নরনারী কথা ( পঞ্চম পর্ব )

মৃত্তিকা মুখার্জি on

noronari_kotha_5

“ঘরে পথে লোকালয়ে স্রোতে জনস্রোতে আমাকে কি একাই খুঁজেছো তুমি?
আমি বুঝি তোমাকে খুঁজিনি? “

দিনগুলো কেটে যেত যেমন তেমন ব্যস্ততার মধ্যে। রাতগুলো নিয়েই যাবতীয় সমস্যা। ভালো করে ঘুমোতে পারতাম না। ঘুমের মধ্যেই চোখের জলে বালিশ ভিজে যেত। দুর্বোধ্য বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখতাম। দিনদিন খিটখিটে হয়ে উঠছিলাম। মাকে সব কথা খুব খুলে বলতে ইচ্ছা করত। সাহস বা মনের জোর সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি!
সেই দিনের পর এক সন্ধ্যেয় খুলে বসেছিলাম বই এর প্যাকেটগুলো। একদম নীচের দিকে একটা বাদামী বেশ মোটা খাম দেখলাম। আশ্চর্য হয়ে এটাতে আবার কি বই ভেবে খুলতেই হতবাক হয়ে গেলাম!
বেশ কিছু চকলেট।ছোট্ট একটা পারফিউম আর নীল কৌটোয় রাখা একটা পেনডেন্ট! ভালো করে দেখি সাদা একটা কার্ডও আছে। হাতের লেখা খুব স্পষ্ট নয়, যেন খুব তাড়াতাড়িতে লেখা!

“তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। আমি খুব খারাপ একটা মানুষ, হয়তো মানুষও নই। এই ছোট্ট গিফ্টসগুলো তোমার জন্যেই নিয়ে এসেছিলাম, নিজের হাতে দেওয়ার মত সুযোগ বা সাহস পেলাম না। একটা অনুরোধ করি ক্ষমা না করো ঘৃনাও করো না আমাকে। এই পৃথিবীতে তুমি আমার জন্য একবুক ঘৃনা নিয়ে বেঁচে আছ এটা জানার পর আমারও বেঁচে থাকা কষ্টকর।”

নিজের অজান্তেই বিন্দু বিন্দু জল জমছিল আমার চোখে।সেদিন নিশ্চয়ই ফেরার সময় কোনো সুযোগে আমার বই এর ব্যাগে প্যাকেটটা রেখেছিল রাজর্ষি। অবশ্য আমি যেরকম অন্যমনস্ক ছিলাম সেদিন খেয়াল করার কথাও না। চকলেটগুলো ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের বিলিয়ে দিলাম। পারফিউম আর পেনডেন্টটা কাউকে দিতে পারলাম না। সেই মুহূর্তে ওগুলো আমার কাছে রাজর্ষির একমাত্র স্মৃতি ছিল। আমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেছি পরে, বিষয়টাতে আমিও যথেষ্ট দায়ী ছিলাম। আমি সেদিন কেন গেছিলাম রাজর্ষির সাথে?কতটুকু চিনতাম আমি ওকে? কেন এতটা বিশ্বাস করেছিলাম ওকে?

আমার কাছে নিশ্চিত উত্তর ছিল, যেটা নিজে কাছেও স্বীকার করতে সংকোচ হয়। আমি রাজর্ষিকে ভালোবেসেছিলাম। আর এতোর পর যে তীব্রতম বিরাগ আমার ওর প্রতি থাকা উচিত ছিল ততটা জোরও নিজের মধ্যে খুঁজে পাইনি আমি।
তীব্র গ্রীষ্মের দিনগুলো পেড়িয়ে আকাশে বর্ষার মেঘ জমছিল। ক্রমশ পড়াশোনার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছিলাম। ইউনিভার্সিটির শেষ পরীক্ষা দরজায় কড়া নাড়ছিল। একাকীত্ব মাঝে মাঝে এতটাই দুঃসহ হয়ে উঠতো আমি বইগুলোর দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকতাম। কবিতা ছেড়ে যাচ্ছিল আমার আঙ্গুল। মনে হত যা হয় হোক রাজর্ষিকে একটা ফোন করি।কিন্তু আমার আর একটা মন বলতো হয়ত ওর জীবনের অনেক অনেক নারীর মধ্যে আমিও একজন। বিশেষ কেউ না, কিচ্ছু না। মাঝরাতে ভুতগ্রস্তের মতো বিছানা থেকে উঠে নিয়ে আসতাম পারফিউমের শিশিটা। গাঢ় বেগুনী রং এর ছোট্ট কাচের শিশি। আলতো করে গন্ধ নিতাম। সুগন্ধে আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠতো। আমার রাজর্ষি মনে পড়তো। ওর হাসি, ওর গম্ভীর গলা… খুব খুব কান্না পেত। কান্না পেত।

পরীক্ষা প্রায় শেষ হয়ে গেলো। সেমিনারটা শুধু বাকী ছিল। রিভিউ পেপারটার ওপর পাওয়ার পয়েন্টের কাজ করছিলাম। শ্রাবণের ঝিরঝিরে বৃষ্টির একটা একঘেয়ে রাত। মন দিয়ে কাজটা করছি , ফোনটা রিং হওয়ার শব্দে মনোযোগ ভেঙে গেল। এত রাতে কে রে বাবা! প্রায় বারোটা বাজতে গেল। ফোনটা অন করে কানে দিতেই…
— একবার ব্যালকনিতে আসা যায়?

আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল। যেন কত যুগের পরে শুনলাম এই গলা। আবার তাগাদা এল
— আসবে? একবারটি? পাঁচ মিনিট?
আমি গলা ঝেড়ে আস্তে করে বললাম
— কেন?
— এসো। বলছি…
আমি পায়ে পায়ে ফোনটা কানে নিয়েই ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের পাড়াটা যথেষ্ট ফাঁকা ফাঁকা। অন্ধকারে কিছুই চোখে পরলো না। হালকা বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে গায়ে। সন্দিগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করলাম
— তুমি কোথায়? কিছুুই তো দেখতে পাচ্ছি না!
বাড়ির সামনের রাস্তাটা পেরিয়ে একটা ছোটো খোলা পোড়ো জায়গা আছে। সেখানে হালকা একটা লাইট দেখা গেল। বুঝলাম ফোনের লাইট। কানেও শুনলাম ফোনের ওদিক থেকে
— দেখতে পাচ্ছ?? “
— হুম। পাচ্ছি। তুমি এত রাতে এখানে করছ টা কি??
— একবার বাইরে এস! প্লিজ…
— না!
— বেশ। তাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে আছি সারারাত। এরপরে তুমি যা ভালো বোঝো।

কিছুক্ষণ অসহায় ভাবে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার একদিকে মনে হচ্ছে সব ভুলে সামনে গিয়ে দাঁড়াই । আবার মনে হচ্ছে ফোনটা কেটে ঘরে চলে যাই। আবার ওদিক থেকে ডাক এলো
— এসো। আমি অপেক্ষা করছি…

আমি আর ভাবতে পারলাম না। আস্তে করে বললাম
— আসছি!
আমি লম্বা ঝুলের একটা লাল স্কার্ট আর কালো টপ পড়ে ছিলাম।দ্রুত একটা সাদা ওড়না গায়ে নিয়ে সন্তর্পণে দরজা খুলে বেরোলাম। মা অনেক আগেই ঘুমিয়েছিলেন তবু খুব টেনশন হচ্ছিল আমার।

রাজর্ষির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল কয়েক যুগ পরে আমাদের এই দেখা। সেই প্রথম দিনের মত ওর আবছা লম্বা শরীরটা চোখে পড়ছিলো আমার। মুখ দেখা যাচ্ছিল না। বেশ খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। আমিই প্রথম কথা বললাম
— হঠাৎ এভাবে? কবে এলে?
— কাল।
— কেনো?
এবার আলতো করে হাত দুটো ধরলো আমার।কানের কাছে ফিসফিস করে বললো
— হ্যাপি বার্থডে রাঙা। আর রাগ করে থেকো না। এবারের মতো মাফ করে দাও।

আমি ভিতরে ভিতরে আমূল কেঁপে উঠলাম। আমার নিজেরই মনে ছিল না আমার জন্মদিন শুরু হয়ে গেছে। রাত বারোটা বেজে গেছে বেশ খানিকক্ষণ। আমি অস্ফুটে বললাম,

— এত দূর থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এলে?

রাজর্ষি কোনো উত্তর না দিয়ে আলতো করে আমার হাতটা ধরে এগিয়ে নিয়ে চললো।দেখতে পেলাম একটু দূরেই ওর গাড়িটা পার্ক করা আছে। দরজাটা খুলে আমায় বসতে বললো। ফের আমরা মুখোমুখি। স্ট্রিট লাইটের কমজোরি আলোটা তেরচা ভাবে পড়েছে ওর মুখে। বেশ রহস্যময় লাগছে। দুজনেই চুপ করে বসে আছি জানি না কত সময়! রাজর্ষি আচমকা আমার একটা হাত টেনে নিয়ে ওর বুকে রাখলো! আমি চমকে উঠে বললাম
— কি করছো?
ও আমার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিল। বললো
— আমি মুখে কিছু বলতে পারলাম না বলে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? একবার বিশ্বাস করে দেখতে?
সেই ডুয়ার্সের দিনগুলো থেকে যখন তাকিয়ে থাকতে আমার দিকে তখন থেকে তোমায় ভালোবাসি। তোমায় বলবার চেষ্টা করেছিলাম একবার,কিন্তু তোমার বন্ধুরা ডেকে নিয়ে চলে গেছিল তোমায়!
খুব রাগ হয়েছিল সেদিন। মনে হয়েছিল হাত ধরে আটকে দি! কেন যাবে তুমি ওদের সাথে? কেন আমাকে কিচ্ছু না বলে চলে যাবে তুমি?
তারপর একবছর হারিয়ে ফেললাম তোমায়। প্রায় সোশাল মিডিয়াতে খুঁজতাম। একদিন পেলাম…

রাজর্ষির কথা ফের আটকে যাচ্ছিল। কষ্ট হচ্ছিল ওর। ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম
— থাক এসব কথা। পরে বোলো। আমি এখন যাই।
ছেলেমানুষের মতো হাত দুটো আঁকড়ে ধরলো আমার,
— না! কোথাও যাবে না। আজ বলতে দাও। আমার ভাষা কম। তোমার মতো কবি নই আমি। কিন্তু মন তো আমারও আছে রাঙা। তুমি কলকল করে গল্প করতে, রাগ করতে, আমাকে ভুল বুঝে দূরে সরে যেতে চাইতে তখনও তোমাকেই ভালোবেসেছি আর অপেক্ষা করেছি একদিন মনের কথা সামনা সামনি বলে দেব। তোমার প্রথম প্রেমিকের কথা বলে তুমি একদিন আমার কাছে কেঁদেছিলে। আমার ভয় করতো রাঙা। যদি আমাকেও ভুল বোঝো। দ্যাখো সেই ভুল বোঝাটা এল। আমার দোষেই এল। যতবার ভাবতাম তোমার সেই প্রেমিককে তুমি ভালবাসতে আমার মাথায় আগুন জ্বলে যেত। আমি কারোর সাথে তোমায় ভাগ করার কথা ভাবতে পারি না। সেদিন যখন তুমি আমার ঘরে আমারই খাটে বসে নিশ্চিন্ত হয়ে সিনেমা দেখছিলে আমার যে কি হল! আমি নিজেকে আটকাতে পারলাম না! তোমাকে পুরোপুরি পেতে চাইলাম। একবারও ভাবলাম না তোমাকে সবথেকে বড় আঘাত দিতে যাচ্ছি। অথচ আমি সেদিন তোমায় শুধু ভালোবাসি বলতে চেয়েছিলাম। আর কিচ্ছু না!

রাজর্ষির গলা ভেঙে আসছিল। কথাও আটকে আসছিল বারবার। আমার চশমার কাচটা ঝাপসা হয়ে গেছিল। আমি জানলার কাচে বৃষ্টি ফোঁটার আলপনা দেখছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর রাজর্ষি গলা ঝেড়ে বললো
— কি হলো! আমার মতো তোমারও কথা আটকে যায় নাকি আজকাল? বলছি ম্যাম এবার কেকটা কাটবেন কি দয়া করে? কষ্ট করে যে বানিয়ে আনলাম!

গাড়ি মৃদু আলোতে দেখলাম ছোট্ট একটা রেড ভেলভেট কেক। ওপরে লেখা
Happy birthday Mrs. Manna
আমি রেগে গিয়ে বললাম
— মিসেস মান্নাটা কে? পরকীয়াও করছো না কি? কতগুলো প্রেমিকার জন্মদিন আজকে?

রাজর্ষি হা হা করে হাসতে হাসতে বললো
— শোকে দুঃখে তোমার মাথাটায় গিয়েছে মহারানী! আমাকে বিয়ে করলে তো মিসেস মান্না হতেই হবে! আমাকে ভজহরি মান্না বলে কে ডাকতো? আমার কি দোষ!

আমি আরও রেগে গিয়ে বললাম
— বিয়ে মানে? কার বিয়ে? আমি মোটেই বিয়ে শাদি করছি না তোমায়।

— তোমায় তো বলিনি! বিয়ে আমি করবো, দরকার হলে জোর করে। তুমি তো জানোই আমি ভালোই জোর করতে পারি আর হাঁদা পাগলী মেয়েটা আটকাতেও পারে না…

আমি ভয়ানক রেগে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই রাজর্ষি চট করে গাড়ির লাইটটা নিভিয়ে আমাকে দুহাতে শক্ত করে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল…
আমি ডুবে যেতে যেতে টের পেলাম এই লোকটার কথা আটকে গেলেও আদর করতে একটুও আটকায় না! এক একটা আলাপ এত অদ্ভুত হয়? এক একটা আলাপ এত দূরও গড়ায়?


পূর্ববর্তী পর্ব…


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


মৃত্তিকা মুখার্জি

বাসস্থান - দুর্গাপুর। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিদ্যা নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা। বর্তমানে পেশা শিক্ষকতা। কলমে ভালোবাসা বলতে কবিতা, প্রেম, সম্পর্ক, মানুষ। সখ বলতে বই, তেল রং,এবং মানুষকে জানা। প্রকাশিত লেখা - অপদার্থের আদ্যক্ষর, ব্ল্যাকবোর্ড, মাসিক কৃত্তিবাস ,শনিবারের আসর ইত্যাদি।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।