খোলা জানালা
“যাহ কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবার বানাতে হবে।
নাহ থাক, এটাকেই পরে মাইক্রো-ওয়েভ করে নেব। এখন জানালা থেকে নড়া যাবেনা, আর মাত্র মিনিট দুয়েক, তারপরই মেয়েটা তালা খুলে ফাঁকা ফ্ল্যাটটায় ঢুকবে, বড় বড় জানালাগুলো থেকে পর্দার আড়াল সরিয়ে দেবে। এতক্ষনের অন্ধকারাচ্ছন্ন আপার্টমেন্টে আলো জ্বলে উঠবে, নিষ্প্রাণ ফ্ল্যাটটা মানুষের শ্বাসে প্রশ্বাসে পুনরায় জেগে উঠবে।
সঙ্গে ছেলেটিও থাকবে নিশ্চয়ই, ওরা কোনোদিন পৃথক বাড়ি ফেরেনা, সবসময় একসাথে। মেয়েটা কলকল করতে করতে বাতি জ্বালায়, ছেলেটা ড্রয়ইং রুম সংলগ্ন কিচেনে ঢুকে চা বা কফির জল চাপায়। তারপর চা বা কফি খেয়ে ফ্রেশ হয়ে মেয়েটি নিজের চেলো খানা নিয়ে বসে, লম্বা লম্বা আঙ্গুল এবং সুগঠিত হাত দিয়ে করতে থাকে সুর নিয়ে একের পর এক খেলা, চঞ্চল মেয়েটি নিমেষেই হয়ে যায় স্থির, নিশ্চল, অবিচল। ছেলেটি তখন বই আর ল্যাপটপ নিয়ে উল্টোদিকে বসে কাজ করে, মাঝেমাঝে মুখ তুলে মেয়েটির দেখে চায়। দূর থেকে বোঝার চেষ্টা করি সেই দৃষ্টিতে কতটা পরিমান রয়েছে প্রেম, আর কতটা নয়। কিন্তু যাই হোক, প্রতিদিন নিয়ম করে এই একই দৃশ্যাবলী দেখে ভিতরটা আমার এক অনির্বচনীয় আরামে ভরে যায়। চেলোর সুরের মূর্ছনায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে দূর থেকে দূরান্তরে, যেখানে একাকিত্বের কষ্ট আমায় স্পর্শ করতে পারবেনা, একতরফা ভালোবাসে পরাভূত হওয়ার জ্বালা আমায় জাপ্টে ধরবেনা। অজান্তেই চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, গলায়, বুকে, আমার ফ্ল্যাটের কার্পেটমোড়া ফ্লোরে।
দুটিতে মিলে গল্প করতে করতে রাতের রান্নার আয়োজন করে, ছেলেটা মেয়েটাকে চামচে করে খাইয়ে দেয়, তারপর খাওয়াশেষে সোফায় বসে দুজনে কত রাত অব্দি টিভি দেখে, গল্প করে। সারাদিনে ওদের গল্প বুঝি শেষই হয়না। বিরক্ত লাগে আমার, সরে আসি জানালা থেকে, শুরু হয় আমার পর্দার আড়াল।
আমি মেখলা, মেখলা বসু, কলকাতার লেক গার্ডেনসে বাড়ি, বাবা মায়ের বড় আদরের, গর্বের ধন, ছোট্টবেলা হতে প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম ব্যতিত, দ্বিতীয় কখনো হইনি, বাবার সাধ ছিল মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে, মায়ের ডাক্তার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে খুব রেয়ারলি বাবা মায়েদের এই দুটি ভিন্ন আলাদা কোন উচ্চাশা থাকে। দুটোর কোনোটাই হইনি, হওয়ার উপায় ছিলোনা, কারণ অনির্বান। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, অনির্বান। আমার মনের প্রাণের অনি। লম্বা, ফর্সা, এক মাথা কাঁকড়া চুলের অনির্বান ছিল আমাদের ক্লাসের প্রায় প্রতিটি মেয়ের হার্টথ্রব। দারুন ফুটবল খেলতো, অসাধারন গিটার বাজাতো, আবার দরদী কবিতাও লিখতো। ফেটাল কম্বিনেশন যাকে বলে। অনির্বান সকলের সাথেই মিশতো, হাসতো, আড্ডা দিতো। কিন্তু ওর যাবতীয় মনের কথা, স্বপ্ন শেয়ার করতো কেবলমাত্র আমার সাথে। ওর লেখা কবিতা পড়ার, ওর তৈরী সুর শোনার প্রথম অধিকার আমার, সে অধিকার আমায় কোনোদিন ছিনিয়ে নিতে হয়নি, অনির্বানই দিয়েছে। একটা আপাতসাধারণ দেখতে মেয়ে আমি, পড়াশুনায় ভালো হওয়ার সুবাদে, সমীহ পেয়েছি প্রচুর, কিন্তু বন্ধু আমার ওই একটিই ছিল। তাই অনি যখন সিদ্ধান্ত নেয়, উচ্চমাধ্যমিকের পর আস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে পড়াশুনা করবে, আস্ট্রো-ফোটোনিক কম্পোনেন্ট নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করে মহাবিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটন করবে, আমি আর অন্যদিকে তাকাতে পারিনি, স্ট্রিম আলাদা হয়ে যাওয়ার অর্থ অনির্বানের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া, আর ওর থেকে আলাদা হলে আমার সম্পূর্ণ অর্থে একা হয়ে যাওয়া। অগত্যা জয়েন্টের পরীক্ষাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভর্তি হই দুজনে সাইন্স কলেজে। বি.এস.সি, এম.এস.সি, দুটো পরীক্ষাতেই তুখোঁড় রেজাল্ট করি, অনির্বানের দেখাদেখি আপ্লাই করি নামধারী মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। আমার ইচ্ছা ছিল ক্যালটেকে পি.এইচ.ডি টা করার, কিন্তু অনির্বান সেখান হতে ডাক পায়নি, অতঃপর, বোস্টন শহরে অবস্থিত এম.এই.টি তে শুরু হলো আমাদের দিনযাপন। খরচ কমাতে আমিই প্রস্তাব রাখি, একটিই ষ্টুডিও এপার্টমেন্ট নিয়ে দুজনে থাকার। কেন খামোকা আলাদা বাসা ভাড়া করে খরচ গুনবো, ডলার সস্তা নাকি। মিথ্যে বলবোনা, একসাথে থাকার, ওকে চব্বিশটা ঘন্টা দেখার, আদর করার আকাঙ্ক্ষা আমার এতদিনকার মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে জাস্ট ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিল। খুব ভালো ছিলাম, রোজই যেন পিকনিক আমার কাছে, একসাথে রান্না করা, খাওয়া, পড়াশুনা, ল্যাবে যাওয়া, সাপ্তাহিক বাজার করা, মাঝেমধ্যে রেস্তোরায় যাওয়া। স্বপ্নের মতো দিন কেটে যাচ্ছিল। তারপর আসে সেই বহুল প্রতীক্ষিত রাত, যেটুকু আড়াল, যেটুকু ব্যবধান ছিল মাঝে, মিটিয়ে দিয়ে কাছাকাছি এলাম দুজন, মনে আছে, সেরাতে প্রচন্ড ঝড়, শিলাবৃষ্টি হয় বোস্টন শহরে। আমাদের ছোট্ট বাসাও সে’রাত উত্তাল ঝড়ের সাক্ষী হয়। একদিনের আকস্মিকতা প্রাত্যহিক নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। ভার্সিটি থেকে ফিরতে দেরি, উন্মত্তের মতো মেতে উঠি দুজনে নতুন চেনা এই শরীরী খেলায়।
কিন্তু নিয়ম যতই ভালো লাগার হোক, ব্যাঘাত তাতে ঘটলো একদিন, ভালো লাগায় ফাটল ধরলো, ফাটল যখন সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো, তখন আর তাকে মেরামত করা গেলনা, চলে গেলো অনির্বান।
আদর করে, অভিমান করে, সিন্ ক্রিয়েট করে চেষ্টা করেছিলাম আমি, অনিকে আটকাতে, পারিনি।
এখনো কানে বাজে অনির চলে যাওয়ার মুহূর্তে আমায় বলা কথাগুলো, “উই আর স্টিল ফেন্ডস, মেখলা।”” আমি হিসহিসিয়ে উঠি, “”ফ্রেন্ডস, জাস্ট ফ্রেন্ডস অনি? ডু ফ্রেন্ডস এন্ড আপ ফাকিং ইচ আদার, লাইক এভরি নাউ এন্ড দেন?”
অনির্বান কেমন নিষ্ঠূর হেসে বলে, “”তুই বাচ্চা নাকি, মেখলা? যা করেছি, যা হয়েছে, দুজনের সম্মতিতে। আই নেভার ফোর্সড মাইসেলফ অন ইউ, এন্ড ইউ নো দ্যাট।””
“”তুই আমায় চিট করলি, অনি।“, আমি ভেঙে পড়ি, “এত বড় প্রতারণা করলি আমার সাথে। আমার সাথে দিনের পর দিন শুয়ে, তুই অন্য একটি মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ালি!””
বোধহয় কিছু মানবিকতাবোধ, ছোটবেলার সেই আত্মিক টানের কিছুটা তখনও ওর মধ্যে অবশিষ্ট ছিল। একসাথে থাকা কুকুর বেড়াল আঘাতপ্রাপ্ত হলেও মানুষ কষ্টবোধ করে, আর সেখানে আমি তো জলজ্যান্ত মানুষ একটা, তায় এতদিনকার বন্ধু। অনি আমায় মেঝে হতে উঠিয়ে সোফায় বসায় , জল খাওয়ায়, তারপর আমি যেন ছোট্ট শিশু এমনভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “”তুই বল, আমরা কি কোনো কমিটেড রিলেশনশিপে ছিলাম কোনোদিন? আমি প্রোপোজ করেছি কোনোদিনও তোকে? তুইও তো কোনদিন বলিসনি কিছু আমায়। আমি ভালোবাসি তোকে, কিন্তু আই ফিল ভেরি স্ট্রংলি এবাউট ন্যাটালি। প্লিজ ডোন্ট মেক দিস এনিমোর ডিফিকাল্ট ফর মি দ্যান ইট অলরেডি ইজ।””
সত্যি তো, মৌখিক অনুমোদন ছাড়া এমন সম্পর্কের ভিত্তিই নেই, নেই কোন অর্থ, কোন সোশ্যাল এক্সেপটেন্স। আমরা শুধুই মজা লুটছিলাম, সবটাই ভীষণ পশুবৎ ছিল, আবেগের বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব কি ছিল কোথাও?
ম্লান হেসে সুধাই ওকে, “”কি চাস অনি? আমার ব্লেসিংস?””
অনির্বান চলে যায়, আমাদের সাজানো সংসার ছেড়ে, আমায় ভীষণরকম একা, এবং নিঃস্ব করে দিয়ে চলে যায় ও।
ও চলে যাবার পর দেখা হতো, এখনো হয়, না আলাদা করে মিট করিনা, একই গবেষণাগার আমাদের, তাই কর্মসূত্রে দেখা হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী, ন্যাটালিও আমাদের সাথেই ডক্টরেট করছে, দেখতাম দুজনকে, কাজের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সবটা সময় ওদের একে অপরের জন্যই তোলা থাকতো। প্রথম প্রথম চক্ষু লজ্জার খাতিরে অনি আমায় ওদের সাথে লাঞ্চ করতে আহ্বান জানাতো, আমি মৃদু হেসে এড়িয়ে যেতাম, এখন ওরাও আর ডাকেনা। আমি নিশ্চিন্ত।
মন দিয়ে একনাগাড়ে কাজ করে যেতাম, কাজ ছাড়া নিজের আলাদা কোনো জগৎ ছিলোও না। বুঝতে পারছিলাম আস্তে আস্তে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিলাম, মন মাথা কোনোটাই নিজের আওতায় ছিলোনা আর, যন্ত্রচালিতের মতন দিন কাটছিল। একটু একটু করে বোধ করি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।
হঠাৎ আমার নিষ্প্রভ নির্জীব রুটিনেও কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্য দেখা দিলো। অনি চলে যাওয়ার ঠিক দেড় মাস বাদে যেই বাড়িতে আমি এপার্টমেন্ট নিয়ে ভাড়া থাকি, তার উল্টোদিকের বাড়িতে একদম আমার ফ্লাটটার সামনাসামনি ফাঁকা এপার্টমেন্টে নতুন ভাড়াটে এলো।একটি অল্পবয়স্ক দম্পতি, বিবাহিত কিনা এখনো জানিনা, শুধু এইটুকু জানি, ওরা আসার পর আমার থমকে থাকা দিনগুলো নতুন করে জেগে উঠল। আমার ফ্ল্যাটের মুখোমুখি ওদের নতুন বাসাখানা।
যেদিন ওরা বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে প্রথম এলো, সেদিন ছিল ঝকঝকে এক সকাল, রবিবারের ছুটির দিন, আমি প্রতিদিনকার মতো, কফি আর বিস্কিট নিয়ে আমার প্রিয় জানালার সমুখে গিয়ে বসেছিলাম, অনির্বান চলে যাওয়ার পর থেকে কেন জানি এই জানালাটা আমার একপ্রকার আশ্রয় হয়ে উঠেছিল, সামনের রাস্তাটা ঘুরে গিয়ে ডানদিকে একটা খুব সুন্দর পার্ক ছিল, একদৃষ্টে সেই ঘন সবুজের দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ে থাকতাম, কি ভাবতাম, কি দেখতাম, কিচ্ছু জানিনা, কিন্তু মনের গহীনে গুমরে গুমরে ওঠা কষ্টটাকে কিছুক্ষনের জন্য হলেও ভুলে থাকতে পারতাম। সেদিনও সেই উদ্দেশ্য নিয়েই বসেছিলাম, হঠাৎ একটা প্যাকার্স-মুভার্সের গাড়ি সশব্দে এসে উল্টদিকের বাড়িটার সামনে পার্ক করে, গাড়ি থেকে নেমে আসে একটি লম্বা দোহারা চেহারার অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ে, বয়স আনুমানিক ২৫-২৬। সঙ্গে একটি মাঝারি উচ্চতার ছেলে, চোখে চশমা, সেও খুব সুন্দর,বয়স মেয়েটির সমানই হবে।
মেয়েটার মুখে যেন খৈ ফুটছে, আসা ইস্তক কথা বলেই চলেছে, তুলনায় শান্ত গম্ভীর ছেলেটি অনেক বেশি তৎপর, গাড়ি থেকে খুব যত্নের সাথে বাক্স, ব্যাগ বের করে করে পেভমেন্টে রাখছে। খুবই সাধারণ দৃশ্য, ক্ষনিকের কৌতূহল নিবৃত্ত করে, আবার পার্কের দিকে ফিরে বসলাম, কিন্তু অবাধ্য চোখের দৃষ্টি ফের ছেলে মেয়ে দুটির দিকে ফিরে যায়, কেন যে এমনটা হচ্ছে কে জানে, প্রতি রবিবারের সকালে বাড়ির সামনের রাস্তায় তো এমন কতই সাধারণ গতানুগতিক ঘটনা ঘটতেই থাকে, কোনদিন ফিরেও চাইনা, আজই ব্যতিক্রম কেন? হঠাৎ দেখি, ছেলেটা একটা বড় বাদ্যযন্ত্রের বাক্স গাড়ি থেকে বের করে খুব আলতো করে সাবধানে রাখলো। খুব চেনা চেনা লাগলো, কি আছে ওতে?
ওদের গোছাতে গোছাতে বেলা বয়ে গেলো। বিদেশে একটা সুবিধে আছে, ভাড়ার ফ্ল্যাটগুলো মোটামুটি ফার্নিশড থাকে, মানে শোয়ার বিছানা (খাট নয়, একটা গদির উপর আরেকটি চাপানো), ডাইনিং টেবিল চেয়ার, সোফাসেট, ওয়ার্ডরোব এগুলো মোটামুটি মজুতই থাকে, তাই সঙ্গে করে জামাকাপড়, বই-খাতা, আর টুকটাক বাসন, শখের দুই একটি দ্রব্য ছাড়া কিছু বয়ে আনার প্রয়োজন বিশেষ নেই বললেই চলে। লক্ষ করলাম, এই দুটিতে অনেক কিছুই নিয়ে এসেছে, বেশ কিছু ফোল্ডেড ফার্নিচার, যেমন বইয়ের তাক, জামাকাপড়ের তাক, ইয়া বড় একটা টিভি, আর…….একটা চেলো।
তাই বুঝি এত চেনা চেনা ঠেকছিল, বাদ্যযন্ত্রের বাক্সটি। মেয়েটাকে দেখি, চেলোটাকে ওটার বাক্স থেকে বের করে নিয়ে চেয়ারে বসতে, ছেলেটা বোধহয় নাইতে গেছে। সুর ভেসে আসছে ওদের বসার ঘর হতে আমার ওয়ান রুম ষ্টুডিও এপার্টমেন্টে। ভালো লাগছে, খুব ভালো লাগছে আমার।
একি আমি কাঁদছি কেন? ভীষণ কান্না পাচ্ছে, কাঁদছি আমি, কাঁদতে কাঁদতে অনেক বছর পিছিয়ে যাচ্ছি। পিছিয়ে যেতে যেতে হুট করে আমার কলকাতার বাড়ির দোতলার কোনার বড় ঘরটায় চলে এলাম।
আমার এক জ্যাঠা খুব সুন্দর চেলো বাজাতেন, অকৃতদার মানুষ ছিলেন, বহুবছর বিদেশে চাকরি করে, আমাদের বাড়ির উপরের অংশে এসে উঠলেন, মধ্যরাত হলেই চেলোর সুরে আলাপ জমাতেন মোৎজার্টের সোনাটা, ভিভাল্ডির ফোর সিজনসের, গ্লোরিয়ার সাথে। রবি ঠাকুরকেও চিনেছি নতুন রূপে আমার এই জ্যেঠুর চেলো রিসাইটালে।
বাবা মা বিরক্ত হতেন, পাড়া প্রতিবেশী হতেও বহুবার অভিযোগ এসেছে, বাধ্য হয়ে জ্যাঠা বন্ধ করে দেন, তারপর বেশিদিন বাঁচেনও নি, খুব আঘাত পেয়েছিলেন।
আমার উৎসাহ দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন, আমি ফরমায়েশ করলে, ফেরাতেন না, তাঁর হাত ধরেই আমার সুরের সাথে পরিচয়, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা। আজ পিছন ফিরলে মনে হয় অনিকে ভালোবাসার এটাও বুঝি একটা প্রধান কারণ ছিল, অনি খুব সুন্দর গিটার বাজাতো।
জ্যেঠু চেয়েছিলেন, আমি চেলো শিখি, এমনকি মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আমার থেকে কথা অব্দি নিয়েছিলেন।
বাবা মা চান নি লেখাপড়া বাদ দিয়ে অন্য কিছু করি, তাই শত ইচ্ছে থাকলেও, আমার আর চেলো শেখা হয়ে ওঠেনি। আমার জেদ, জেঠুর শেষ ইচ্ছা, আমার মা বাবার স্বপ্ন-আকাঙ্খার কাছে গো হারা হেরে যায়।
আমার সদ্য আগত প্রতিবেশীদ্বয় প্রায় বিস্মৃত একটুকরো ছোটবেলাকে ফিরিয়ে আনলেন কি? আমার জানালা দিয়ে ওদের ফ্ল্যাটের অনেকটা অংশ দেখা যায়, অনুমান করছি, ওদের বারান্দায় দাঁড়ালে আমার ছোট্ট ফ্ল্যাটেরও প্রায় পুরোটাই দেখা যাবে। অন্যের ঘরে উঁকি দেয়ার অভ্যাস বা রুচি আমার কোনোদিনও ছিলনা, কিন্তু অনেকদিন পর সামনের ফাঁকা ঘরটাতে প্রাণের স্পন্দন দেখতে পেয়ে, নিজেকে আর অতটা একা লাগছেনা, প্রাথমিক বিরক্তি কেটে গিয়ে ক্রমশ কৌতূহল, একনতুন প্রকার ভালো লাগায় মন ভরে উঠছে, মনকে সমাহিত করে রাখার উপায় হঠাৎ করেই যেন আমার হাতে ধরা দিলো। না, তাই বলে ওদের একান্ত আপন মুহূর্তে আমি অসভ্যের মতো নজর রাখতে চাইনা, কিন্তু খুব চাই ওদের রোজকার জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের সাক্ষী হতে।
চলতে থাকে জীবন, কাটতে থাকে দিন, এখন ইউনিভার্সিটি গেলে অপেক্ষা করে থাকি কাজ শেষ হবার, কতক্ষনে বাড়ি ফিরব, বাড়ি ফিরে তড়িঘড়ি ধড়াচুড়ো ছেড়ে কফি আর বই হাতে জানালায় গিয়ে বসি। ওরা নির্দিষ্ট সময়ে ফেরে, প্রতিদিন ৬-টায়, ঘড়ির কাটায় কাটায়। ছেলেটি চা বা কফি বানায়, মেয়েটি পোশাক ছেড়ে এসে চেলো হাতে টেনে নেয়, আর আমি?
নিমেষে বোস্টনের কলেজপাড়া হতে লেকগার্ডেনসের বাড়ি, জেঠুর ঘরে, আমার ছোটবেলায় ফিরে যাই, ছোটবেলায় বাঁচি।
মেয়েটার হাত থামলে, আমিও ফিরে আসি বর্তমানে, বাস্তবে, একাকিত্বের ঘেরাটোপে। ওরা পড়াশুনা করে, আমিও করি, ওরা রাতের খাবার খায়, ছেলেটিই বানায়, আমি আমার রাতের খাবারের ব্যবস্থা করি। তারপর ওরা একটি কম্বল নিয়ে বাইরের ঘরের সোফায় গুটিশুটি করে বসে, টিভি দেখে, আমি জানালায় দাঁড়িয়ে দেখি কিছুক্ষন, ওরা গল্প গল্প করতে হাসে, খুনসুটি করে, শান্ত ছেলেটিও প্রানখুলে হাসে, কি ভালো লাগে, আমিও হাসি। কিছুক্ষন পর আর ভাল লাগেনা, বড্ড একঘেয়ে লাগে, বিরক্তি আসে, রাগ হয় প্রচন্ড, কার উপর, কেন, জানিনা, পর্দা দিয়ে ঢেকে দিই জানালা, বাতি নেভাই, শুয়ে পড়ি।
আমি কি পরশ্রীকাতর হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ? এমন তো আমি ছিলাম না, বন্ধু হয়তো আমার কোনোদিনই সেরম ছিলোনা, কিন্তু হিংসা, পরশ্রীকাতরতা তো কোনোদিনও আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট ছিলোনা। ঘুম হয়না ভালো।
আবার কোনো কোনো দিন চেলোর মিঠে সুর ঘুমপাড়ানি গানের মতো কাজ করে, নির্বিঘ্ন ঘুম হয় আমার, সুখ স্বপ্ন দেখি, নতুন আশার, নতুন আলোর। এক অবর্ণনীয় আনন্দ নিয়ে পরদিন সকাল ঘুম থেকে ওঠি, সারাটা দিন কাজে কম্মে কথায় বার্তায় সুন্দর করে কেটে যায়।
একদিন মধ্যরাতেও ঘুম আসেনি, ঠায় বসে আছি জানালায়। একদৃষ্টে চেয়ে আছি উল্টোদিকের বাড়িটির দিকে, ওদের জানালায় পর্দা টানা, বারান্দার দরজা বন্ধ। ওরা ঘুমোচ্ছে বোধ হয়, সেটাই তো স্বাভাবিক।
আচ্ছা, ওরা একসাথে আছে বলেই বুঝি ওদের ঘুম এত গাঢ়, নির্বিঘ্ন। অনি চলে যাবার পর, আমার ঘুম এমনিতেই কমে এসেছিল, এরা যেদিন এলো, সেই রাতে অবশ্য অনেকদিন পর খুব গাঢ় ঘুম হয়েছিল, যাকে বলা হয় সাউন্ড স্লিপ। আজ কেন মন এমন আনচান করছে। কেন মনে হচ্ছে আমি নিজেকে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি, বদলে যাচ্ছি। হঠাৎ লক্ষ করি, ওদের ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমে আলো জ্বলে উঠলো, দরজা খুলে মেয়েটা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, চুল উস্ক-খুস্ক, পরনের নাইট ড্রেস সামান্য অবিন্যস্ত, বারান্দার রেলিং ধরে, মেয়েটা চারিপাশ দেখছে, নিস্তব্ধ রাত, সামনের রাস্তার দুই পাশে সারি দিয়ে গাড়ি পার্ক করা, কালচে আকাশে কয়েকটা তারা ফুটে রয়েছে, হালকা হাওয়া দিচ্ছে।মেয়েটা কি চোখের জল মুছলো, কাঁদছে কি? ইতি উতি দেখতে দেখতে মেয়েটার দৃষ্টি আমার উপর এসে নিবদ্ধ হলো।
আমি দেখছি ওকে, ওও দেখছে আমায়, কতক্ষন এমন কেটেছে জানিনা, বোধ হয় ছেলেটা ডাক দিলো ভিতরের ঘর থেকে, মেয়েটা পিছন ফিরে কি একটা বললো, তারপর পুনরায় আমার দিকে ফিরে চাইলো। পিং করে আমার ফোনে মেসেজ ঢুকলো, ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি, ইস্কুলের বন্ধুদের ওয়াটসাপ গ্রূপের মেসেজ, ফোন থেকে মুখ তুলে দেখি, মেয়েটা ঘরে ফিরে গেছে। ওদের ফ্ল্যাটের আলো নিভানো।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে প্রায় ১২ টা বেজে যায়, কি অবস্থা, দুদ্দাড়িয়ে ইউনিভার্সিটি ছুটি, গিয়ে শুনি, স্যার আসেন নি, যাই হোক, কাজ গুছিয়ে বসি, গতরাতে মেয়েটার আমার দিকে তাকানোটাকে কোনোমতে মাথা থেকে সরাতে পারিনা, কি দেখছিলো ও, ও কি বুঝতে পেরেছিল আমার জানালায় এসে বসার কারণ, কিন্তু ওর হাবভাবে কোনো প্রকার চাঞ্চল্য অনুভব করিনি।
আমায় চিন্তায় মগ্ন দেখে অনি এসে প্রশ্ন করে কি হয়েছে আমার। চিন্তার সুতোখানা যায় ছিড়ে, মৃদু হেসে বলি, “”কিচ্ছু না।””
খেয়াল করে দেখি, ন্যাটালি আজ আসেনি, তাই বুঝি অনির নজর পড়লো আমার উপর। অনিকে কি একটু কৃশ লাগছে? আমার অবশ্য ওকে নিয়ে ভাবার সময় বা ইচ্ছা এখন নেই।
“”কেমন আছিস, মেখলা?”” “”ভালো, তুই?”” অনি আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে, “”ভালো না। খুব একা লাগে।””
একা? মেয়েটাকে গতকাল বারান্দায় বড্ড একা লাগছিল, খেয়াল করে দেখেছি মেয়েটা সময়মতো বাড়ি ফিরলেও ছেলেটা অনেক রাতে ফিরেছে, কাল মেয়েটার চেলোয় বিষাদের সুর বেজে উঠছিল বারবার, বসে থাকতে পারিনি আমিও একনাগাড়ে। খুব অস্থির লাগছিলো। ইদানিং ছেলেটার কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ অনেকটা রাত হয়ে যাচ্ছিলো। কোনো কোনো দিন মেয়েটা চেলো নিয়ে বসতো, কোনো কোনো দিন ফিরেও তাকাতোনা, ভীষণ এক নীরবতা গ্রাস করছিলো মেয়েটিকে, এদিকে আমায়।
দূর হতে অনির আওয়াজ এসে ধাক্কা মারে কানে, চিন্তাগুলো ভেঙে খান খান হয়ে যায়, “”আজ তোর কাছে থাকতে দিবি, মেখলা?””
অনি বোধ হয় আরও কিছু বলতে চাইছিল, ওকে থামাতে আমি আলগোছে “”ঠিক আছে”” বলে ওয়াশরুমে চলে যাই, চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দি। কাজে মনোনিবেশ করার বিফল চেষ্টা করে যাই। বাড়ি ফিরি। পর্দা সরাই, জানালা খুলি, ওই তো, আজ আমার আগেই মেয়েটা ফিরে এসেছে, ওমা ও সোফায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে কেন? ছেলেটা কোথায়? হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ, দরজা খুলে দেখি, একটা দামি সুদৃশ্য ওয়াইনের বোতল নিয়ে অনির্বান।
ভেতরে আসতে বলি। ফ্ল্যাটের সবটাই তো ওর চেনা, নখদর্পনে। রান্নাঘরে গিয়ে নির্দিষ্ট ড্রয়ার খুলে বটল ওপেনর বার করে, তারপর, ওরই একসময়ে কেনা ওয়াইন গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে আমায় অফার করে। সিপ্ করিনা, ঢকঢক করে খেয়ে নি, অনি অবাক হয়, ও জানে আমি ওয়াইন তারিয়ে তারিয়ে খেয়ে উপভোগ করি। ও আরো দেয়, আমি আবারো পুরোটা একবারে গলায় ঢেলে দিই। মাথাটা দ্রিমদ্রিম করে, অনির ফোনে বাজে সোমলতার মাদকীয় গলায় কি একটা গান। বেশ ভালো লাগে, গানের ছন্দে ছন্দে দুই একবার পাক দি, বেসামাল হয়ে পড়ার উপক্রম হতেই অনি আমায় জড়িয়ে ধরে, দুজনেই হেসে ফেলি, হাসতে হাসতে জানালার দিকে ফিরে দেখি মেয়েটা এক ঠায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে, আগুনরঙা চুল খোলা, হাওয়ায় উড়ছে, ওর দৃষ্টি আমাদের উপর নিবদ্ধ। হঠাৎ কোমরে ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠি, ঘাড়ের উপর অনির উষ্ণ শ্বাসের ওঠা নামা টের পাই, ঘুরে দেখি অনির চোখ, সেই পাগলপারা রাতের মতো চাহনি, ওয়াইনের নেশায় বুঝি আরো ঘন, ও ঠোঁট এগিয়ে দেয় আমার দিকে, আবার বুঝি “”দিনগুলি মোর সোনার খাঁচার”” ফিরে পেলাম ।
অকস্মাৎ আমাদের ঘন হয়ে ওঠা শ্বাস-প্রশ্বাস, সোমলতার ভরাট গলা ছাপিয়ে বেজে উঠলো ভিভাল্ডির ফোর সিজন সিরিজের উইন্টারের সুর। আমার নেশা গেলো ছুটে, অনিকে সরিয়ে দিয়ে জানালার আরও ঘন হয়ে দাঁড়ালাম, মেয়েটা চোখ বন্ধ করে মনপ্রাণ ঢেলে চেলো কে আপন করে নিয়েছে, সুরের মধ্যে দিয়ে রচনা করে চলছে ওর আর আমার জীবনের এক বিস্ময়কর অন্তমিল, সংগীতের ভাষায় যাকে বলে সিম্ফনি।
অনিকে ফিরে যেতে বলি, আমি আমার একাকিত্বকে ভালোবেসে ফেলেছি। শুধু মেনে নেওয়াটারই ছিল অপেক্ষা।
লরেন আর আমি এখন খুব ভালো বন্ধু। লরেন, আমার উল্টোদিকের বাসার ভাড়াটিয়া মেয়েটা। ও আমায় চেলোয় সুর তোলা শেখায়, পরিবর্তে আমি ওকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ শেখাই। নিরুপন করেছি, জ্যেঠুকে দেয়া কথা রাখার দায় আমার, বাবা মায়ের নয়।
লরেনের বয়ফ্রেন্ড কেভিন, খুব ভালো ছেলে, ব্রিটিশ, এখানে এম.বি.এ করতে এসেছিলো, এম.বি.এ. শেষে একটা ফার্মে ফিনান্সিয়াল ম্যানেজার এর পদে কাজ করছিলো।
কেভিন ইংল্যান্ড ফিরে গেছে, মানে হঠাৎ করেই ফিরে যেতে হয়েছে, অনেকদিন ধরেই সেটির প্রস্তুতি চলছিল, ওর বাবা বহুকাল যাবৎ অসুস্থ ছিলেন, প্রায় না থাকার মতোই ছিলেন,হঠাৎ করে মারা গেলেন, ওকে গিয়ে ব্যবসার দায়িত্ব বুঝে নিতে হয়।
ওর চলে যাওয়াটা লরেন মেনে নিতে পারেনি, আসলে লরেনও খুব খুব একা, মা মরা মেয়ে, বাবা ছোটবেলায় ওকে আর ওর মাকে ত্যাগ করে অন্যত্র সংসার পেতেছিলেন, দিদিমার কাছে মানুষ। কেভিন ওর জীবনে আসায় লরেন যেন নতুন করে বাঁচতে শিখেছিল, উচ্ছল ঝর্ণার মতো হয়ে জীবনটাকে উপভোগ করতে চেয়েছিল, কেভিনের উপর এতখানিই নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। ওদের আলাপ কোনো এক মিউজিক্যাল কনসার্টে, লরেনের চেলোর সুরের বাঁধনে সেদিন বাঁধা পড়েছিল দুটি ভিনদেশি প্রাণ।
অনির্বান যেইদিন আমার ফ্ল্যাটে আসে, সেদিন খুব ভোরেই কেভিন চলে যায়, বেলা অব্দি ঘুমিয়েছিলাম বলে কিছু বুঝতে পারিনি। লরেন ভেঙে পড়েছিল, আপ্রাণ চেষ্টা করছিল নিজেকে তুলে ধরার, আশ্রয়ের সন্ধান করছিল ওর মিউজিকের কাছে। সেই রাতে ভিভাল্ডির সুরের ছোঁয়ায় আমাদের চারিপাশের নিস্তব্ধতা যখন অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছিল, অনির প্রতি নেশার শেষ রেশটুকুও আমার কেটে গিয়েছিল চিরতরে। অনিকে ফিরিয়ে দিয়ে, পরদিন লরেনের কাছে ছুটে যাই, কলিং বেল বাজালে প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় একটি মেয়ে এসে দরজা খোলে, সেই প্রথম ওকে সামনে থেকে দেখি, ও অবাক চোখ মেলে দেখছিলো আমায়, তারপর আস্তে আস্তে ওও চিনতে পারে আমায়। জ্বরে লরেনের গা পুড়ে যাচ্ছিল, ওকে গরম খাবার আর প্যারাসিটামল খাইয়ে ইউনিভার্সিটি যাই, কিন্তু মন পড়ে থাকে ওর কাছে। ফিরে আসি তাড়াতাড়ি, স্পঞ্জ করে মুছিয়ে দিই ওর হাত পা মুখ, তিনদিনেই মেয়েটা কেমন মলিন হয়ে গেছে। রাতের দিকে যখন জ্বর ছাড়ে, কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে আমার কোলে। ভোরের দিকে ওর ফোনে কেভিনের ফোন আসে, ও তখন গভীর ঘুমে আছন্ন, কেভিনকে ওর অবস্থার কথা খুলে বলি। কেভিন আমায় বারবার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে থাকে। বুঝি কেভিন পালায়নি, কেভিনের লরেনকে ছেড়ে যাওয়াটা সাময়িক বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে। কেভিনকে আস্বস্ত করি, লরেনকে বুঝিয়ে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নি। লরেনের মনে পুরুষের প্রতি হৃত বিশ্বাসকে ফেরাতেই হবে, ওকে বুঝতে হবে কেভিনের সাথে বাবার তুলনা করলে ওই ঠকবে, ওই হারবে। নিরাপত্তাহীনতা সমস্যাকে ঘনীভূত করে, সমস্যার সমাধান করেনা। নিজেও উক্ত সারসত্যটি অনুভব করি, লরেনকেও বোঝাতে সক্ষম হই।
আসছে সামার আমরা সাসেক্স যাচ্ছি, কেভিনের খামারবাড়িতে, আমি, লরেন, কেভিন, আর ম্যাক্স। ম্যাক্স ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টে সম্প্রতি পোস্ট ডক এসোসিয়েট হিসেবে যোগ দিয়েছে, বেশ হাসি খুশি সরল ছেলে, লরেনের বিল্ডিংয়েই থাকে।
লরেনের বিশ্বাস ম্যাক্স মনে মনে আমায় পছন্দ করে, ভীষণ পিছনে লাগে আমার মেয়েটা। লরেনের এম.এস শেষের পথে, ওর ইচ্ছা এর পর বাকি পড়াশুনা ইংল্যান্ডে গিয়ে করার।
থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, ম্যাক্সের অপেক্ষা করছি, আজ আমরা চারজনে মিলে সিনেমা দেখবো, আমি, লরেন, ম্যাক্স আর কেভিন। কেভিন কাজ থেকে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে, দুই মাস অন্তর অন্তর আসে, কদিন হেসে খেলে কাটিয়ে আবার ফিরে যায়।
সিনেমা শুরু হয়ে যাবে, কেন যে ছেলেটা এত দেরি করছে, লরেন কেভিন উশখুশ করে, ওদের জোর করেই ভেতরে পাঠিয়ে দি, আমি টিকিট হাতে দাঁড়িয়ে থাকি। হঠাৎ অনিকে দেখি, না অনির্বান, সঙ্গে ওর দুইজন বন্ধু, আমায় দেখে থমকে দাঁড়ায়, এগিয়ে আসে, “”কারোর জন্য অপেক্ষা করছিস, মেখলা?””
অদূরে ম্যাক্সকে দেখি, হন্তদন্ত হয়ে হেটে আসছে, এসেই কাচুমাচু মুখ করে, “”সরি মেখলা, টেরিবলি সরি ফর হ্যাভিং কেপ্ট ইউ ওয়েটিং। হিয়ার আর স্যাম ফ্লাওয়ার্স ফর দা প্রিটি লেডি।”” বলে একগুচ্ছ হলুদ গোলাপ আমার হাতে তুলে দেয়। অনির্বান অবাক হয়ে চেয়ে দেখে। “”আজ আসি রে অনির্বান, সিনেমা শুরু হয়ে গেছে। আই ক্যান নট বি লেট্ এনি লংগার।”” বলে হাত নেড়ে ম্যাক্সের সাথে এগোই।
থিয়েটারের দিকে হাঁটতে থাকি, “মাই ওয়েট হ্যাজ বিন লং ওভার।”
0 Comments