নক্ষত্রনীলা
ঢুকতেই অমিত বলল, ‘ঋষি, তুই এত দেরী করে এলি, কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায় বল! সবাই তোর কথা বলছে! ‘কোনো উত্তর করলাম না। কারো দিকে তাকালামও না। গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। মুখোমুখি অমিতাভর সঙ্গে। অমিতাভর একপাশে সমর্পীতা অন্যপাশে সায়ন। সমর্পীতা উচ্চমাধ্যমিক সায়ন ক্লাশ নাইন। অমিতাভ নীলার হাজব্যান্ড।
আমি কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে গেলাম। প্রতিবেশী অনেকেই বসা কিংবা দাঁড়ানো। তারা আত্মীয় কিংবা স্বজনও হতে পারে। আমি সবাইকে চিনিনা। অনুভবে বুঝলাম এরা অনেকেই আমাকে চেনে অথবা আমার নাম জানে। না হলে আমার নামটা নিয়ে চর্চা করছে কেন। অন্ততঃ আমার প্রতি তাঁদের কৌতূহলী দৃষ্টি আমাকে এটা ভাবতে বাধ্য করল। বুঝতে পেরেই আমি প্রচন্ড নার্ভাস। কাউকেই সেটা বুঝতে দিচ্ছি না। একটা অমায়িক ব্যক্তিত্ব তৈরি করে আমি নীলার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।
অমিতাভ ঘরে এল। আমার হাত থেকে ফুলের বোকে টাকে নিয়ে নীলার সামনে রাখল। আমি অমিতাভর দিকে সম্মানসূচক দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা জানালাম। আসলে আমি নীলার মুখেরদিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছিলাম। আজ নিয়ে দ্বিতীয়বার আমার সঙ্গে অমিতাভর দেখা হল।
অমিতাভ আমাকে ইশাড়াতে পাশের ঘরে ডাকল। নীলার পাশ থেকে সরে যাবার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে পাশের ঘরে ঢুকতেই, অমিতাভ আমাকে বলল,’সরি! আপনার মতো ব্যস্ত আধিকারিক কে ফোন করে ডেকে আনার জন্য ক্ষমা চাইছি ‘! আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, ‘ক্ষমা চাইবেন কেন! নীলা আমার ভালো বন্ধু ছিল,আপনি ডাকতেই পারেন’! অমিতাভ শুনল। সামান্য সময় ভেবে বলল, ‘আসলে আমি নীলাকে ফাঁকি দিতে চাইনি বলে আপনাকে ফোন করেছি। আমার ফোন পেয়ে আপনি আসবেন আমি ভাবতে পারিনি’! এইরকম পরিস্থিতিতে অমিতাভর বিনয় দেখে আমি স্তম্ভিত। বললাম, ‘এলাম তো আপনার কথায়’! বলতেই অমিতাভ পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ দেখিয়ে বলল, ‘নীলার লেখার টেবিলে পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা ছিল এই লেখাটা। এটা পড়ে মনে হল আপনাকে না পড়ালে নীলার কাছে আমি অপরাধী হয়ে থাকব। লেখাটা কী একবার পড়বেন’! বলেই ভাজকরা কাগজটা আমার হাতে গুঁজে দিল। আমি পরিস্থিতির মানসিক চাপে কাগজের ভাজ খুলে পড়তে বাধ্য হলাম। নীলা লিখেছে, ‘অমিতাভ, আমি তোমাকেও সুখী করতে পারিনি, ঋষিও আমাকে সুখী করতে পারেনি। আমার যে টুকু নারীত্ব আমি তোমাদের দুজন কে সমানভাবে দিয়েছি। কার্পণ্য করিনি। তোমরা দুজনে কেউই আমাকে নিয়ে সুখী ছিলেনা। আমি তোমার উপর বাড়তি বোঝা দিয়ে গেলাম আমার দুটো সন্তান। ঋষি কোনোদিনই আমার দায় নেয়নি, আমি ছিলাম ওর বসার ঘরের সাজানো এন্টিক। গোপন অভিসারের সাজানো ডলপুতুল। আমি আমার দেহসর্বস্ব শরীরটাকে সহ্য করতে পাচ্ছি না। তাই চলে গেলাম। একটাই আকাঙ্খা আমার অমিতাভ, যদি সম্ভব হয় আমার নিষ্প্রাণ দেহে ঋষিকে দিয়ে অন্তত একটি মালা পরাবার ব্যবস্থা কোরো। ঋষিকে বলো এটা আমার পাওনা ও যেন দেয়। অমিতাভ, তুমি মহান তোমার মধ্যে কোন হীনমন্যতাকে প্রশ্রয় দিও না। তুমিই ছিলে আমার প্রকৃত আশ্রয়। অনুরোধ, আমাকে ঘৃনা কোরো না। ইতি নক্ষত্রনীলা।
ধড়পড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। শ্রীময়ী আমার গোঙানি শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে বলল, “ঋষি, কী হয়েছে তোমার?” আমি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে কম্বল জড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। শ্রীময়ীকে বললাম ভোরবেলা একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখলাম। শুনে শ্রীময়ী বলল জানতো ভোরবেলার স্বপ্ন সত্যি হয়, তুমি কী স্বপ্ন দেখলে!আমি প্রসঙ্গ এড়াতে বললাম, ‘যাচ্ছেতাই স্বপ্ন, কোনো মাথামুন্ডু নেই। খবরের কাগজ দিয়েছে? শ্রীময়ী বলল জান জেলার পাতায় একটা বাজে আত্মহত্যার খবর বেরিয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কে সে?
নক্ষত্রনীলা নামের একজন কবি। শোবার ঘরে গলায় দড়ি দিয়েছে। তুমি চিনতে তাকে?
ভেবে পাচ্ছি না কী বলব আমি শ্রীময়ীকে। আমি তো জানি গতকাল নক্ষত্র আত্মহত্যা করেছে।