নরনারী কথা ( প্রথম পর্ব )

মৃত্তিকা মুখার্জি on

noronari_kotha_1

“কি হয় ? কি হতে পারত? এসবে কি কিচ্ছু এসে যায়?
চোখে চোখ পড়ামাত্র ছোঁয়া লাগলো চেখের পাতায়-“

রাজর্ষিকে প্রথম দেখি ডুয়ার্সে। ফেব্রুয়ারি মাসে। আমরা কলেজ থেকে সেবার এক্সকারসনে গেছিলাম। আমাদের ডিপার্টমেন্টের তিনটে ইয়ার মিলে প্রায় পঁচিশজন। তিনজন প্রফেসরও ছিলেন।

সত্যি কথা বলতে এর আগে এভাবে একা একা কোথাও যাইনি। আমাদের মা মেয়ের ছোট্ট পুরুষ বর্জিত সংসার, মা খুব আগলে আগলে রাখতেন। সেই জন্যেই বোধহয় বড় থতমত ছিলাম বরাবর।

তো রাজর্ষিকে প্রথমবার দেখি আমাদের হোটেলের ডাইনিং রুমে। আমরা থার্ড ইয়ারের পোলাপানগুলো একটা টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম কম গুলতানি করছিলাম বেশি। বেশ রাত, ডাইনিং রুমটার জানলার কাঁচের বাইরে ঝুপসি হয়ে আছে অন্ধকার। আর দেখলাম তিনটে ছেলে হুড়মুড় করে করে এসে ঢুকলো ডাইনিং রুমে। সকালে এদের দেখিনি। হয়ত একটু আগে এসেছে। ওরা কোন দিকে না তাকিয়ে খাওয়া দাওয়া করছিলো।একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম ওদের মধ্যে লম্বা, কালো, পনিটেল করে চুল বাঁধা ছেলেটি চামচে করে প্রতিবার খাবার মুখে নেওয়ার আগে একবার নাকের কাছে নিয়ে কিছু যেন পরখ করে নিয়ে খাবারটা খাচ্ছে। গভীর মনোযোগের সাথে এমন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কাউকে খেতে দেখিনি আগে। আমি অবাক হয়ে বিষয়টা দেখছিলাম নিজের খাওয়া ফেলে। পল্লবী আমার হাতে চাপ দিয়ে বললো,

— ঐ ছেলেগুলোকে ওমন হাঁ করে দেখছিস কেন? ঝাড়ি মারছিস? কোনটা?

আমি হ্যাট বলে মুখটা সরিয়ে নিতে গিয়ে দেখি চামচ টেস্টার ছেলেটাও একটু ভ্রু কুঁচকে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি ঝাড়ি টারি যদিও চাইনি একেবারেই, চটপট খাওয়া দাওয়া সেরে ঘরে চলে গেলাম।

পরের দিনটা জলদাপাড়ায় জঙ্গল সাফারি করতে কেটে গেল। জিপ এ কৃশানুর পাশে বসেছিলাম। ওর মেল ডিও আর নিজস্ব পুরুষালি ঘ্রাণ বারবার পাচ্ছিলাম। গন্ধটা ভারী পরিচিত। কৃশানু কলেজের প্রথম দিনগুলো থেকে আমার খুব কাছের বন্ধু। চুপিচুপি বলি আমার দিক থেকে আরও একটু বেশী। ওর কথা অবশ্য জানিনা। বন্ধু ছাড়া আর বেশি কিছু ভাবে বলেও মনে হত না। অবশ্য ওর করমচার মতো গায়ের রঙ, নরম দাড়ির আভাস , ভাসা ভাসা চোখ, বড় সুন্দর পুরুষ কৃশানুটা। ভালো আবৃত্তি করে ছেলেটা। একটার পর একটা সুনীল বাবুর কবিতা কি অবলীলায় ভরাট গলায় নিখুঁত উচ্চারণে ওকে বলতে শুনেছি আমি। ক্যান্সার নিয়ে রিসার্চ করার স্বপ্ন দেখে, ওকে মানায় স্বপ্ন দেখা। ওকে দেখে একটা মনখারাপ হয়। বুঝতে পারি, ওর মতো ডাকসাইটে ছেলে আমাকে পাত্তা দিতে যাবে কোন দুঃখে।

কিন্তু… হাওয়াতে বারবার আমার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। কৃশানু আমার ঝুরো চুলগুলো কানের পাশে সরিয়ে দিতে দিতে আলতো করে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলছিল
— তোর সাথে একটা খুব জরুরী দরকার আছে রে রাঙা! খুব দরকারী একটা কথা বলতে ভুলে যাচ্ছি খালি…

আমার পেটে ছোট্ট একটা নীল মাছ ঘাই দিয়ে উঠেছিল। কৃশানুটা এত চেনা তাও সেই মুহুর্তে কেমন একটা… আমার সেই মুহূর্তে ওর চোখের দিকে দেখতে ইচ্ছে করছিল না। কি জানি কি দেখে ফেলব!

হোটেলে ফিরে মেঘ, রিজুল আর বিশ্বজিৎরা যে ঘরটায় ছিলো সেই ঘরেই সবাই আড্ডা দিচ্ছিলাম। কফি পকোড়া আর ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার খেলা জমে উঠছিল সন্ধ্যে নামবার সাথে। রিয়া ডেয়ার নিয়ে এস. বি. ম্যামের সাংঘাতিক মিমিক্রি করছিল আমার চশমাটা নাকের ডগায় এঁটে। শেষতক কোল্ড ড্রিঙ্কস এর বোতল কৃশানুর দিকে ঘুরলে একটু চুপ করে থেকে দুম করে বললো ট্রুথ। সংযুক্তা জানতে চাইলো তোর ওপর ক্রাশতো ইংলিশ থেকে ভূগোল সবাই খেয়ে বসে আছে, তোর ওগো কে বলবি? মানে কার জন্য তোর মাঝরাতে চুমু টুমু পায়!

সবাই বেশ উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। বেশ খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে থেকে নিজের ঠোঁটের ওপর অকারনেই একবার আঙ্গুল বুলিয়ে কৃশানু গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে আমার গালে আলতো টোকা দিল। কৃশানুটা মুচকি মুচকি হাসছিল। ঘরে সবাই আমাদের নিয়ে যাচ্ছেতাই লেগপুল করছিল। অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছিল, ভালো লাগছিলো, লজ্জা করছিল, কৃশানুর গা জ্বালানো হাসি দেখে রাগ ও ধরছিল,মনে হচ্ছিল ওকে খুব করে কামড়ে খিমচে দি। আমাকে আড়ালে বলতে কি হয়েছিলো! আমার নিজের কানে কানে বলতে ইচ্ছে করছিল, রাঙা? তোর কি নিজের একটা গল্প হবে?

রাতে খুশিমনে খেতে এলাম ডাইনিং রুমে। আমি নিজের মনে হেসে ফেলে খালি সেই হাসি লুকিয়ে ফেলতে চাইছিলাম! সেই ছেলেগুলোও ছিলো। এরা বেশ অদ্ভুত। কথাবার্তা নিজেদের মধ্যেও তেমন বলে না মনে হয়। আজ দেখলাম সেই খুঁতখুঁতে ছেলেটি বেজায় অখুশি। কেমন গম্ভীর মুখ করে খাচ্ছে।

হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ছিল কিচেনের দরজার একটু পাশেই। হাত ধুতে ধুতে শুনলাম ছেলেটা কুককে কি সব বলছে গুজগুজ করে। তন্দুরী চিকেনের ওপরটা পুড়েছিলো বেশী, ক্রিশপ হয়েছিল কম ,পুদিনার চাটনির কি একটা কম্পোজিশন এই সব হিজিবিজি টুকরো টুকরো কানে আসছিল। কুকটাও দেখলাম দিব্যি হেঁ হেঁ করছে!
আমি নিজে যেমন খেতে খুব ভালোবাসি। অবশ্য আমাকে দেখলেই যে কেউ সেটা আন্দাজ করতে পারবে। ছোটোখাটো বেশ ভালোই গোলগাল মানুষ আমি। তবে এই ছেলেটা এমন গিন্নীমার মতো রান্নাবান্না নিয়ে এত উদ্বিগ্ন কেন বুঝতে পারলাম না। ছেলেটা বোধহয় বুঝতে পারছিল আমি ওকে আড়চোখে লক্ষ্য করছি। আমি আর ওখানে দাঁড়ালাম না।

মুখে ক্রিম মেখে, চুল বেঁধে জল খেতে গিয়ে দেখি জল নেই। মেয়েগুলো এত গপ্পবাজ জল যে নেই খেতে যাবার সময় দেখে নি। ফোন করলেও চলতো তবু ভাবলাম থাক নিয়েই আসি কিচেন থেকে।সংযুক্তা বাথরুমে আর পল্লবী ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে মশগুল হয়ে গল্প করছে। আমি ছোটো একটা নিশ্বাস ফেলে একাই বেরোলাম।জল নিয়ে আসছি।জাগ
টা বেশ ভারি। কৃশানুর বিষয়টা মনে মনে ভাবছি। একটা ভালো লাগা হালকা চাদরের মত ঘিরে আছে আজ যেন আমায়। ঠাণ্ডা একটা হাওয়াতে শীত শীত করছিল একটু। বোধহয় সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম। হটাৎ একটা পাথরে পা আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম,কেউ আমার ডান হাতটা চেপে ধরে সামলে নিল। জলের জাগ্ টাও আরেক হাতে সামলে নিল। আমি থতমত অবস্হাতেও হালকা একটা সিগারেটের গন্ধ পেলাম।একটু ধাতস্থ হতেই বুঝলাম আমার সামনে লম্বা একটা ছায়া। জায়গাটা একটু অন্ধকার। ভালো করা মুখ দেখা যাচ্ছে না। অপ্রস্তুত হয়ে ধন্যবাদ দিলাম রক্ষাকর্তাটিকে। তিনি আরও সংক্ষেপে বললেন হুমম্। আর কথা না বাড়িয়ে এগোচ্ছি ; একটু গলা খাঁকড়ে গম্ভীর গলায় খুব কেটে কেটে বললেন,

— অন্ধকার বেশ। কটেজ অবধি এগিয়ে দি।

একটু ভয় ভয় করছিল না যে তা নয়। কিন্তু কি যে বলি ভাবতে ভাবতে টুক করে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম। রুমের সামনের খোলা জায়গাটাতে হালকা আলো পড়ছে। রুমে যাওয়ার আগে একবার পিছন ফিরে দেখলাম এ তো সেই পনিটেল বাঁধা খুঁতখুঁতে লোকটা!বেশ খানিকটা দুরে দুহাত বুকের ওপর জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকেই। ঘাবড়ে গিয়ে চট করে রুমে ঢুকে পড়লুম। এই বিষয়ে কাউকে কিছু বললাম না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়ি, কানের দুল টুকিটাকি একটা বক্সে গুছিয়ে রাখছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো ডান হাতের ওপর দিকটাতে আঙুলের হালকা দাগ বসে গেছে। আমার ফ্যাকাশে সাদা রং এর ওপর হালকা লাল হয়ে ফুটে আছে। এটা একটা সমস্যা আমার, কেউ সামান্য জোড়ে ধরলে বা একটু চাপ লাগলেই চামড়ায় লাল দাগ হয়ে যায়। আঙুলের দাগটা দেখে আমার একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো। এই নিয়ে আর বেশি না ভেবে চুপচাপ চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন বিকেলে আমাদের ফেরার ট্রেন। সকাল বেলা কাছাকাছি ঘুরে আর টুকটাক শপিং করে কেটে গেল। আমি ছোট্ট একটা কাঠের তৈরি হাত আয়না আর কাঠেরই ছোট ছোট গন্ডারের শোপিস্ নিলুম। কেনাকাটা করতে বরাবর খুব ভালো লাগে। দুপুরের পর গোছগাছ প্রায় সব শেষের দিকে।হলুদ রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরে তৈরি হয়ে নিলাম। বেরোতে তখনও প্রায় এক ঘন্টার মতো দেরি ছিল। কটেজের সামনের দিকের বাগানের দোলনাটায় বসে একটু একটু দোল খাচ্ছিলাম। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কালকের সেই ছেলেটা লম্বা লম্বা পা ফেলে আমার দিকেই এগিয়ে এলো।একদম সামনে এসে দোলনাটার শিকলে হাত রেখে দাঁড়ালো। একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বললো,

— যদি কিছু মনে না করো একটু কথা বলতে পারি?
তুমি আমার থেকে বেশ ছোটো হবে বয়েসে তাই তুমি করেই বলছি।

কি বলবো বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। এই প্রথমবার মনে হলো ছেলেটির কথা বলতে একটু সমস্যা হয়, একটু আটকে যায়। সম্ভবত এই জন্য খুব কেটে কেটে কথা বলে আর খুব কম কথা বলে। আবার একটু চুপ থেকে সে বললো,

— আমি রাজর্ষি। May I know your name mam?

আমি চুপ করে আছি দেখে ফের নিজেই বললো
— আজ তোমরা চলে যাচ্ছ না?

— হুম। বিকেলের ট্রেন। আপনারা সেদিন এত রাতে এলেন। কোন ট্রেনে এলেন?

— কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে এসেছি। কাল আমরাও বেরিয়ে যাব। ট্রেকিং এর প্ল্যান আছে।

আমি কি বলবো ভেবে না পেয়ে শুধু বললাম
— ও!

আমি ভেবে পেলাম না ছেলেটা আমার সাথে এত কথা বলছে কেন! তাকিয়েও আছে আমার দিকেই। একটু অস্বস্তিকর বিষয়টা। এই সময় তিন চারটে গলার কচকচি শুনে সেই দিকে তাকিয়ে দেখি রিয়া, মেঘ আর কৃশানু এদিকেই আসছে। আমাকে দেখেই তিনজনেই বলে উঠলো!

— there she is!

কৃশানু একটু বিরক্তি নিয়ে বললো,
— কি ব্যাপার তোর। এখানে কি করছিস? জে.বি. স্যার বেরোবার আগে সবাই কে দেখা করতে বলছেন।

স্যার মহা রাগী মানুষ। চট করে দোলনা থেকে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। পিছন থেকে আলতো ডাক এলো,
— নামটাও কি বলবে না ম্যাম?

আমি ঘাড় ফিরিয়ে আলতো হেসে বললাম
— আমি রঙ্গনা। রঙ্গনা বসু।


ক্রমশ…


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


মৃত্তিকা মুখার্জি

বাসস্থান - দুর্গাপুর। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিদ্যা নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা। বর্তমানে পেশা শিক্ষকতা। কলমে ভালোবাসা বলতে কবিতা, প্রেম, সম্পর্ক, মানুষ। সখ বলতে বই, তেল রং,এবং মানুষকে জানা। প্রকাশিত লেখা - অপদার্থের আদ্যক্ষর, ব্ল্যাকবোর্ড, মাসিক কৃত্তিবাস ,শনিবারের আসর ইত্যাদি।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।