আয়না
ময়ূরাক্ষী আর তার দেখা হওয়াটা কে যে হঠাৎ হয়ে গেল বলে কাটানো যাবেনা, সে কথা খুব ভালো করেই জানে জুবিন। মৃত্তিকা অন্তত বিশ্বাস করবে না এই কথাটা, জুবিন জানে মৃত্তিকা এমনিই তাকে খুব বেশী বিশ্বাস করেনা। তাতে যে জুবিনের খুব একটা কিছু যায় আসে তাও না। তবু ময়ূরাক্ষীর ব্যপারটা ভীষণরকম স্পর্শকাতর। ওকে দেখলে বুকের ভেতর মেঘ করে আসে জুবিনের। সেটা দোষের কিছু না যদিও। প্রেম, ভালোলাগা থাকতেই পারে জীবনে। কিন্তু মৃত্তিকা যাকে আদর করে জুবিন মাটি ডাকে, সে যে এতটাও মাটিরমানুষ নয় সেটা ও হাড়ে হাড়ে জানে। কিন্তু ময়ূরাক্ষী, সে যেন অন্য গ্রহের। হৃদয় পাখী লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে তাকে দেখলে।
জুবিন রায় বেসরকারী ব্যাংকের হিসেবরক্ষক, মধ্য ত্রিশ, এবং সুন্দরী প্রেমিকা মৃত্তিকার বেশ একনিষ্ঠ প্রেমিক। এসব ঠিক ততদিন অব্দি পরিপাটি ছিল যতদিন পর্যন্ত ময়ূরাক্ষী ওর জীবনে আসেনি। তবে ময়ূরাক্ষী বলে যে নারীর প্রেমে জুবিন এতটা হাবুডুবু খাচ্ছে তা কিন্তু সবটাই একপক্ষীয় ব্যাপার। ময়ূরাক্ষী নাম্নী নারীটি যে আজ অব্দি জুবিন কে পাত্তাই দেয়নি, জুবিনের অজানা নয় সে কথা। তবু অদৃশ্য এক সুতোয় জড়িয়ে যাচ্ছে জুবিন।
সিমা আর্ট গ্যালারীতে মাটির স্কুলের বান্ধবীর ফটোগ্রাফি প্রদর্শনীতে মাটিই একরকম জোর করে টেনে নিয়ে গেছিল জুবিন কে। মাটি কবিতা লেখে। বেশ কিছু ভালো পত্রিকায় ওর লেখা প্রকাশিতও হয়েছে। ও যে স্কুলে চাকরী করে সেখানেও বেশ কিছু শিল্পমনস্ক মানুষ আছে, তার মধ্যে ময়ূরাক্ষীও একজন। ময়ূরাক্ষীর তোলা ছবি দেখে জুবিন মুগ্ধ। তার চেয়েও বেশী মুগ্ধতা ময়ূরাক্ষীর প্রতি। অসামান্যা সুন্দরী নয় ময়ূরাক্ষী। তবু কিছু একটা আছে যা ময়ূরাক্ষী কে সবার থেকে আলাদা করে দেয়। ফেরার পথে ট্যাক্সিতে বসে জুবিনের কোমরে খোঁচা মেরে চোখ টিপে মাটি বলল, ‘কি ব্যাপার অত হাঁ করে কি দেখছিলে আঁখী কে।’ আমতা আমতা করে কাটিয়ে দিলেও, রাতে স্বপ্নে ময়ূরাক্ষী কে দেখেছিল জুবিন। ভোরের দিকে ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছিল ও। পাঁচ বছরের প্রেমে, একদিনের জন্যেও মৃত্তিকা স্বপ্নে আসেনি জুবিনের। অথচ এক সন্ধ্যেয়, ক্ষনিকের দৃষ্টি বিনিময়, কিছু কথা, আর ঠোঁটের উপর যে মেয়ের তিল আছে, সেই মেয়েকে স্বপ্নে দেখল জুবিন। তবে কি সে প্রেমে পড়েছে। প্রশ্ন এবং উত্তর দুটোরই সদুত্তর না পেয়ে আবার ঘুমোনোর চেষ্টাটাকেই সাফল্য মন্ডিত করার চেষ্টায় লেগে পড়ল।
‘কি ব্যাপার, ফোন ধরছিলে না যে, কোথায় ছিলে? সকালের প্রথম ফোন এভাবেই আসা যাওয়া করে। স্কুলে বেরোনার সময় প্রতিদিন ফোন করে মাটি। জুবিনের ফোন তুলতে দেরী হলেই একেবারে রণচণ্ডী। জুবিন মনে মনে ভাবে, এ মেয়ে কি করে এত গভীর প্রেমের কবিতা লেখে। জুবিন জানে মাটির সুন্দর মুখের সাথে আরও একটি জিনিষ ওর আছে, তা হল সাজানো সুন্দর একটি তীক্ষ্ণ জিহ্বা। মুখ ঠিক ঠাক খুলতে পারলেই, সেখান থেকে অগ্নিবাণ নির্গত হয়। পঞ্চবার্ষিকী উদযাপনের পরেও যে জুবিন বেঁচে আছে তা বোধহয় জুবিনের পিতৃপুরুষের কর্মফল। ছাপোষা মনের জুবিন, সুন্দরী প্রেমিকা পেয়ে যেমন খুশী, মাটিও জুবিনের মত শান্ত, টুপলু মার্কা একটি প্রেমিক পেয়ে ততোধিক খুশী। কিন্তু ওই যে কার যে কি লিখন, কেই বা জানে। নইলে কি আর ময়ূরাক্ষীর প্রবেশ ঘটে।
ময়ূরাক্ষী তেমন সহজলভ্যা নয়। তার একটি ইঞ্জিনিয়ার প্রেমিক আছে। বিদেশে থাকে। রাতে চ্যাট খুলে হাই হ্যালো করে, হাই তুল ঘুমিয়ে পড়াটাই রোজের অভ্যেস প্রেমিক-প্রবরের। তবে নতুন একটি সুখের খবর আছে বৈকি। খবরটি যদিও বান্ধবীর প্রেমিক। তবু নিরামিষ একাকীত্বে একটু উড়ু উড়ু মন যেন গরমে মাঝরাস্তায় এটিএম শান্তি। তবু মানুষ ভাবে এক, আর শান্তিগোপাল হয় আর এক। টুক করে অমন সুচারু নারীটি প্রেমে পড়ে গেল শান্তশিষ্ট বান্ধবীর প্রেমিকের। প্রেমে পাপবোধ তেমন থাকে না। থাকলে বিদেশবাসী প্রেমিক কে হাই সোনা গুডনাইট বলে ‘পালাতে পারলে বাঁচি’মেয়েটি টুপুস করে টেক্সট করে দেয় না শান্ত ছেলে জুবিন কে। ‘ঘুমোচ্ছেন নাকি?’ ওপাশ যেন ফোন হাতে বসেছিল, না না অপেক্ষা করছিলাম। ‘কার?’ ‘আ আ আপনার।”তাহলে তোতলাচ্ছেন কেন?”না, মানে, না কিছু না।”হুম’। ঘুমোননি কেন?”আচ্ছা ঘুমোচ্ছি তবে।”দাঁড়ান।’
জুবিন ভীতু নয় তবে খুব একটা সাহসীও যে নয়, তার প্রমাণ, তার বেড়ে যাওয়া ব্লাড প্রেসার, চোখের তলায় রাত জাগা কাজল, আর অফিসে গিয়ে ঝিমানোর মত রোগে বেচারার কাহিল হয়ে সপ্তাহ খানেকের ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে থাকা। মাটি এবং আঁখি দুজনেই ঘন্টা দু’ঘন্টা পরপর ফোনে পুলিশসুলভ জিজ্ঞাসাবাদ করে যাচ্ছে। প্রেম বড় মধুর গানটা যে কত মিথ্যে ও বুঝতে পারছে হাড়ে হাড়ে। তার উপর মাতৃ দেবীর জলপড়া, ধানপড়া তো আছেই। সে তবু একরকম, সমস্যা শুরু হল যখন ময়ূরাক্ষীর ফোনে হঠাৎ জুবিনের নম্বর আবিষ্কার করে ফেললো মাটি। সব আবিষ্কার যে পুরষ্কৃত হয় না, আর সব আবিষ্কারক যে মহাত্মা হয় না তার বড় প্রমাণ হল অমন সুন্দরী মেয়ের হঠাৎ করে ডাকিনীবিদ্যায় পারদর্শীনি হয়ে ওঠা এবং ফোন করে বলা’তোমাকে আমি ছাড়বো না। মেরে ফেলে দেব শয়তান তোকে।’ গোবেচারা জুবিন মিইয়ে গিয়ে বলল, ‘প্লিজ আর করবো না আমাকে ক্ষমা করে দাও গো।’ আর হবে না।
সেই থেকে জুবিন যথেষ্ট সাবধানী, আঁখীর সাথে লুকিয়ে দেখা করার কথা জানতেই দেয়না মাটি কে। তবে আজ একটা খুনোখুনি না হয়ে যায় না। বিকেলে কফি শপে কফি খেতে খেতে বিষম খাওয়া অবস্থা জুবিনের। সামনের টেবিলে কফির আমেজ নিচ্ছে মাটির মামাতো বোন আর তার প্রেমিক। সকালে মাটিকে বলেছে মাকে নিয়ে পিসির বাড়ি যেতে হবে। আজ দেখা করবে না। মাটি জানলে আজ নির্ঘাত খুন হয়ে যাবে জুবিন।
মৃত্তিকা ইদানীং বেশ শান্ত হয়ে গেছে। জুবিনের সাথে ঝগড়া মিটিয়ে নিয়ে বেশ শান্তমনে সাহিত্যচর্চা করছে। বেশ কিছু জনের মত সাহিত্যসমাজে ও একজন পরিচিত মুখ। কবিসম্মেলনে ডাক পাচ্ছে। দারুন লেখাও আসছে কলমের ডগা বেয়ে। সারাদিন আজকাল খুব একটা কথা হয়না জুবিনের সাথে। রাতে ওই ঘুমিয়ে পড়ার আগে, আর সকালে বেরোবার সময় একটু ফোন করে, তাও মিনিট পাঁচেক মত। জুবিনও ওই টুকটাক ফোন করে মাঝে মাঝে।
ময়ূরাক্ষী মাটির সাথে একেবারেই কথা বলেনা। স্কুলে এই নিয়ে নানা ফিসফাস। সেসব নিয়ে ভাবার সময় নেই ওর। প্রেম আর যুদ্ধে কিছুই অনৈতিক নয়। ময়ূরাক্ষী নিজের ফটোগ্রাফি, জুবিনের সাথে প্রেম আর স্কুল করেই সারাদিন কাটিয়ে দেয়। রাতে ওর সুদূরবর্তী প্রেমিকের সাথেও কিছুক্ষণ কথা হয়। তারপরেই ও ব্যস্ত হয়ে যায় আবার নিজের মত। জানে তখনও জুবিন জেগে আছে ওর জন্য।
‘জুবিন, ও নেক্সট উইক আসছে। ”কে? জয়? ”হুম” ভালো তো।” ধুর। ও এবার বিয়েটা সেরে ফেলতে চায়। ”মাটিরও তাই ইচ্ছে।” কি হবে কে জানে।’ তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো। ”আঁখী, এভাবে বোলো না প্লিজ, কোনদিন ভুলবো না।’ তুমিও ভুলে যেওনা আমাকে। ”আজ ঘুমোই চল।”হুম। চল’
পৃথিবী ঘুমোয় না। প্রতিবিম্বিত হয় নতুন নতুন গল্প, এক সুরে, শুধু পালটে যায় আয়নার মুখ।তেমনি আরেকটা গল্প অল্প-অল্প পালটে যাচ্ছে।
‘হাই। তুমি জেগে ”ওয়েটিং ফর ইউ ওনলি।’ নেক্সট উইক আসছি। ”মি টু ওয়েটিং ডিয়ার।” মাটি তোমাকে আঁখীর সাথে অনেকগুলো ছবিতে দেখেই প্রেমে পড়ে গেছি। খুব ভয়ে ভয়ে কথা বলেছি তোমার সাথে। তুমি খুব সুন্দরী। ”হা হা হা। ধন্যবাদ।কলকাতায় এলে দেখা হচ্ছে তোমার সাথে জয়।’ এখন শুভরাত। ”বেশ, শুভরাত।’
বাথরুমে লাগানো আয়নায় নিজের মুখটাকে অবিকল ময়ূরাক্ষীর মত লাগছিল মাটির। আয়না বদলায় না বদলে যায় মুখ।
0 Comments