নীল মায়া প্রান্তরে
নেফেরুরে ঠিক চিনতে পারে না মা কে।বছর তিন হোল বিচারালয়ের কাজে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই রাজ পরিবারের অনেক গোপন তথ্য সামনে এসেছে ওর।প্রথমে আহমোস ও পরে সেনেমুতের ত্বত্তাবধানে রাষ্ট্রনীতি ও আইনের যে শিক্ষা ও পেয়েছে হাতসেপসুত নিশ্চিত মনে ঈজিপ্ট এর আইন সংরক্ষনের দায়িত্ব ওকেই দিতে পেরেছে। মাত্র চোদ্দ বছর রাজত্ব করে আচমকাই জটিল চর্মরোগে মারা যাওয়ার কদিন আগে বেশ কিছু কথা বলতে চেয়েছিল ওর বাবা দ্বিতীয় তুতমোসিস। সেদিন টা বেশ মনে আছে নেফেরুরের।বিমাতা ঈসেত তার ছেলেকে নিয়ে কাছেই ছিলেন।প্রায় বাকশক্তিহীন ফারাও হাতের ইশারায় কাছে ডাকেন মেয়েকে।হাতসেপসুত সেদিন ফারাও এর অসুস্হতা বশত অনুপস্হিতি তে কার্নাক মন্দিরে র ভিত্তি প্রস্হর স্হাপনে গেছেন।সারা শরীর মসিবর্ন ধারন করেছে ফারাও এর।দু পায়ে প্রকট হয়ে উঠেছে শিরা উপশিরা।কাঁপা হাতে ভেষজ নির্যাস মেশান পাত্রটিকে সরিয়ে দিতে বলেন তিনি।অথচ পরিচারক হেজেফি হাতসেপসুতের নির্দেশ মত ফারাও কে ওটা না খাইয়ে যাবে না।নেফেরুরে ওকে আশ্বস্ত করে যেতে বলে।চোখের কোনে গড়িয়ে পরা জল আর আকূতিমাখা দৃষ্টিতে দ্বিতীয় তুতমোসিস মেয়েকে অনুরোধ করেন পানীয়টি ওকে না দিতে।ঈসেত কে সরে যেতে বলে কাছে ডাকেন নেফেরুরেকে।কিন্তু উত্তেজনা ও ইশারার পরিশ্রমে দূর্বল ফারাও জ্ঞান হারান।তিন দিন অচেতন থাকার পর মারা যান দ্বিতীয় তুতমোসিস।নীলের পশ্চিম প্রান্তে রাজ পরিবারের নির্দিষ্ট মমি প্রস্তুতকারকের কাছে ফারাওএর মৃতদেহ পাঠাবার আগে রূদ্ধদ্বার কক্ষে একটা গোটা দিন কেন তার দেহ রেখে দেওয়া হয়েছিল এখন একটু একটু করে বুঝছে নেফেরুরে।একুশ বছরের রাজকন্যা।যার ভবিষৎ স্বামী ছয় বছরের ছোট তৃতীয় তুতমোসিস কে নামমাত্র পাশে রেখে দেশের দায়িত্বাধীন প্রবল প্রতাপশালী ওর মা হাতসেপসুত।
মিশরবাসী রা অন্ধের মত বিশ্বাস করেছে দেবতা আমুনের আশির্বাদেই মা আহমোসের গর্ভে আসে হাতসেপসুত।অকালে দ্বিতীয় তুতমোসিসের চলে যাওয়া ও তার আগে নাবালক রাজপুত্রের হয়ে সাম্রাজ্য তাকেই সমর্পন করার কথা ও মেনে নিয়েছে তারা।এসব ই সম্ভব হয়েছে সেনেমুতের জন্য।তুখর কূটনৈতিক জ্ঞান লোকটার। তামার পাতের নকল দাড়িটা ঠিক করতে করতে সামনের আয়নায় আত্মজার অবয়ব ফুটে উঠতে দেখল হাতসেপসুত।মিশরের প্রবল পরাক্রমী মহিলা ফারাও।পুরুষতান্ত্রিকতার একচ্ছত্র প্রভাব কে করায়ত্ব করতে মিথ্যে পৌরূষের আড়াল নিতে হয়েছে তাকে।কিন্তু মনে মনে তো সে মা।একমাত্র সন্তান নেফেরুরে তার একমাত্র জাগতিক দূর্বলতার কারন।আজকাল মেয়ের অভিব্যক্তিতে কেমন অবিশ্বাস ও সন্দেহের ছায়া দেখতে পান হাতসেপসুত।দুহাতে আলিঙ্গন করে নেফেরুরেকে জানালেন আর তিন চন্দ্রকালের মধ্যেই কার্নাক মন্দিরের উদ্ভোধন হবে। আর সেই হেসের হেসেরু মন্দিরে তার মূর্তি তৈরির তত্বাবধানের দায়িত্বে নেফেরুকেই থাকতে হবে।
মাথার উপর নীল আকাশ দিগন্ত বিস্তৃত বালিয়ারি আর দিগন্তরেখায় মিশে বয়ে চলা নীলনদ ছোট থেকেই ভিষন টানত ওকে।শেষ কয়েকমাসে নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পরছিল নেফেরুরে।এই সময়ে মায়ের এই প্রস্তাবে খুশীই হয় সে।
একমনে বাটালির আঘাতে দুধসাদা বালি পাথরের পরত গুলো মসৃন ভাবে উঠে আসছিল।সূর্য এখন মাথার ওপর।বালিয়ারি থেকে হালকা গরম ভাপ উঠছে।অল্প অল্প ঘামে ভিজে উঠছে হাত।ছেনি টা পাশে রেখে মাথার লিনেন পাগড়ির প্রান্তভাগটা দিয়ে মুখ মুছতে পাশ ফিরতেই চমকে উঠল জিয়াদ।সেনেমুতের অন্যতম শিষ্য সে।স্হাপত্য ও ভাস্কর্য বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী।বছর চব্বিশের সুঠাম যুবক।ফারাও এর মূর্তি ও এই মন্দিরের ভাষ্কর্য তৈরির প্রধান দায়িত্ব তার।মুগ্ধ হয়ে তার কাজ দেখছিল নেফেরুরে।মনে মনে রূষ্ঠ হোল জিয়াদ।মাত্র তিন চন্দ্রকালের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে হবে।এমন গুরুত্বপূর্ন কাজের সময় বাইরের কারো উপস্হিতি মোটেই কাম্য নয়।সহকারি দুজন কে জোর গলায় ডেকে অনাহূত অতিথি কে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিল সে।সহকারি দুজন ও নেহাত ই নতুন।তারা কেউ চেনেনা রাজকুমারিকে।অপমানে রক্তিম হয়ে উঠল নেফেরুরে। নিজের প্রীয় কালো ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বিদ্যুৎগতিতে মন্দির চত্বর ছেড়ে সোজা রাজসভার দিকে গেল ।ধূলোয় ওড়া চত্বরে আবার নিজের কাজে মন দিতেই প্রৌঢ় আকিল এসে জিয়াদকে জানাল কতবড় ভুল করেছে সে।সেভাবে ব্যাপারটা জিয়াদের বোধগম্য হোল না যতক্ষন না দুদিন পরে সেনেমুতের তলব এল ওর কাছে।
একটানা একটা চাপা গুমগুম আওয়াজে ঘুমটা ভাঙতেই বিরক্তি তে উঠে বসল হেরপটাস।শব্দটা যেন মাটির নীচ থেকে আসছে।সঙ্গে একটা ক্ষীন মন্ত্রোচ্চারনের আওয়াজ।তুতমোসিস 2 বেঁচে থাকতে শহরের প্রধান পুরোহিত হেরপটাস সম্মান ও সাম্মানিক যা পেয়েছেন বেশ কয়েক পুরুষ বসেই খেতে পারবে তাতে।কিন্তু হাতসেপসুত ফারাও হওয়ার পর তার প্রাধান্য কমেছে। নারী হয়ে তার এই পরাক্রম কিছুতেই মানতে পারেননি হেরোপটাস।কিন্তু অসম্ভব চতুরতায় হাতসেপসুত প্রজাদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছেন তার দৈবি জন্মসত্যতায়।জ্যেষ্ঠ সন্তান আকিল কে নতুন ফারাও এর কূটনৈতিক সভার সদস্য করে তার বৈদেশিক ব্যাবসায়িক সম্পর্ক স্হাপনের গোপন খবরাখবর সংগ্রহ করার কাজ টা ভালোই চলছিল।সময়মত সেটা কাজেও লাগত হয়ত যদি না আকিল বজ্রপাতে মারা যেত।বজ্রদেব সেটের অভিশাপ তার পরিবারে নেমেছে ভেবে অনেকেই তাদের এরিয়ে যেতে শুরু করেছে।কয়েকমাস হয়েছিল আকিলের বিয়ের।মেয়ে সামাইরা কয়েকমাসের গর্ভবতী।সন্তান জন্মালে পিতৃপরিচয় লাগবে ভেবে তাড়াতাড়ি ছোট ছেলে জিয়াদের সঙ্গেই তার পুনর্বিবাহ দেন হেরোপটাস।এই ছেলেটা ছোট থেকেই ব্যাতিক্রমী।অসম্ভব ভালো ভাস্কর্য আর স্হাপত্য বিদ্যায় পারদর্শী জিয়াদ কে ফারাও এর প্রধান পরামর্শদাতা সেনেমুত কানার্ক মন্দিরের কাজে বিশেষ দায়িত্বে বহাল করেছেন।কিন্তু নিজের কাজে এতটাই মগ্ন রাজনৈতিক গোপন তথ্য সংগ্রহে মোটেই আগ্রহী না জিয়াদ।সামাইরা আর জিয়াদের বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই মন্দিরের কাজে যুক্তদের জন্য তৈরি বিশেষ এলাকায় চলে যায় সে।কিছু দিন পরপর বাড়ি এসে দেখা করার কথা থাকলেও অনেক সময়ই জিয়াদ ভুলে যায়। কাল মধ্যরাতে ফিরেছে সে।হেরোপটাসের প্রীয় সন্তান।ঘুম ভাঙতেই তার ঘরের জানলা দিয়ে দেখলেন ত্রয়োদশীর চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় ঘুমন্ত জিয়াদের মাথার কাছে বসে দুলে দুলে কি এক অবোধ্য মন্ত্রোচ্চারন করছে সামাইরা।আলুলায়িত চুলে স্ফীতদোরা কন্যা কে দেখে শিউরে উঠলেন তিনি।কালকেই ইশিনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।ইশিন তার স্ত্রী।সন্তান দের মা।তিনিও তার সহোদরাকেই বিয়ে করেছিলেন।
কাঠের ঘুঁটিটা গড়াতে গড়াতে পায়ের কাছে এসে থামতে একটু ঝুঁকে ওটাকে নিয়ে সেনেটের যে ঘরে বসাল জিয়াদ প্রতিপক্ষের আর কোন চাল সম্ভব হোল না তারপর।বেশ কিছুক্ষন ভাবার পর সেনেমুত হার স্বীকার করলেন।সবুজ কাজলমাখা দুই চোখের কৃতজ্ঞতা মাখান দৃষ্টি ছুঁড়ে ভিতর কক্ষে চলে গেল যে তাকে বড় চেনা চেনা লাগল জিয়াদের।তেইশ বছরের জীবনে এক অদ্ভুত বিড়ম্বনায় পরেছে নেফেরুরে।সেদিন মন্দির প্রান্তে যথেষ্ট অপমানিত হয়ে নালিশ করেছিল পিতৃপ্রতিম সেনেমুতের কাছে।তখনি জানতে পারে সেনেমুতের বড় প্রীয় খামখেয়ালি জিয়াদের কথা।তাকে বুঝিয়ে দেবেন বলেই ডেকে পাঠান হয়েছে আজ।কিন্তু রাজকুমারির চাল দানে যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল সে এবারের মত তাকে মাফ করাই যায়।
সেনেমুতের প্রস্তাব টা বোধগম্য হোলনা জিয়াদের।মন্দির চত্তরের কক্ষ খালি করে এই ভবনে থেকেই আপাতত কাজ সারার মানে নির্মিত মূর্তিগুলো আবার মন্দির পর্যন্ত বয়ে নিতে হবে।উপরন্তু অন্যান্য কাজের পর্যবেক্ষনে যাতায়াতেও সময় ব্যায় হবে।কিন্তু সেনেমুত ওর কোন কথাই শুনলেন না।শেষে বললেন রাজকুমারি নেফেরুরে নিজে এই কাজের তত্বাবধান করবেন।তার অতদুর যাতায়াত করা ঠিক হবে না তাই এই সিদ্ধান্ত।আজই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দুজন সহকারি কে নিয়ে জিয়াদ যেন এই ভবনে চলে আসে।জিয়াদের শ্বেত অশ্বটা ভবনের প্রধান দ্বার ছাড়িয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় জানতেও পারল না নেফেরুরের দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টি তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
শ্বেতপাথরের টেবিল থেকে পানীয়ের পাত্রটাকে জোড়ে ঠেলে দিল তুতমোসিস 3।মা ঈশেত অনেক বুঝিয়েও শান্ত করতে পারলেন না ওকে।সবকিছু একটু একটু করে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।আইনত ফারাও এর সিংহাসনের একমাত্র দাবিদার হওয়া সত্বেও বিমাতার এই একচ্ছত্র অধিকার কিছুতেই মানতে পারে না তুতমোসিস।বেশ কিছু সভাসদ ওর পক্ষ নিয়ে হাতসেপসুত কে বোঝানোর চেষ্ঠা করেছিল কিন্তু তাদের বেশ কয়েকজন নিখোঁজ।ক্ষমতা করায়ত্ব করতে যে নিজের স্বামী কে সরিয়ে ফেলতে পারে তার পক্ষে বাকিদের সরানো কোন ব্যাপার না।যদিও পিতার ধীর বিষক্রিয়ার কোন শক্ত প্রমান এখনো নেই তুতমোসিস 3 এর হাতে।তবে যেদিন সেটা হাতে এসে যাবে নিজেকে ফারাও ঘোষনা করার পথে অনেকটাই এগোতে পারবে ও।আজ তেমন ই একটা প্রমান পাওয়ার কথা ছিল।তুতমোসিস 2 এর প্রধান পরিচারক কে তাঁর মৃত্যুর পরই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।নীলের পশ্চিম প্রান্তের এক প্রত্যন্ত গ্রামে কয়েকদিন আগেই তার সন্ধান পায় ও।দুজন বিশ্বস্ত কর্মচারী কে পাঠায় ঐ পরিচারক কে নিয়ে আসার জন্য।লোকটিকে ধরেও আনে তারা।কিন্তু অতিরিক্ত মাদক সেবনে স্মৃতিশক্তি প্রায় লোপ পেয়েছে তার।প্রধান চিকিৎসক কে দিয়ে চিকিৎসা করালে জানাজানি হবে।তাই এই রোগের চিকিৎসা করার মত দক্ষ চিকিৎসকের সন্ধান করতে গিয়ে জানা যায় প্রাক্তন পুরোহিত প্রধান হেরোপটাস এ কাজে বিশেষ পারদর্শী।কিন্তু বড় ছেলে বজ্রপাতে মারা যাওয়ায় তার মৃতদেহের মমি করতে মমি প্রস্তুতকারক রা বজ্রদেবতা সেটের অভিশাপের ভয়ে মানা করার পর থেকে তিনি আর চিকিৎসার কাজ করেন না।মরুভুমির শুকনো বালি পাহাড়ে নিজ চেষ্ঠায় ঐ মৃতদেহকে সংরক্ষনের কাজে ব্যস্ত তিনি।নিজেই তার কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তুতমোসিস।
ইশিন গোলাকৃতি পেষাই যন্ত্রে যব পিষছিল।প্রতি বার দুহাত দিয়ে যব চুর্ন একটা পাত্রে জমা করছিল সামাইরা।মায়ের প্রশ্নের কোন জবাব দেয়নি সে।ইশিন জানতে চেয়েছিল নীলের পশ্চিম প্রান্তে মিশকা বুড়ির গুহায় ও কেন যায়? পরপর দুই চন্দ্রকাল ইশিন ওকে অনুসরন করেছে।গর্ভকালে মাঝরাতে এভাবে ঐখানে যাওয়া খুবই সন্দেহজনক।জিয়াদের মন পেতে এটা ওকে করতেই হচ্ছে।কি করে মা কে বলবে আকিলের সন্তানকে শরীরে ধারন করলেও জিয়াদে র অনুরক্ত ও সেই মেয়েবেলা থেকেই।কিন্তু আজ ও জিয়াদ ওকে মন দেয় নি।মিশকা বুড়ি যা চেয়েছে সেটা দিলেই জিয়াদ ওর হবেই বলেছে।আর কিছু দিনের অপেক্ষা মাত্র।
কার্নাক মন্দিরের উদ্বোধন সম্পন্ন হওয়ার আর এক পক্ষকাল বাকি।নেফেরুরের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময় এটা।কাজকর্ম যেভাবে এগোচ্ছে আর দিন তিনের মধ্যেই সব সম্পূর্ন হবে।রাতদিন এক করে কাজ করছে জিয়াদ।সেদিন অমানিশার অলৌকিক এক রাত নেমেছিল ঐ মরূপ্রান্তরে।যত দূর চোখ যায় সাদা বালি চিকচিক করছে।হাতসেপসুতের মর্মর মূর্তির কাজ গতকাল ই সম্পূর্ন হয়েছে।নিজের হাতেই হলদে মর্মরের ধূলো মুছে উজ্জ্বলতা বাড়াচ্ছিল জিয়াদ।নিঃশব্দে পিছনে এসে দেখছিল নেফেরুরে।অস্ফুটে বলে উঠল অসাধারন।চমকে পিছন ঘুরে রাজকুমারী কে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল জিয়াদ।ফিনফিনে সাদা মলমলের পা ঢাকা পোষাকে কক্ষের উজ্জ্বল মশালের আলো ও বহির্প্রান্তর থেকে আসা মৃদু মহাজাগতিক আলোর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কোন দৈবি সৌন্দর্যের মত স্হির রাজকুমারির মুখের সঙ্গে আশ্চর্য মিল ঐ মর্মর মূর্তির।অথচ হাতসেপসুতের সঙ্গে খুব বেশী মিল নেই নেফেরুরের।তবে কি করে এ সম্ভব হোল।দুহাতে মাথা চেপে ঝুঁকে পড়ল জিয়াদ।এমন কাজের মূল্য ওকে দিতেই হবে।দুহাতে ওর কাঁধ ধরে তুলল নেফেরুরে।একটাই সমাধান এর।তামার কৃত্রিম দাড়ির আদল ফুটিয়ে তুলতে হবে কাল রাতের মধ্যেই।সেনেমুত ও তার সঙ্গী রা পরশু পরিদর্শনে আসবে।ঘুমন্ত মরুশহরের বুকে এক রহস্যের সাক্ষী হয়ে থাকল সেদিনের অমানিশা।আর দুই তরুন তরুণীর মাঝে শুরু হোল এক নতুন অধ্যায়।
গুহার দেওয়ালে প্রতিচ্ছবিত নিরলস হেরপটাসের দুই হাত আজ ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছেছে।আকিলের মমি তৈরির কাজ সম্পূর্ন হয়েছে।কিন্তু ওর সব পছন্দের জিনিস সঙ্গে দিয়ে পারিবারিক সমাধিকক্ষে কফিন রাখার কাজ সেদিন ই হবে যেদিন হতসেপসুত কে ওর উপযুক্ত প্রাপ্য দিতে পারবে।স্মৃতি বিলুপ্ত সেকেনিল কে এই গুহায় রেখেই চিকিৎসা করছে হেরপটাস তুতমোসিস তিনের অনুরোধে।ভবিষৎ ফারাও কে হাতে রাখলে আবার নিজের হৃত সম্মান পুনরূদ্ধারের সুযোগ রয়েছে।তুতমোসিস 2 এর মৃত্যু রহস্য একমাত্র সেকেনিলের জানার কথা।হাতসেপসুতের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার এই একমাত্র পথ।
কাঁপা কাঁপা মশালের আলোয় গুহাপথ বেয়ে নীচে নামার সময়ে অদূরে স্ফীতোদরা সামাইরা কে পিছনের পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যেতে দেখল হেরপটাস।
নেফেরুরে এখন আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেনা।জিয়াদ এর সঙ্গে মেশার পর জীবনের এক অন্য মানে খুঁজে পেয়েছে ও।কার্নাক মন্দির উদ্ভোদনের দিন সেনেমুতে র চোখে অপার বিস্ময় দেখেছে নেফেরুরে।নিজের মর্মর মূর্তি দেখে হতবাক হয়েছিল হাতসেপসুত ও।বিগত তিন রাতের নিরলস পরিশ্রম ও নেফেরুরের উৎসাহ ছাড়া এ সম্ভবপর হোত না।কিন্তু জিয়াদের মানস চোখে শুধুমাত্র নেফেরুরেই আছে সেটা ওরা দুজনেই বুঝে গেছিল।মরুবলয়ের অস্তরাগ সূর্য ডোবার অনেক পরেও বালিয়ারি রঙীন করে রাখে।সেই আলোর রক্তিম আভায় প্রেয়সীর মুখে নিস্পলকে চেয়ে থাকে জিয়াদ।শিল্প স্বত্তা বলে অনেক মর্মর মূর্তি তে এই ভালবাসা ধরে রাখতে।নীলের এই নীর্জন প্রান্তে সেনেমুতের নিজস্ব সংগ্রহশালায় দূনিয়াদারি পরোয়া না করে গভীর থেকে গভীরতম ভালবাসার নাগপাশে জড়িয়ে পরে দুই তরুন হৃদয়।
বার্লির ছোট্ট চারা টা দেখে ইশিন জড়িয়ে ধরল সামাইরা কে।আর কটা দিন।নিশ্চই নিজের করে পাবে ও জিয়াদ কে।সদ্যজাত বাচ্চার নাড়ী জন্মলগ্নেই কেটে জিয়াদের প্রীয় কোন জিনিসের সঙ্গে মিশকা বুড়িকে দিলেই ওর বশ হবে জিয়াদ।জিয়াদের প্রীয় জিনিসটা কি হতে পারে বুঝে উঠছেনা সামাইরা। সাদা ঘোড়াটা না ওর ছেনী বাটালি যা দিয়ে অসাধারন ভাস্কর্য ফুটিয়ে তোলে ও।
তামার গুঁড়োতে মন দিয়ে শুকানো বিষাক্ত বীজের গুঁড়োটা মিশিয়ে চীনামাটির ছোট্ট পাত্রে ভরে মেয়েটার হাতে তুলে দিল হেরপটাস।সঙ্গে তুতমোসিস 3 এর দেওয়া তেরটা স্বর্ন মূদ্রা।হাতসেপসুতের কাজলে মিশে একটু একটু করে ধীর বিষক্রীয়া শুরু করবে ঐ গুঁড়ো।ঠিক যেভাবে সেকেনিল কে দিয়ে তুতমোসিস 2 কে ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।
তবে জিয়াদের খবরটা পাওয়া র পর এক অজানা ভয় খেলা করছে হেরপটাসের মনে।
রাজকুমারী নেফেরুরের সঙ্গে জিয়াদের ঘনিষ্ঠতা ওর এই দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পথে না বাধা হয়ে দাড়ায়।
সেনেটের এক চালে জিয়াদ কে ধরাশায়ী করে হেসে উঠল নেফেরুরে।জীবনের চালে ঐ হাসিতেই জিয়াদ সপ্তম স্বর্গে ভাসছিল।লোক চক্ষুর অন্তরালে একটু একটু করে গড়ছিল গোলাপী স্ফটিকে আবক্ষ প্রেমিকার মূর্তি।যদিও সূদূর পারস্য থেকে আসা ঐ স্ফটিক পাথর ওকে দেওয়া হয়েছিল ফারাও হাতসেপসুতের নারী মূর্তি বানানোর জন্য।কার্নাক মন্দিরের মূর্তিটি নকল দাড়ি লাগান ছদ্মবেশী ফারাও এর।
বহুবছর বাদে নীলের পশ্চিম প্রান্তে মেঘ করেছে।নেফেরুরের আবক্ষ মূর্তি মসলীন কাপড়ে মুড়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি করছিল জিয়াদ।জিয়াদের প্রীয় বেদানার মদে সদ্যোজাত ছেলের নাড়ী ডুবিয়ে ধাতব পাত্রটা জিয়াদের হাতে তুলে দিল সামাইরা।কিছুক্ষন বাদে ঘোড়ার খুড়ে ওড়া ধূলোর সঙ্গে জিয়াদের সেনেমুতের প্রশিক্ষন কেন্দ্রের দিকে চলে যাওয়া দেখে মনে মনে হাসে সামাইরা।মিশকা বুড়িকে ছেলের নাড়ী আর বুকের রক্ত দিতে হবে আজই।
কার্নাক মন্দিরের উদ্বোধনের ছয় পক্ষকাল পরেই নেফেরুরের সঙ্গে তুতমোসিস 3 এর বিবাহ প্রস্তাব দেয় ঈশিত।মহামান্যা হাতসেপসুত এর এই প্রস্তাব মনপূঃত হয়না।সে রাতেই মরুপাহাড়ের পিছনে জাদুকরী মিশকা বুড়ির গুহায় যাওয়ার পথে মরুদস্যুরা অপহরন করে সামাইরাকে।এদিকে সীসা মিশ্রিত কোহল এর ব্যবহারে দৃষ্টি শক্তি লোপ পেতে শুরু করেছে হাতসেপসুতের।ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল নেফেরুরে।বড় দোটানায় ছিল হেরোপটাস।জিয়াদ ও নেফেরুরের সম্পর্কে যুবরাজ কে জানাবে কিনা আর জানার পর জিয়াদ ও নিজের ভবিষ্যৎ কি হবে স্হির করতে পারছিল না।এর মাঝেই সামাইরার অন্তর্ধান ওকে পাপ বোধে জর্জরিত করে তোলে।
সেনেমুতের আশির্বাদ নিয়ে রুক্ষ মরুদিগন্তে মিলিয়ে যাওয়ার আগে ঘুমন্ত হাতসেপসুতের হাতে চুমু দিল নেফেরুরে।মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিল।দু চোখে তুমুল যন্ত্রনা উপসম করতে ভারতবর্ষ থেকে আনা কড়া আফিম নিতে হয় আজকাল হাতসেপসুত কে।প্রানাধিক প্রীয় কন্যার চলে যাওয়া টেরও পেলেন না ফারাও হাতসেপসুত।বিধাতা অলক্ষ্যে এভাবেই মানুষের সব কাজের ফলাফল নির্ধারন করেন হয়ত।সেদিনের পর ভাঙা হৃদয়ে হাতসেপসুত আরও কয়েক বছর রাজত্ব করেছিলেন।রাজ পরিবারের নিয়মানুযায়ী তুতমোসিস 3 এর সঙ্গে নেফেরুরের বিয়ে হয়।তবে সে সত্যিকারের রাজকুমারী নেফেরুরে নয়।মরুদস্যুর সঙ্গে স্বর্নমূদ্রার বিনিময়ে উদ্ধার করা হেরোপটাসের কন্যা সামাইরা।রাজ্যলাভে সহায়তার পুরস্কার হিসেবে এই আপোষ মেনে নেন তুতমোসিস 3।
হাতসেপসুতের মৃত্যুর পর নীলের উপত্যকার প্রতি কোন থেকে কার্নাক মন্দির থেকে তার প্রতিটি চিন্হ অপসারন করেন তুতমোসিস 3।বিমাতা ও এক নারীর ঐ উত্থান কে ধূলোয় না মিশিয়ে তার পুরুষকার ক্ষান্ত হয়না।যদিও নেফেরুরে কে না পাওয়ার আক্ষেপ রয়েই যায়।মিশর বাসি অবাক হয়ে দেখে নেফেরুরের এক নতন রুপ।মাতৃহারা রাজকুমারী দুঃখে বদলে গেছেন বলে ধরে নেয় সকলে।
ওদিকে সিনাই মরু পেরিয়ে মৃতসাগরের পারে এক অক্ষাত নগরে সারারাত তুমুল গর্ভযন্ত্রনার পর আত্মজা কে হাতে তুলে অবর্ননীয় খুশীতে উজ্জ্বল স্ত্রীকে জিয়াদ জানায় ওর নাম হবে হাতসেপসুত।
( সম্পূর্ন কল্পনাপ্রসূত।এর সঙ্গে ইতিহাসের সূত্রের বাস্তব যোগ নেই।)
0 Comments