটত কালেভদ্রে। আজকাল দাড়ি কাটছে রোজ। আফটারসেভ। বুকেবগলে পাউডার। বডিস্প্রে। মাথার চুল ঝরে গেছে, চিরুনি লাগছে। স্টাডিরুমে সিগ্রেটের ধোঁয়া। কামিনী অনভিজ্ঞ নয়।
— একটা কথা।
কামিনী।
–এখুনি নাহয় না বললে?
শ্রীভূষণ।
–বেশ।
না চাইলেও কামিনীর চোখ একবার নিরিবিলির দিকে।
— আজ আর কেউ আসবে না?
কামিনী আবার।
— না।
শ্রীভূষণ চেয়ার ছেড়ে উঠে তাক থেকে বৈষ্ণব পদাবলী নামিয়েছিল।
নিরিবিলি পড়ে চলে গেছে। ফাল্গুন এসেছে জানান দিতে কোকিলগুলি গাছে গাছে সরব। গতকালই কামিনীকে শ্রীভূষণ বলেছে— কোকিলরা আসলে বলে “আয়, আয়, আয়”, কিন্তু আমরা ওই কুহু কুহু শুনি। শ্রীভূষণ চমৎকার কথা বলতে পারে।
খাওয়াদাওয়ার পরে সে একটু গড়িয়ে নেয়। কামিনীকে ডাকতে হয় না। আজ ডাকতে হল। ডাকতেই কামিনী বলল— কেন?
কিন্তু সে এই ডাক উপেক্ষা করতে পারে না, বিছানায় আসে। পরনে যে তুঁতেরঙের শাড়ি, তার আঁচলে রানিরঙের মিথুনমূর্তি ভরা।
শ্রীভূষণের আদরের আঙুলগুলি অস্থির হয়, ঠোঁটদুটি ছটফট করে, সে জানতে চায়— কি বলছিলে সকালে?
কামিনীর চোখের তারায় নিরিবিলি— আমার ভয় করে।
— ভয় করে? কেন?
অভিজ্ঞতা শ্রীভূষণেরও অল্প হয়নি। কামিনীর শাখাপলার ডান হাতখানা নিজের হাঁটুদুটির উপত্যকায় নিয়ে যেতে যেতে সে বলে— ভয় করছে কেন?
কামিনী কিছু বলতে পারে না।
ফুল স্পিডে পাখা ঘুরছে মাথার ওপর। এই বয়েসে এইসময় একটু বেশি সময় নেয় শ্রীভূষণ, একটু বেশি ঘাম ঝরে তার। অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে কামিনী। বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না অনেকক্ষণ।
— ভাল লাগছে না।
শ্রীভূষণ বলে। কামিনীর অক্ষিগোলক স্থির হয় হঠাৎ।
— ভয় করছে।
শ্রীভূষণ মুখ খোলে আবার। কামিনী তৎক্ষণাৎ উঠে বসে।
— মেয়েটার জন্যে ভয় করছে।
শ্রীভূষণ আবার। কামিনীর ভ্রূ কুঞ্চিত হয়।
— কষ্ট পাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট।
— নিরিবিলি? কি হয়েছে ওর?
— বিপদে পড়েছে।
— মানে?
— ও না ভালোবেসে ফেলেছে, আমাকে।
কামিনী দাঁত দিয়ে আঁচলপ্রান্ত কামড়ায়— তুমি?
0 Comments