এই যা উপলব্ধি
প্রার্থনাসভা শেষ হলে স্টাফরুমে ঢুকে অবাক হয়ে যায় অমিত রায়। আশেপাশের বেশিরভাগ চেয়ার টেবিল ফাঁকা। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ নিয়ে প্রভিশনাল রুটিং খাতা বের করে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। আজ জীববিদ্যা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষা। এই স্কুল পরীক্ষার সেন্টার নয়। কিন্তু পাশের সেন্টারে শিক্ষক শিক্ষিকাদের ইনভিজিলেশন ডিউটিতে যেতে হয়। আজ চারজন টিচিং স্টাফ সেখানে গেছেন। অন্যদিকে স্থায়ী, পার্শ্ব ও অস্থায়ী সবমিলিয়ে এগারোজন শিক্ষক অনুপস্থিত। এই পনেরজন শিক্ষকের চৌষট্টি খানা ক্লাস কিভাবে ম্যানেজ করবে বুঝতে পারছিল না অমিত। মিহিরবাবু বলে উঠলেন, ‘আজকেও বের করেছেন চিত্রগুপ্তের খাতা ? স্টাফ রুম তো ফাঁকা। কাকে ক্লাস দেবেন ? সবারই তো চার পাঁচটা করে আছে।’ অভিক উঁচু গলায় ঘোষণা করলো, ‘আমার লিজার গুলোতে সব ক্লাস বসিয়ে দাও দাদা। আজ আটটাই ক্লাস করি।’ অনুপস্থিত শিক্ষকদের নামের লম্বা তালিকা লিখতে গিয়ে অমিত ভাবছিল প্রথম পিরিয়ডটা সামলাবে কিভাবে ! ছাত্রছাত্রীদের রোল কল হওয়াটা দরকার। হেডস্যার সল্টলেক বিকাশভবনে গেছেন পি.এফের কাজে। তাই ওনার সাথে পরামর্শ করার কোনো উপায় নেই।
প্রথম ক্লাস সেরে দোতলার করিডর দিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে আসছিল অমিত। উপস্থিত শিক্ষকদের দিয়ে কোনরকমে সামাল দেওয়া গেছে দিনের শুরুটা। সিঁড়ির কাছে নাইনের রুদ্র বললো, ‘স্যার, আজ আমরা খেলা দেখতে যাবো না ? আমাদের স্কুলের সেমি ফাইনাল আছে।’ খেলা সংক্রান্ত কোনো খবর অমিতের কাছে ছিল না। উঠোনে রঞ্জন স্কুলের ফুটবল টিম রেডি করে রেখেছে। চক, ডাস্টার, রেজিস্টার রেখে বেসিনে হাত ধুয়ে অমিত জিজ্ঞেস করলো, ‘কি ব্যাপার রঞ্জন ? কোথায় খেলা আজ ?’ উত্তমাশা হাইস্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষে আন্ত-বিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাই রঞ্জন আর নির্মলবাবু স্কুলের টিম নিয়ে রওনা হচ্ছে ১২টার মধ্যে। উত্তমাশা হাইস্কুল রূপনারায়ণের তীরে অবস্থিত এবং স্কুলের মাঠটি নদীবাঁধ লাগোয়া। ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের নক আউট খেলায় আমাদের স্কুল মুখোমুখি হবে ডাঙ্গারহাট হাইস্কুলের সাথে। বেশ কঠিন প্রতিপক্ষ’- বললেন নির্মলবাবু।
স্টাফরুমে মিটিংয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো , এতগুলো ক্লাস প্রভিশনাল দিয়ে সম্পুর্ন করা সম্ভব নয়। তাই চার পিরিয়ড শেষে মিড ডে মিলের পর ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দেওয়া হবে। আর কিছু শিক্ষক উত্তমাশা হাইস্কুলের মাঠে গিয়ে টিমের সাথে যোগদান করবে। বাকি স্টাফ রেজাল্ট তৈরি ও আনুষঙ্গিক কাজ করবে। চারটি মোটরসাইকেলে আটজন শিক্ষক ফুটবল মাঠের দিকে রওনা হয়। সাত কিলোমিটার রাস্তা, যার দু কিমি প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার ঢালাই রাস্তা আর বাকি পাঁচ কিমি গ্রামের কাদা মাটি পথ। অমিত আর উজ্জ্বল শেষের মোটরসাইকেলে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রাম দেখার সুযোগ অমিত আগে পাইনি। তাই এই পথটুকু অমিত কাছ থেকে গ্রামজীবন দেখার চেষ্টা করলো। রাস্তার বাঁ দিকে সমান্তরালে একটি খাল চলেছে। রূপনারায়ন থেকে এই খালটি এসেছে প্রধানত জমিতে জল সরবরাহের জন্যে। দুপাশেই কেবল চাষের জমি। তবে বেশিরভাগ ফসল কাটা হয়ে গেছে। মাঝেমাঝে বিক্ষিপ্তভাবে দু-একটা টিন বা টালির চালের ঘর দেখা যাচ্ছে।
ঢালাই রাস্তা শেষ হতেই সরু খালটি ডানদিকে চলে আসে। উত্তমাশা মূলত মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম। অধিকাংশই কৃষক পরিবারের বাস। তবে কয়েকটি ইট ভাটা থাকায়, শ্রমিকের কাজও করে গ্রামবাসী। মাটির রাস্তা বেশিরভাগ জায়গায় গর্ত এবং ঘোলা জলে পূর্ণ। কখনো বোঝাই যাচ্ছে না রাস্তা আছে কিনা। গতকাল দিনের বেশিরভাগ সময় বৃষ্টি হয়েছে। আজ সকাল থেকে রোদ থাকায় ফুটবল ম্যাচের কোনো অসুবিধা হবে না। মাঝেমাঝে ইউক্যালিপটাস এবং লম্বু গাছের ছায়া রাস্তাটিকে বেশ মনোরম করে তুলেছে। সামনে কয়েকটা চায়ের ও মুদির দোকান। আর তারপর রাস্তা দুদিকে বেঁকে গেছে। জিজ্ঞাসা করে নারকেল গাছ ঘেরা বাঁ দিকের রাস্তা ধরা হলো। একটু এগোতেই অমিত অবাক হয়ে গাড়ি থামাতে বললো। বিরাট ধানী জমির মাঝে প্রাসাদের মত দাঁড়িয়ে আছে মিনু মেনশন। অসামান্য কারুকাজ করা প্রাসাদোপম বাড়ি। পাশে লম্বা গাড়ির গ্যারেজ এবং তাতে পাঁচটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, যার মধ্যে দুটি বিদেশি। উজ্বল জানালো, ‘এই মেনশনের মালিক শেখ সাহেব। আরবে ব্যবসা করে। শুনেছি ওখানেও বিরাট অট্টালিকা আছে। বছরে একবার আসে, ঈদের সময়।’ চারিদিকে এত দারিদ্রের পাশে এই প্রাচুর্য বেমানান লাগছিল অমিতের।
ডানদিকে বাঁক নিয়ে উঁচু বাঁধে উঠে পড়লো মোটরসাইকেল। খালটি বাঁধের তলা দিয়ে সোজা চলে গেল নদীর সাথে মিশতে। বাঁধের উল্টোদিকে কয়েকটি ছোটবড় ইট ভাটা। চিমনিগুলো দিয়ে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কাঁচা মাটির ইটগুলো বিরাট মাঠে সারিবদ্ধভাবে রেখে সুন্দর একটা ডিজাইন তৈরি হয়েছে। ইটভাটার নাম চিমনির গায়ে লেখা। রিয়াজ, রয়াল, স্টার, রামকৃষ্ণ প্রভৃতি। মোহনা চিমনির পাশ দিয়ে নেমে নদীর ধারে উত্তমাশা স্কুলের মাঠ। চারিদিকে দর্শক মাঠজুড়ে দাঁড়িয়ে। দুটো টেন্ট খাটানো হয়েছে এবং তাতে অতিথির আসন সংরক্ষিত। রঞ্জন দৌড়ে এসে উত্তেজিত স্বরে বললো, ‘আরে দাদা, তোমরা দেরি করে এলে ? খেলার আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। আমরা এক গোলে পিছিয়ে। এখন স্কোর দুই,এক। আমাদের গোলকিপার শুরুতেই আহত হয়েছে। বিকল্প যে নেমেছে, সে কখনো কিপিং করেনি। অপোনেন্ট সেন্টার থেকে স্ট্রেট শটে গোল করেছে। ছি ছি, কি অবস্থা আমাদের ডিফেন্সের।’ বাকি পাঁচ মিনিটে কোনো পরিবর্তন হলো না। ডাঙ্গারহাট হাইস্কুল সেমিফাইনাল জিতে ফাইনাল খেলবে নন্দলাল ইনস্টিটিউশনের সাথে এক ঘন্টা পর। অমিত, উত্তম, অতনুরা টিমকে সহানুভূতি জানিয়ে টিফিনের প্যাকেট দিল।
স্কুল থেকে বেশ কিছু শিক্ষক সাইকেলে এসেছেন। ম্যাচের ফলাফল স্কুলের বিপক্ষে গেলেও কোনো শিক্ষক এই মনোরম পরিবেশে ছেড়ে ফিরতে চাইছে না। অমিত একাই নদীর দিকে এগিয়ে গেল। দুজন জেলে তাদের বিরাট নাইলনের জাল সেলাই করছে। “বাতাস লাইলে ডিঙি দুলি”- একটা আঞ্চলিক গান গেয়ে আর একজন সেলাই করতে বসে গেল। অমিত খালের পাশ দিয়ে খাড়া পাড় ছেড়ে সোজা নেমে গেল জলের ধারে। পাড় অন্তত বারো ফুট উঁচুতে। চারিদিক সবুজ ঘাস আর উলুখাগড়ায় ঢাকা। জলের ধারে পলি মাটিতে অজস্র ফুটো। কালো কাঁকড়ার কাজ এটা। খাল আর নদীর মিলনস্থলে একটা বিরাট নৌকো উল্টে আছে। একজন কালো কাপড় দিয়ে আলকাতরা লাগাচ্ছে। বিরাট এই রূপনারায়ন নদী। অপূর্ব রূপ, যেন চোখ ফেরানো যায় না। ওপারের কোনো কিছু দৃষ্টিতে আসছে না। হালকা ঢেউ অমিতের শরীর,মন ভিজিয়ে দিচ্ছে।
“কিগো অমিতদা, তুমি একাই নদীর হাওয়া খাবে ? আমরা যে এসে গেছি তোমার পেছনে, একবার তাকাও ”- সৌম্যর কথায় সম্বিত ফিরলো অমিতের। শিক্ষকরা সবাই পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে ফোটো তুলছে মোবাইলে। কুলকুল শব্দে নদীর জল খাল দিয়ে ঢুকছে। খালের উলুখাগড়াগুলো একটু বাঁধা দেবার চেষ্টা করছে শরীর দুলিয়ে। খাড়া পাড়ের ভাঙা অংশে লক্ষ্য লক্ষ্য শেকড় বেরিয়ে ঝুলছে। অমিত টেনে দেখলো বেশ শক্ত। হয়তো এই পাড় বহুদূর বিস্তৃত ছিল। কিন্তু ইতিহাস ভূগোলের পরিবর্তনে কালের করাল গ্রাসে চলে যায় ভূখণ্ড। জল আর মাটির খেলায় চিরকাল জয়ের শিরোপা মাথায় নিয়েছে জল। আজ তার ব্যতিক্রম হবে কেন ? হাজার বছর ধরে এখান দিয়েই ভেসে গেছে কত বাণিজ্যের ভান্ডার। দেওয়া নেওয়ার হিসেব মিটিয়ে হাসি কান্না ফিরে এসেছে ঢেউয়ের সাথে। এই নদী কত মানুষের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম। আবার বর্ষার প্রবল বন্যায় হাঁ করে গিলে ফেলেছে স্থাবর অস্থাবর সবকিছু। “কিরে অমিত, তুই কি কোনোদিন নদী দেখিসনি ? কি এত ভাবছিস নদীর দিকে তাকিয়ে ?” – প্রশ্ন করলেন নেপাল বাবু।
অমিত পাড় ধরে ওপরে উঠেই হঠাৎ দেখতে পায় খানিকটা দূরে এমনই ভাঙা পাড়ের ধারে একটি ছেলে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। স্কুলের পোশাক পরা ছেলেটির কোলে স্কুল ব্যাগও আছে। বাকি শিক্ষকদের সাথে একটু কথা বলে অমিত এগিয়ে যায় ছেলেটির দিকে। ওদিকে পাড়টা একটু বেশি ভাঙা, তাই অমিতকে লাফ দিয়ে যেতে হল। বেশ বিপদজনক খাড়াইতে ছেলেটি আনমনে বসে আছে। এই বয়সে এমন উদাস ভাব স্বাভাবিক নয়। কাছে গিয়ে সামান্য ঝুকে অমিত জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি একা এখানে বসে কি করছো ? পড়ে গেলেই তো বিপদ হবে ?” ছেলেটি তাকাতেই অমিত বিস্ময়ে বললো, ‘ আরে সাহিল, তুমি এখানে ? আর একা আছো কেন ? তোমার বন্ধুরা বা অভিভাবক কেউ নেই ?” ক্লাস ফাইভের ক-বিভাগের ছাত্র সাহিল। প্রথম দিন ক্লাসে বুদ্ধিদীপ্ত কথায় মুগ্ধ হয়ে অমিত মনিটর নিযুক্ত করেছিল সাহিলকে। গত তিনমাসে আচরণ, প্রশ্নোত্তরে অংশগ্রহণ, কবিতা পাঠ, স্কুলের চারা গাছগুলির প্রতি যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে সাহিল সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অমিত হয়তো একটু বেশি স্নেহ করে ওকে। কিন্তু স্কুল থেকে এতদূরে রূপনারায়নের তীরে সাহিলকে একা দেখে অমিত দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।
শিক্ষকরা সবাই ফাইনাল ম্যাচ দেখতে চলে গেলেন। অমিত ঘাসের উপর ব্যাগ রেখে সাহিলের পাশে পা ছড়িয়ে বসলো। পিঠে স্নেহের হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি ব্যাপার সাহিল ? তোমার মন খারাপ ? বাড়িতে সবাই ভালো আছেন তো ?” সাহিল নদীর দিকে তাকিয়েই উত্তর দিল, ‘আব্বু গুজরাটে কাজ করতো সোনার দোকানে। দু বছর আগে ক্যানসার ধরা পড়ে। ফিরে আসে গ্রামে। কলকাতায় চিকিৎসা হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে বাঁচবে না। আম্মি সারাক্ষণ কাঁদে। আব্বুকে আমার মন তেমন টানে না। কোনদিন তাকে কাছে পাইনি। কিন্তু আম্মি আমার সব। যখন আম্মির দিকে তাকাই , দেখি চোখের পানি মুছছে। আজ খুব খারাপ অবস্থা শুনে আম্মি কলকাতায় গেছে আব্বুর কাছে। জানিনা আব্বু আছে না আল্লতালার কাছে চলে গেছে।’ অমিত বুঝতে পারলো না সান্ত্বনা দেবে না আত্মবিশ্বাস। এমন আকস্মিকতায় সব কথা যেন গলার মধ্যে আটকে গেছে। আরো অবাক হল দশ বছরের একটা বাচ্চার মধ্যে এমন ভাবলেশহীন বিবাগী ভাব দেখে। খানিকটা গলা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘উপরওয়ালা এত নিষ্ঠুর নয় সাহিল। তোমার আশ্রয় ভেঙে যাবে না। ভরসা রাখো ঈশ্বরের ওপর। তাছাড়া তুমি এখন তোমার মার একমাত্র অবলম্বন। তোমায় শক্ত হতে হবে।’ সাহিল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায়, ‘ আব্বু যা টাকা পাঠাতো আমাদের তাতে কষ্ট করে চলে যেত। একটা গাই আর একটু জমি ছিল, দুবেলা খাবার জুটতো। দু বছর আব্বুর চাকরি নেই। জমি, গাই, আম্মির সোনা বিক্রি করে চিকিৎসা হচ্ছে। বাড়িতে আর টাকাও নেই। আজ আম্মি খালার থেকে টাকা ধার নিয়ে কলকাতা গেছে। এরপর আব্বুর যাই হোক, আমার আর পড়া হবে না। একটা খাতা পেন কেনার টাকাও বাড়িতে নেই। রান্নাও হয়নি বাড়িতে। একটা বিস্কুট খেয়েছি সকালে। আম্মি তাও খায়নি। জানিনা আমাদের কি হবে ?’
অমিত অনুভব করতে পারলো পরিবারটির দুরাবস্থা। সাহিলের আব্বুর জীবন্মৃত্যু কোনোভাবেই পরিবারটিকে উঠে দাঁড় করাতে পারবে না। কিন্তু সাহিলের মত মেধাবী ছাত্রের পড়াশুনা থেমে যাবে, তা কি করে হয় ! ভাবতে ভাবতে অমিত বললো, ‘ সাহিল পড়াশুনা তুমি কোনোভাবেই ছেড়ো না। যেভাবেই হোক চালিও। আমরা শিক্ষকরা আছি, তোমার সমস্যা হবে না।’ সাহিলের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সামনে বিরাট জলধারায় কাছে এই নুনজল হয়ত নগন্য। হাতের চেটো দিয়ে জল মুছে সাহিল বললো, ‘খুব খিদে পেয়েছে। জানিনা কাল থেকে কি খাবো আমরা! আব্বুর কিছু হয়ে গেলে আমরা আর এখানে থাকবো না। মুর্শিদাবাদ চলে যাবো মামুর বাড়ি। মামুর জমিতে লাঙ্গল দিতে হবে।’ ভাগ্যের কি অদ্ভুত বিড়ম্বনা অমিত ভাবছিল। মিনু মেনশনে পাঁচটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, আর সাহিলের মাত্র একটা গাই, এক খন্ড জমি, তাও থাকলো না। এই বৈপরীত্য মেনে নিতে খুব কষ্ট হয় অমিতের।
বিরাট শোরগোল উঠলো মাঠে। নিশ্চয় কোনো পক্ষ গোল করেছে। দুবার বাজি ফাটল। নদীর দিকে তাকিয়ে নীরবে বসে আছে দুটি অসমবয়সী মানুষ। দুজনের সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক অতীত বর্তমান আলাদা। কিন্তু এই মুহূর্তে মানসিক অবস্থান এক। অমিত ভাবলেশহীন মানুষ নয়। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনের কাটাছেঁড়া হয়নি। কিন্তু অভাবী সংসারে সাহিলের পৃথিবী ও স্বপ্ন বারবার ভেঙে চুরমার হয়েছে। জীবনের প্রতি তার উদাসীনতা দেখেই বোঝা যায়। যেন পাওয়ার আনন্দ নেই, আবার হারানোর দুঃখ নেই। অমিত পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সাহিলকে বললো, ‘তুমি কি তোমার মার সাথে কথা বলতে চাও ? আমার মোবাইল থেকে কথা বলতে পারো।’ সাহিল ক্ষীণ গলায় উত্তর দিল, ‘না স্যার, কথা বলবো না। দুর্ঘটনার খবর যত দেরিতে পাওয়া যায় তত ভালো।’ অবাক হয়ে অমিত ভাবে এতবড় দর্শন সাহিলের মধ্যে এলো কিভাবে ? তার রোজনামচাই কি তাকে জীবনবোধ সম্পর্কে শিক্ষিত করে তুলেছে ? সাহিল বলতে থাকে, ‘ আমি স্যার সাইকেল নিয়ে মাঝেমাঝেই এখানে এসে বসে থাকি। যে কথা কেউ শোনে না, সেই সব কথা আমি রূপনারায়নকে বলি। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আমি মাকে নিয়ে ভাবি, আমার পড়াশুনা নিয়ে ভাবি। আর ভাবি মুর্শিদাবাদ চলে গেলে বন্ধু রূপনারায়নকে পাবো না। কাকে তখন মনের কথা বলবো ?’
অমিত ব্যাগ থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বের করে সাহিলের হাতে দিল। একটা বিস্কুট মুখে পুরে সাহিল শক্ত হয়ে বললো, ‘আব্বুর জন্যে আমার দুঃখ হয় না। গুজরাটে আব্বু সাদি করেছে আমরা জানি। ক্যানসার জেনে আব্বুকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে নতুন বিবি। আম্মু সব জেনেও দুয়া করে পীরের দরজায়। মানৎ রেখেছে কত। কাজী বাবার তাবিজ পরিয়েছে। আজ জল পোড়া নিয়ে গেছে। আম্মুর কি রাগ হয়না আব্বুর ওপর?’ বিরাট জোরে হর্নের শব্দ হলো। সামনে দিয়ে একটা বড় লঞ্চ চলে যাচ্ছে। ডেকের ওপরে নীল রঙের সুন্দর একটা পতাকা হাওয়ায় উড়ছে। মুহূর্তের মধ্যে লঞ্চটি চোখের আড়ালে চলে গেল। তিনকোনা ঢেউ কেবল পাড়ে ধাক্কা দিয়ে স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেল। অমিত ওয়ালেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট সাহিলের হাতে দিয়ে বললো, ‘বাড়িতে রান্নার জন্যে কিছু কিনে নিয়ে যেও। তোমাদের সবাইকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। যুদ্ধ তো এখানেই শেষ নয়।’ সাহিল অমিতের দিকে এই প্রথম তাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘ স্যার আপানি মাথা উঁচু করে বাঁচতে বলছেন আবার টাকা দিচ্ছেন ? টাকার ভারে তো মাথা নিচু হয়ে যাবেই। যেমন আব্বুর হয়েছিল গুজরাটে গিয়ে।’
উজ্জ্বল খালের ধার থেকে চিৎকার করে জানালো, ‘ কিগো অমিতদা, ফিরবে না ? ফাইনাল ম্যাচ অসাধারণ হলো। তিন দুই গোলে ডাঙ্গারহাট চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আমরা ফিরবো এবার। চলে এসো দাদা।’ অমিতের ইচ্ছে করছিল না সাহিলকে একা রেখে যেতে। কিন্তু বাড়ি তো সকলকেই ফিরতেই হয়। সাহিল বললো, ‘স্যার, আপনি চলে যান এবার। অনেকদূরে আপনাকে বাড়ি ফিরতে হবে।’ দশ বছরের একটি বাচ্চা, যার বাবার মৃত্যু সংবাদ যেকোনো মুহূর্তে আসতে চলেছে, তাকে একা রেখে যেতে মন চাইছে না অমিতের, কিন্তু অপেক্ষা করার আর সময় নেই। অমিত উঠে পড়ে, কাঁধে নেয় ব্যাগ। জিজ্ঞেস করে , ‘বিকেল হয়ে এসেছে, তুমি কি আরো কিছুক্ষন এখানে থাকবে ?’ সাহিল নদীর দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে উত্তর দেয়, ‘ আমি থাকব স্যার। আমায় থাকতেই হবে আম্মুর জন্যে।’ অমিত উঁচু পাড় ছেড়ে নেমে আসে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে সাহিল আগের মতই রূপনারায়ন দেখছে এক দৃষ্টিতে। চোখের পলক পড়ছে না । শুধু জলে ভেজা গাল পড়ন্ত রোদে চিকচিক করছে ।
0 Comments