মানসী

সায়ন চক্রবর্তী on

মেয়েটার চুলটা খোলা, রংমাখা কপালের গা বেয়ে ইচ্ছাকৃত অবিন্যস্ত কালো চুলের স্রোত, যৌবনের ঢেউ তোলা শরীরের ওপর যেন কিসের অপেক্ষায় আড়ি পেতে আছে। চর্চিত ঠোঁট, সুগঠিত স্তন আর উন্নত গ্রীবা আমার দিকে ফিরিয়ে, অজস্র মুক্তোদানা সমুদ্রতটে ছড়িয়ে দিয়ে সে বলল, “হাঁ করে কী দেখছ? প্রথমবার দেখছ নাকি আমাকে?”

অসমঞ্জ চমকে উঠল একটু। বোকার মত কিছুক্ষণ চেয়ে রইল মেয়েটির দিকে। অসাধারণ রূপসী এই মেয়েটিকে তার চেনা চেনা লাগছে খুব। তবু কী যেন আলাদা এর। একবার চারপাশের ঘন কালোর মধ্যে সমুদ্রের আছড়ে পড়া সাদা ঢেউয়ের দিকে চেয়ে নামটা আবছা আবছা মনে পড়ল অসমঞ্জর।

“তা-তাপসী।” ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল অসমঞ্জ।

খিলখিল করে উঁচু স্বরগ্রামে হেসে উঠল মেয়েটি। হাসিটা আবার খুব চেনা চেনা লাগল অসমঞ্জর। যেন স্বরলিপির স্বরগুলো একই, গায়কীটা ভীষণ আলাদা।

“আমি মানসী।”, বলল মেয়েটি অসমঞ্জর চোখে তার সমুদ্রের মত গভীর চোখদুটো রেখে।

দমকা একটা হাওয়ার দাপটে কিছুটা জলের ছিটে এসে আচমকা ভিজিয়ে দিল অসমঞ্জকে। 

“তারপর, অ্যাওয়ার্ডটা পেয়ে কেমন লাগছে?”, বলল মানসী। তার গলায় কোথায় যেন একটা ব্যঙ্গের সুর শুনতে পেল অসমঞ্জ। হয়তো সেকারণেই, উত্তর দেওয়ার সময় তার গলায় যে একটা অনাবশ্যক জোর আর ঔদ্ধত্য ফুটে উঠেছে- তা সে নিজেই অনুভব করল। “হ্যাঁ, দারুণ লাগছে। অবশ্যই ভাল লাগছে। পাণ্ডুলিপি পাবলিকেশনের বেস্টসেলার হয়েছে লেখাটা। পরপর দুই বছর আমার লেখা ক্রাইম নভেলটাই বেস্টসেলার। ভাল তো লাগবেই। কোন তরুণ লেখক সার্কিটে আসার পাঁচ বছরের মধ্যে এই ধারাবাহিকতা দেখাতে পেরেছে? বাকিরা এখন ইতিহাস। আমার নাম অসমঞ্জ, অন্যদের নদীতে ডুবিয়ে দেওয়াটাই আমার কাজ, সেই পুরাণ থেকে।”

“এই নভেলটা কি নিয়ে?”, প্রশ্ন করল মানসী।

“কলকাতায় শেষ রাতে একটা রেপ হয়। মেয়েটিকে মার্ডার করা হয়। খুঁজতে গিয়ে হাই – সোসাইটির একটি পরিবারের যোগ পাওয়া যায়। দুই ভাই। তার মধ্যে এক ভাই আরেক ভাইয়ের স্ত্রীয়ের সাথে পরকীয়ায় যুক্ত। এই ঘটনাটাই তাদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরায়, পুলিশের হাতে অস্ত্র তুলে দেয় তাদের একে অপরের প্রতি দোষারোপ। এর মাঝে পুলিশের প্রেম ও যৌনতা, রাজনৈতিক অত্যাচার, শ্লীলতাহানি, ফেমিনিজমের সাবটেক্সট-” বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে অসমঞ্জ।

“বাঃ দারুণ। আরো লেখো। আরো বেস্টসেলার হোক।”, বলে মানসী সি বিচ থেকে উঠে পড়ে।

“আরে উঠছ যে।”, অসমঞ্জ ঝোলা থেকে বেস্টসেলার বইটা বার করে আনে। “পড়বে না? আগে তো পড়তে সব।”

মানসী ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “যে পড়ত তার পড়ার সময় চলে গেছে অসমঞ্জ। আমার পড়তে একটু সময় লাগবে।”

সমুদ্রের ভেজা হাওয়াটা অসমঞ্জর নাকে এসে লাগল। আঁশটে গন্ধ।

অনুষ্ঠান চলছে। এইমাত্র বক্তৃতা শেষ করলেন একজন। ছোট অনুষ্ঠান। উঠতি কয়েকজন লেখকের সম্বর্ধনা আয়োজন করেছে কয়েকটি ছোট প্রকাশনা সংস্থা একত্রে। ফেসবুকের পেজ থেকে লেখকদের বইয়ের পাতায় তুলে আনতে পারার কৃতিত্ব সব ছোট প্রকাশনা সংস্থাই বইমেলার মঞ্চের আলোয় চেটেপুটে নিচ্ছে। লেখকেরা নিজেদের বুদবুদে মুড়ে পোশাকি বক্তব্য রাখছে একের পর এক। বেস্টসেলার, ফেসবুক লেখকের উত্থান, বড় প্রকাশনার মৌরসিপাট্টার অবসানের দিন ঘনিয়ে আসা, আবার বেস্টসেলার, বিক্রি, ফেসবুক পেজে লাইক- শব্দগুলো বইমেলার স্টলে স্টলে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে মঞ্চের কাছে। আর একটা জায়গায় যেতে হওয়ার অজুহাত দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে পড়ল অসমঞ্জ। সামান্য বিস্মিত আর অসন্তুষ্ট চোখজোড়াদের পেরিয়ে সে একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বইমেলার মূল রাস্তায়। সন্ধ্যা নেমে আসা বইমেলায় কমলা হ্যালোজেনের রঙ ধরেছে। ময়দানের বইমেলার ধুলোমাখা দিনগুলো স্মৃতি হয়ে গেছে বহুকাল, এখন জায়গা বদলে বদলে সল্টলেকের তথ্য প্রযুক্তি পাড়ার কোলে গুটিসুটি হয়ে পড়ে আছে কলকাতা বইমেলা। পরিপাটি আয়োজনে মাপাজোপা সংসার,দুই কামরার ফ্ল্যাটের মত – পরিসর আছে, অবকাশ নেই। নিজের বই বেরনোর পর থেকে অসমঞ্জর বইমেলায় আর স্টলে স্টলে ঘোরা হয়না তেমন।একবার লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নটার দিকে যাবে? দিব্যেন্দুদা অনেকবার যেতে বলেছে। আজকাল নিজের বইয়ের জন্য স্টলে গিয়ে বসে থাকা, ফেসবুক লাইভ করা, প্রকাশনার সাথে জনসংযোগ করে আর সময় পায়না সে। সময় পায়না আজকাল তাপসীর জন্যও। 

কথাটা মনে হতেই শরীর বরফ দেওয়া মাছের মত শক্ত হয়ে উঠল অসমঞ্জর। তাপসীকে আজ এমন লাগল কেন? সাজপোশাক, কথাবার্তা এত উচ্চকিত ছিল কেন? অনেক বছর চেনে সে তাপসীকে, অনেক বছর সে চেনে ঐ সমুদ্রতটটাকে। মাঝখানে বেশ কিছুদিন যাওয়া হয়নি যদিও তাপসীকে নিয়ে, সেই সময়ের ব্যবধানে এতটা বদলে গেছে সব? নামটাও বদলে মানসী বলছে কেন? তবে কী-    

“কী গুরু, এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে হ্যালোজেন দেখছ কেন? একটা হাংগ্রিয়ালিস্ট ফেঁদে ফেলবে নাকি?”

চমকে তাকাতে অসমঞ্জ দেখল পাণ্ডুলিপি পাবলিকেশনের কর্ণধার হংসরাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে। বয়স কমই, তবে এর মধ্যেই বাবার প্রকাশনা সংস্থাটাকে বাড়িয়েছে, অন্য একটা দিশা দিয়েছে। সাধারণত সে তাকে কখনও কোন লেখকের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে দেখেনি, তবে এটাও দেখেছে নিজের মতটাকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জোরের সাথে সামনে রাখতে হংসরাজ জানে।

“জানতাম অনুষ্ঠানটা একটু বোরিং লাগবে বস,” বলল হংসরাজ, “ইচ্ছামতি, বাবলাকাঁটা পাবলিকেশনগুলো পুরো মুড়ি মিছরি এক দর করে দিয়েছে। হুঃ, ওদের বেস্টসেলার! তিরিশ কপি বেচে বড় বড় কথা। আমরা তোমার কপি এবার সত্তরটা সেল করেছি। এটাই পাণ্ডুলিপি বস, এটাই অসমঞ্জ মুখার্জির ব্র্যাণ্ড।”

অসমঞ্জ হাসল। খুব অনুশীলন করা হাসি। আট আনা প্রতিষ্ঠা, চার আনা গর্ব, দুই আনা বিনয়, শূন্য আন্তরিকতা আর দুই আনা ‘এ আর এমন কী’ ভাব জুড়ে যে হাসিটা হয়, সেটা ঠোঁটের গোড়ায় রাখতে তাকে অনেক খাটতে হয়েছে।

“আচ্ছা পরের বারের বইমেলার জন্য লেখাটা স্টার্ট করেছ তো? গোয়েন্দা হারিতকে নিয়ে একটা সিরিজ শুরু করে দাওনা। প্রথম বইটায় হারিতকে লোকে বেশ নিয়েছিল। সেই অনুপাতে তোমার সেকেণ্ড বইটার রেসপন্সটা কিন্তু একটু ডাল। হারিতকে ফেরাও।”

অসমঞ্জর চোখের সামনে সমুদ্রতটটা ভেসে উঠল। তাপসী তার এই বইগুলো পড়ছেনা। সে কি চায়?

“শোন গুরু, পাব্লিক যতদিন খাচ্ছে, হারিত চালিয়ে যাও। পাব্লিক সিরিজ চায়, এক্সপিরিয়েন্স থেকে বলছি। ছাঁচটা রেডি করা নিয়ে কথা। সেটা হয়ে গেলে, একশোটা সন্দেশ বানাতে সময় লাগেনা।” 

ইতিমধ্যে কিছু পাঠক এসে উপস্থিত হয়েছে। ফেসবুকের সৌজন্যে অনেকেই মুখ চেনে অসমঞ্জর। অসমঞ্জ ঠোঁটের কোণায় সেই অনুশীলন করা হাসিটা দিয়ে নিজেকে মুড়ে ফেলে আঙুলের মাঝে কলমটাকে বেঁধে নিজের কীর্তির আঁচটা সামান্য বাড়িয়ে দিল।

লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের রাস্তাটা ম্যাটম্যাটে হলুদ আলো মেখে পড়ে রইল।

রাত অনেক গভীর হয়েছে এখন। শহরজোড়া মানুষের কাউকে না বলা দুঃখগুলো বড় বড় কার্নিশের নীচের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে- সকাল হলেই ঝাঁপ দিয়ে মিলিয়ে যাবে শহরের ভীড়ে। বইমেলা শেষ হওয়ার পর দুইমাস কেটে গেছে। এখন রাত তিনটের সময় মাপকাটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অসমঞ্জর সিগারেট খাওয়ার একমাত্র কারণ- তৃতীয় ক্রাইম নভেলটা একটু আগে মোটামুটি শেষ করে এনেছে সে। হারিতের বন্দুক ঠেকে গেছে খুনীর মাথায়। এবার চারটে ধর্ষণ আর খুন করা খুনীর অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, ছোট ছোট জিনিসগুলোও বাদ যাবেনা। চারটে নারীশরীর, অসহায় স্তন, অনিচ্ছুক যোনি-

নিজেই একবার মাথা ঝাঁকাল অসমঞ্জ। মাথাটা বড্ড ধরে গেছে তার। একটানা লিখছে তো। আর একটা সিগারেট খাবে? কালো বিষের ধোঁয়া অজগরের মত পাকে পাকে মাথার মধ্যে গল্পের সম্মোহন বুনে দিক। 

টেবিলের ড্রয়ার খুলে সিগারেটের প্যাকেটটা বার করতে গিয়ে পাশে নিজের একটা নীল ডায়েরির দিকে চোখ পড়ল তার। মাঝপথে থমকে গেল অসমঞ্জর হাত। ধুলো পড়ে আছে স্তুপের তলা থেকে আড়চোখে ভয়ে ভয়ে উঁকি মারা নীল ডায়েরিটাতে। কতদিনের লেখা কবিতা জমে আছে তার পাতায় পাতায়, শিরার মত লাইনগুলোতে। অজান্তে চলে যাওয়া হাত দিয়ে ডায়েরিটা স্তুপের নীচ থেকে টেনে বার করল অসমঞ্জ। ডায়েরিটা খুলতে একটা নোনা গন্ধ পেল সে। সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ পেল যেন আবার। 

সেই সমুদ্রতটটায় সেদিন আলো ছিল অনেকটা। সূর্য নরম আদরে আঙ্গুল বুলিয়ে দিচ্ছিল সাগরের জলে। একা ডায়েরিটা নিয়ে বসে থাকা উস্কোখুস্কো চুলের অসমঞ্জ প্রথম দেখা পেয়েছিল সুন্দরী মেয়েটির। তার পরণে ছিল একটা আধময়লা জিনস, রংচটা টপ। হাতের জুতোয় বাতাস কাটতে কাটতে বালিতে পা ছুঁইয়ে মেয়েটি এসেছিল। হাতের ডায়েরিটা চেয়ে নিয়েছিল খুব সহজে। কবিতাগুলো পড়েছিল খুব মন দিয়ে, নিশ্চুপ হয়ে। সে মুহূর্তে সমুদ্র ছাড়া আর কোন শব্দ ছিলনা পৃথিবীতে। নাম জিজ্ঞাসা করতে মেয়েটি হেসে ফেলেছিল। অস্ফুটে অসমঞ্জ বলেছিল, “তা- তাপসী।”

তাপসী কবিতার ডায়েরিটা খুব যত্ন করে অসমঞ্জর ভাঁজ করা হাঁটু আর বুকের মাঝে রেখেছিল। বলেছিল, “লিখো। আবার দেখা হবে।”

ডানা ছড়িয়ে সমুদ্রের ধার ধরে ফিরে গিয়েছিল তাপসী।

অসাবধানে ডায়েরিটা বন্ধ হয়ে যেতে সমুদ্রের আওয়াজটা মিলিয়ে গেল যেন হঠাৎ। অসমঞ্জর মনে পড়ল হারিত বন্দুক ঠেকিয়েছে খুনীর কপালে। হারিত, খুনী – হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ঠিক। 

হাতের ডায়েরিটা দ্রুত নামিয়ে রাখল অসমঞ্জ। 

হারিতের দ্বিতীয় লেখাটা শেষ করার পর দম ফেলবার অবকাশ পায়নি অসমঞ্জ। একটা ওয়েব সিরিজের জন্য চিত্রনাট্য লেখার বরাত পেয়েছিল। পুরোটাই যৌনতা- নির্ভর। সাত এপিসোডের সিরিজ, প্রত্যেক এপিসোডেই অন্তত আধখানা শয্যাদৃশ্য রাখতে হচ্ছে। আর অবারিত গালিগালাজ। পর্দায় দশ মিনিট পেরিয়ে গেল, অথচ কোন নায়িকা স্বল্পবাসে হেঁটে গেলনা ক্যামেরার সামনে দিয়ে, হাতে মদ নিয়ে কোন ছেলে চারটে বিখ্যাত খিস্তি মারল না, এ হলে প্রযোজক চিন্তিত হয়ে পড়ছেন খুব। তাল মিলিয়ে লিখে যাচ্ছে অসমঞ্জ। নারী, অশ্লীলতা, অপরাধকে সযত্নে সাজিয়ে ওয়েব সিরিজে ভরছে সে। হংসরাজ ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, ওয়েব সিরিজটা দেখান হয়ে গেলে এই চিত্রনাট্যটা একটা বইয়ের আকারে বার করবে পাণ্ডুলিপি।  

ওয়েব সিরিজটা লেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পর একদিন বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা চুপচাপ বসেছিল অসমঞ্জ। ঘটনাটা বিরল হয়ে গেছে আজকাল। আজকের জনসংযোগের দুনিয়ায়, আর কিছু না হোক একটা করে মুক্তগদ্য লিখে ফেসবুকে পাঠককে জানাতে হয় যে লেখক বেঁচে আছেন, তার মাথা ফেসবুকের সার্ভারের মত নিরন্তর ব্যস্ত। সদ্য-প্রেমিকাকে রোজ যেমন উপহার দিতে হয়, তেমন করে রোজই দু-লাইন ভাসিয়ে দিতে হয় লেখককে ফেবুর ওপাশে থাকা মাথাগুলো ধরে রাখতে। তবু আজ অসমঞ্জ বসেছিল। ক্লান্ত লাগছিল আসলে একটু। এমন সময়ে দিব্যেন্দুদা বাড়ি এল।

অবাক যথেষ্টই হল অসমঞ্জ। দিব্যেন্দুদার আসার কোন কথা ছিলনা। অনেকদিন দেখাও হয়নি। অসমঞ্জরই করা হয়নি, আজ এটা, কাল ওটা বলে এড়িয়ে গেছে বারেবার। তেমন কোন কারণ ছিলনা যদিও। তার কবিতা লেখার দিনগুলোর থেকে দিব্যেন্দুদা তাকে চেনে। শুধরে দিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে, দুটো- তিনটে ম্যাগাজিনের সাথে যোগাযোগও করিয়ে দিয়েছিল। তবে আজ এড়িয়ে যেতে চায় কেন অসমঞ্জ? সে কি বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে?

“বিরক্ত করলাম?”, বলল দিব্যেন্দুদা।

“আরে না না।”, অনুশীলন করা হাসিটা জায়গা করে নিল অসমঞ্জর ঠোঁটে।

“তুই তো আর আসিস না। তোর জন্য পত্রিকার কয়েকটা সংখ্যা নিয়ে এলাম। বইমেলায় পাঁচবার এলি, দেখা করলিনা। ”

“গোয়েন্দাগিরি করছ নাকি আজকাল?”

“হারিতকে ভাড়া করেছি।”

অসমঞ্জ হেসে উঠল। প্রাণখোলা হাসি।

“বাই দা ওয়ে, অভিনন্দন। আবার বেস্টসেলার হলি তোর প্রকাশনার।”, বলল দিব্যেন্দুদা।

অনুশীলিত হাসিটা ফিরে আসছে অসমঞ্জর কাছে।

দিব্যেন্দুদা স্থির দৃষ্টিতে অসমঞ্জর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল – “কবিতা লিখছিস এখনো?”

“ঐ, কেউ চাইলে লিখে দিই।” – উদাসীনভাবে বলল অসমঞ্জ।

“কেটারিঙের খাবারের মত?”, বলল দিব্যেন্দুদা। অসমঞ্জ হাসলনা।

দিব্যেন্দুদা একটু সময় নিয়ে বলল, “আমরা একটা শ্রাবণ সংখ্যা করছি। বড় করে। শুধু কবিতা থাকবে। ভাল ভাল কবিতা। বিখ্যাত উঠতি অচেনা সবধরণের কবিদের নিয়ে, প্যারামিটার একটাই- ভাল কবিতা। শঙ্খ ঘোষ, শ্রীজাতও লিখছেন। একটা বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা হবে এটা। বিষয়টা হল ব্যবসা। তুই একটা লেখা দিবি?”

“বেশ, তুমি কাল নিয়ে যেও।”, বলল অসমঞ্জ।  

“লেখা আছে তোর?”, জিজ্ঞাসা করল দিব্যেন্দুদা।

“না লিখে দেব। কাল এসো।”, তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল অসমঞ্জ। যে বছর বছর বেস্টসেলার নামাতে পারে, দু’টো লিটল ম্যাগাজিনের কবিতা তার কাছে কী?

দিব্যেন্দুদা অন্তর পড়ে ফেলা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অসমঞ্জকে দেখল। তারপর শান্ত স্বরে বলল, “আমি এক সপ্তাহ পরে আসব। লিখে রাখিস।” 

দিব্যেন্দুদাকে উঠে পড়তে দেখে সোফায় গা ছড়িয়ে বসেই অসমঞ্জ জিজ্ঞাসা করল, “চা খাবেনা?”

দিব্যেন্দুদা কথার উত্তর দিলনা। দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “তোর সেই উপন্যাসটা বই করেছিস? সেই প্রথম লেখাটা?”

হঠাৎ কে যেন ভীড়ের স্রোতের মধ্যে উল্টোদিকে টান মারে। উজানে যাওয়ার সাঁতারে দম ফুরিয়ে ফাঁপা গলায় বলে ওঠে অসমঞ্জ, “কোন লেখাটা?”

“কলকাতার রাজপুত্তুর। একটা একা উঠতি লেখকের পরাবাস্তব। ভাষাটা নিয়ে খুব পরীক্ষা করেছিলিস।”

লেখাটার নামটাও দিব্যেন্দুদারই দেওয়া। অনেক জন্ম আগে। 

“কলকাতার রাজপুত্তুর তো শেষ হয়নি দিব্যেন্দুদা।”

একটু থেমে দিব্যেন্দুদা বলল, “আমার তো তা-ই মনে হয়।”, তারপর বলল, “লেখাটা শেষ করিস সময় পেলে। এখন তো আর প্রকাশক পেতে অসুবিধা হবেনা।” 

রাত নেমে এসেছে। গভীর রাত। দিব্যেন্দুদা চলে যাওয়ার ছয়দিন পরের রাত। হাওয়া দিচ্ছে না একটুও। গুমোট অন্ধকার রাত কুরূপ পুরুষের মত কলকাতার শরীরে উঠে বসেছে। রাশিকৃত ছেঁড়া কাগজের মধ্যে বসে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে অসমঞ্জর এই গুমোট রাতে। চারপাশে ছেঁড়া কাগজ। ছেঁড়া ছেঁড়া কবিতার চেষ্টা। দিব্যেন্দুদার রেখে যাওয়া পত্রিকার আধখোলা শরীরে ছোট ছোট মাপে বোনা অসামান্য কবিতাগুলো অসমঞ্জর দিকে নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। পাগলের মত আবার একটা সিগারেটের খোঁজে এদিক ওদিক হাতড়াতে গিয়ে কলকাতার রাজপুত্তুরের পাণ্ডুলিপিটার দিকে চোখ পড়ল অসমঞ্জর। শরীর আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে এল তার।

সমুদ্রের ঢেউগুলো ফিরে এসেছে। আজ রাতের অন্ধকারে বড় অশান্ত সমুদ্র। ফুঁসে ওঠা ঢেউগুলো প্রবল আক্রোশে বালিতে আঁচড়ে যাচ্ছে বারেবার। অস্থির অসমঞ্জ ছেঁড়া কাগজের কবিতাগুলোকে একসাথে জুড়বার চেষ্টা করছে প্রাণপণ। তাপসী আজ যেন আগে থেকেই দাঁড়িয়েছিল। তাপসীর ব্লাউজের হাত নেই, শাড়ি নেমে এসেছে বিভাজিকার অনেক নীচে। শরীর গড়িয়ে নির্লজ্জ যৌবন উন্মুক্ত নাভির বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে। মোমের মত ত্বকে রঙের প্রলেপে তাপসী সুন্দর আজ, সে সুন্দর আর সবদিনের চেয়ে বেশি। তবু সে চোখে চোখ রাখতে পারলনা অসমঞ্জ, কেমন শীত করে উঠল শরীরের পথ বেয়ে।

শান্ত স্বরে তাপসী বলল, “ডেকেছ কেন?”

“হচ্ছেনা, হচ্ছেনা তাপসী। কিচ্ছু হচ্ছেনা।”, অপ্রকৃতিস্থ গলায় বলল অসমঞ্জ।

“আমি তাপসী নয়। মানসী।”, দৃঢ় স্বরে উত্তর এল।

“হচ্ছেনা। কিছুতেই কবিতাগুলো লিখতে পারছিনা আমি। যে কয়েকটা লিখেছিলাম, পত্রিকার কবিতাগুলো পড়ার পর ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। কবিতা আসছেনা আমার কাছে। তিনরাত কলমের মুখ খুলে অপেক্ষা করেছি আমি, সে আসেনি। খুন আসছে, যৌনতা আসছে, শরীর আসছে, কিন্তু সে আসছেনা। এমন কেন হচ্ছে তাপসী?”

“মানসী।”

আমল দিলনা অসমঞ্জ। “আমার নীল ডায়েরিতে সে তো এসেছিল, বারবার এসেছিল। ভাষা, ছন্দ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এখন কেন-”

উবু হয়ে বসে চোখে চোখ রাখল তাপসী। অনেকটা আবেগহীনতায় একটু ব্যঙ্গ ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “কবিতা না এলে ছেড়ে দাও। কলকাতার রাজপুত্তুরটা শেষ করো।”

যেন নরম ক্ষততে ছুরি চালিয়ে দিল কেউ। শিউরে উঠে অসমঞ্জ বলল, “আমি তো তাও পারছিনা। ঐ ভাষাটা, ঐ দখলটা, ঐ পরীক্ষার সাহস, ঐ ন্যারেটিভটা আমায় ছেড়ে চলে গেছে।”, কান্নায় বুজে আসে গলাটা। একবার দম নিয়ে বলে, “যখন লেখাটা বুনছিলাম, কেউ চাইলনা, একজনও না। যাদের দরজায় পৌঁছতে পেরেছিলাম, কিছুটা পড়ার পর ফিরিয়ে দিয়েছিল সব প্রকাশক। নতুন দিগন্তটা কেউ দেখলনা। লোকে অপরাধ চেয়েছে, নারী চেয়েছে, যৌনতা চেয়েছে। দিয়েছি, দু’হাত ভরে দিয়েছি। কিন্তু, কিন্তু তুমি তো জানো, আমি সবসময়েই ফিরতে চেয়েছিলাম রাজপুত্তুরের কাছে, কবিতার কাছে। আর কেউ না জানুক, তুমি তো জানো তাপসী, আমি- ” 

“আমি মানসী, অসমঞ্জ। তোমার লেখা যখন তপস্যা ছিল, যখন মনের ভেতর খুঁড়ে তুলে আনতে পারতে ভাবনার হীরে, তখন তাপসী আসত। আজ যে এসেছে সে মানসী, সে তোমার মনের বাসনা ছাড়া কিচ্ছু না। সে তোমার সাথে লিটারারি মিটের স্টেজের আলো ভাগ করে নিতে পারে, তোমার একলা ঘরে তোমার সাথে কবিতার শব্দ খুঁজতে পারেনা।”

“এটাই তো স্বাভাবিক।”, হেরে যাওয়া গলায় বলল অসমঞ্জ, “আমি অসমঞ্জ। ছোট ছোট বাচ্চাদের সরযূ নদীতে ডুবিয়ে দিত যে পুরাণে। আমি আমার কবিতা, আমার ভাষাকে ডুবিয়ে দিয়েছি সরযূর জলে। আমার নামেই তা-ই লেখা ছিল যে।”

একটা বই হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল মানসী। নীচে বসা অসমঞ্জর দিকে তাকিয়ে বলল, “অসমঞ্জ কাউকে মারেনি। সে একজন যোগী ছিল। নিজের থেকে বাকিদের দূরত্ব তৈরী করার জন্য সে বাকিদের ডুবিয়ে দেওয়ার ভান করত। তাই সময় এলে সে প্রত্যেককে জীবিত ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল সরযূর কোল থেকে। সে-ই তার প্রায়শ্চিত্ত ছিল। অসমঞ্জকে তুমি পুরোটা চেনোনি। সে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। তুমি কি ফেরাতে চাও? তুমি কী চাও, অসমঞ্জ?”

অসমঞ্জ চুপ করে গেল। তার ঠোঁটে কথা এল না।

মানসী হেসে উঠল উচ্চগ্রামে। নিষ্ঠুর সে হাসি। চাঁদের আলো প্যাঁচার থেকে পালাতে চাওয়া ইঁদুরের কাছে যতটা নির্মম সুন্দর, তার চেয়েও বেশি নির্মম সুন্দর সে হাসি। শীত, খুব শীত করতে লাগল অসমঞ্জর।

“আগের দিন পড়াতে চেয়েছিলে, পড়িনি।”, বলল মানসী, “আজ আর কোন বাধা নেই।”

হাতের বইটা ঘুরিয়ে অসমঞ্জকে দেখাল মানসী, তার বইমেলায় প্রকাশিত বেস্টসেলার বইটা।

“তোমার মানসী বেস্টসেলারই পড়বে।”

মানসী ফিরে যেতে শুরু করল। হাহাকার করে কেঁদে উঠল অসমঞ্জ। তার ফিরে আসার ডাক অশান্ত সমুদ্রের গর্জনে চাপা পড়ে যাবে এক্ষুণি।

রাত এখন গভীর, বড্ড গভীর। সমুদ্রতটেও, আর কলকাতাতেও।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


সায়ন চক্রবর্তী

বাসস্হান – কলকাতা । শিক্ষা - বেঙ্গল ইন্জিনিয়ারিং অ্যাণ্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি শিবপুর থেকে তথ্য প্রযুক্তিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীপ্রাপ্ত। কর্মজীবন - বহুজাতিক তথ্য প্রযুক্তি সংস্হায় কর্মরত। লেখা ছাড়া অন্য আগ্রহের বিষয় - গান, বেড়াতে যাওয়া, আড্ডা , চলচ্চিত্র। কোন শাখায় লিখতে পছন্দ - কবিতা, ছোটগল্প, রম্যরচনায় সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ। তবে উপন্যাসও মাঝে মাঝে লেখা হয়ে যায়। অন্যান্য পত্রিকায় - আনন্দবাজার পত্রিকায় দুইটি ছোটগল্প প্রকাশিত। এছাড়াও বিভিন্ন ছোট পত্রিকা যেমন রোদ্দুর, কলিখাতা, ঝালমুড়ি ইত্যাদিতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রাপ্ত পুরষ্কার - সপ্তপর্ণী ফেসবুক গ্রুপে আয়োজিত ছোটগল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরষ্কার।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।