আমরা দেখব না স্বপ্ন? (তৃতীয় পর্ব)

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় on

ঘুমের মধ্যেই সাতটা দিন কেটে গেল… একশ আটষট্টি ঘণ্টা! স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের ঘোরে কেটে গেল। চোখের ওপর থেকে এতটুকু বালি সরল না। কমলও না। তাদের শরীরে কোনোরকম অস্বস্তি বা অসুখের লক্ষণও ফুটে উঠল না। কোনো বাহ্যিক কষ্টের চিহ্ন নেই শরীরে। কিন্তু সঙ্কট বা উদ্বেগ কমল না… বাড়ল। শহরের বাইরে, অন্য জেলা থেকেও এমন খবর আসতে শুরু করল। একের পর এক পরিবারে, কেউ না কেউ চোখের পাতায় বালি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে, আর উঠছে না। কী ঘটছে, কী ভাবে ঘটছে… এসব বোঝার আগেই রাজ্যে সংক্রমণের মত ছড়িয়ে পড়ল। এত পাহারা দিয়েও এই ছড়িয়ে পড়া রোধ করা গেল না। রাজ্যের খবর অন্য রাজ্যে গেল, রাজধানীতে গেল… কেন্দ্রের কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। এ এক নতুন উপসর্গ, অদ্ভুত ব্যাধি! কী এই বালি? কেন এভাবে ঘুমোচ্ছে মানুষ? এ কোন শত্রুর চক্রান্ত? এরকম কিছু তো আগে ঘটেনি কখনো? এনসেফ্যালাইটিস বা এরকম অন্য কিছুই না… স্ক্যান করার চেষ্টা করেও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। বালির নমুনা চলে গেল দেশের সব থেকে উচ্চমানের সব গবেষণাকেন্দ্রে… দেখা হবে, কী আছে এই বালিতে, কী এর কম্পোজিশন! 

মানুষ ঘুমোচ্ছে, ঘুম ভাঙছে না। অথচ সব জায়গায় দুটো ব্যাপার স্থির – 

পথে থাকা লোকজনের কিচ্ছু হল না, ভবঘুরেদের কিচ্ছু হল না… আর একা থাকা মানুষগুলোর কিচ্ছু হল না। 

আর হ্যাঁ, মানুষ ছাড়া অন্য কোনো পশু-পাখিরও কিছুই হল না। কাউকে ওভাবে বেহুঁশ পড়ে থাকতে দেখা যায়নি। 

কিছু জায়গায় জোর করে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করতে ঘুমের মধ্যেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মারা গেল মানুষগুলো। ভয় পেতে শুরু করল সকলে। ভয় পেতে শুরু করল প্রশাসন… রাজ্যে, কেন্দ্রে। মৃত্যুর খবর এলে ভয় বাড়ে। লোকজনের রাস্তায় বেরনো বন্ধ হল। যানবাহন চলাচল স্থগিত হল। বিদেশীরা সব পালিয়ে গেল দেশ ছেড়ে। দোকান-পাট বন্ধ করে দিল পুলিস। কীভাবে… কী থেকে এটা ছড়াচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। চায়ের দোকান, ক্লাবঘর, শপিংমল, রেস্তোরাঁ… সব খাঁ খাঁ করছে। রাস্তার ধারে ছোটোখাট দোকান, গুমটি, চা-সিগারেটের দোকানগুলো তাও চলছিল… সেগুলোকেও হুড়কো দিয়ে দিলো পুলিশ। সব বন্ধ। বালিগুলো নাকি খুব হালকা… বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে, কারো চোখে পড়লেই ব্যস! 

     হরিদা জবাব দিয়ে দিল, আর পারছে না। দোকান বন্ধ, খুঁড়ো এবারে নিজেরটা বুঝে নিক। মাসের আড়াইশ টাকা দিয়ে দিল, আর দুটো পুরনো জামা… একেবারে লাথি মারেনি। বলল, এসব ঝামেলা মিটলে একবার খোঁজ নিতে। এখন ফুটপাথে বসে থাকা ছাড়া আপাতত কিছু করার নেই, অথচ সেখানেও বসে থাকতে দিচ্ছে না পুলিশ। ভাগিয়ে দিচ্ছে। যতদিন না লোকের ঘুম ভাঙবে… এইসব চলবে। চায়ের দোকানের মায়া কাটাতে একটু কষ্ট হচ্ছিল, বেঞ্চিটা অনেকদিনের সঙ্গী। খিদের কথা মনে পড়লে পিছুটান আলগা হয়। রাস্তার এক ধার দিয়ে বাজারের দিকে গেল… যদি একটু মুড়ির ব্যবস্থা করা যায়। বাজারে যে সামান্য ক’টা দোকান খোলা, তার মধ্যে একটা থেকে মুড়ি আর ছোলাভাজা কিনে খুঁড়ো একটু ছায়া খুঁজে বসল। খেতে খেতে হঠাৎই মনে হল – মা-বোন যেখানে থাকে… সেখানে কে ঘুমোচ্ছে এখন?

খাওয়ার পর রাস্তার ধারেই শুয়েছিল চোখ বুঁজে। হঠাৎ ঠক ঠক করে কেউ পায়ের কাছে লাঠি ঠুকল। কিছু বোঝার আগেই একজন হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। আর একজন কাঁধে ঠেলা দিয়ে বলল ‘চল ওঠ!’ ঝাপসা ভাবটা একটু কাটতেই খুঁড়ো দেখল, সামনে একটা মাথা ঢাকা লড়ির মত। ভেতরে বেশ কিছু লোক বসে। আর কিছু বোঝার আগে সেখানেই ওকে কোল-পাঁজা করে তুলে দিলো দুজন মিলে। তারপর গোঁ গোঁ শব্দ করে গাড়িটা চলতে শুরু করল। ভেতরে বসে থাকা ছায়া-অন্ধকারে আরো অনেক লোক। কেউ বুড়ো, কেউ জোয়ান, কেউ খুঁড়োর বয়সী। কারো গায়ে মাটি, কারো চুলে জট… কারো হাতে-পায়ে ঘা। সকলের গা থেকে অনেক রকম গন্ধ মিশে স্টেশনের পেচ্ছাপ-খানার থেকেও বাজে গন্ধ তৈরী হয়েছে। বমি আর পেচ্ছাপ মিশে যেমন হয়। যেদিক দিয়ে বাতাস ঢুকছে, নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁকপাক করে সেদিকে সরে গেল খুঁড়ো। বুঝতে পারছিল না – কী হচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে! ওকে কেউ বুঝিয়ে দেয়নি যে এলাকার সব ভবঘুরে আর ভিখিরীদের শহরের বাইরে একটা ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলা হচ্ছে… যাতে তাদের থেকে কোনো রোগ না ছড়ায়।

খুঁড়ো এর আগে অনেক বার ভয় পেয়েছে। একা একা ভয়ের ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে থেকেছে, ভয়ের ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থেকেছে একাই। অভ্যেস হয়ে গেছে ভয় পেতে পেতে ঘুমনো, তারপর জেগে ওঠা। কিন্তু হরিদার দোকানে কাজ করতে করতে ভয়ের অভ্যেসটা কেটে যাচ্ছিল। আজ এই লরিটার ভেতর আবার সেই ভয়গুলো ফিরে এলো। সামলাতে অসুবিধে হচ্ছিল। হাত-পায়ের তলা ঘামছিল। বুকের মধ্যে কেমন আনচান করছিল। মনে হচ্ছিল বমি করে ফেলবে। মনে হচ্ছিল এক-লরি মুরগীর মত ওদের নিয়ে যাচ্ছে… কেটে পালক ছাড়াবে সবার। তাও অস্বস্তিটা সহ্য করার চেষ্টা করল। মনে হল অজ্ঞান হয়ে গেলে পুরো ব্যাপারটাই হাতের বাইরে চলে যাবে। কোনোভাবে নিজের মুখটা সেই বাতাস আসা ফাঁকটার দিকে ঠেলে রেখে লড়ির গোঁ গোঁ শব্দটা সহ্য করে গেল।

     মানুষের ইন্দ্রিয়ের ধাতস্থ হওয়ার একটা ক্ষমতা থাকে। নাহলে বাথরুমে বসে নিজের বিষ্ঠার গন্ধেই অতিষ্ট হয়ে যেত। মানুষ দিনের পর দিন ডাস্টবিনের নোংরা ঘাঁটে, আবর্জনার পাশে খায়–ঘুমোয়, জমাদারের কাজ করে, ভাগাড়ের মধ্যে যাওয়া-আসা করে। খুঁড়োরও আসতে আসতে সয়ে গেল। কেউ গায়ে পড়ছিল না। কোনোভাবে খোঁচাচ্ছিল না অল্পবয়সী ছেলে দেখে। সবাই লরির দুলুনির সাথে দুলছিল। খুঁড়ো আড়-চোখে দেখল অনেকে ঝিমোচ্ছে, কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়েছে। লালা গড়িয়ে পড়ছে তাদের ঠোঁটের কষ বেয়ে। এরকম গোঁ গোঁ শব্দের সঙ্গে দুলুনি আর হালকা ঝাকুনি কতক্ষণ চলছিল হিসেব নেই। ভেতরটা ভ্যাপসা গরম, জিভ শুকিয়ে আসছিল। যেখান দিয়ে বাতাস আসছে, সেখানে চোখ রেখে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করতে মনে হল হাইওয়ে… শহরের থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। অন্য বিপদের ভয়ে চেঁচামেচিও করতে পারল না। এরাই যদি চলন্ত লরি থেকে ফেলে দেয়? অথচ জিভ শুকিয়ে কাঠ, তেষ্টা বেড়েই চলেছে। এসব চিন্তার মাঝে হঠাৎ লরিটা একটা বাম্পারে লাফিয়ে উঠল… খুঁড়োর মাথাটা ঠুকে গেল কাছাকাছি কাঠের পাটাতনে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লরিটা চলতে চলতে এঁকে-বেঁকে গেল, মনে হল বেসামাল হয়ে গেছে। তারপর একদম হুড়মুড় করে রাস্তার ঢাল বেয়ে নীচের দিকে! খুঁড়ো বুঝতে পারল অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কিন্তু কী করবে ভেবে পেলো না। কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার, লরির ভেতর অন্যরা হো হো করে উঠল। যারা ঘুমোচ্ছিল, তারা এর-তার গায়ে পড়ে গেল। আর এদের মাঝেই হঠাৎ খুঁড়ো দেখতে পেলো – সেই বুড়োটাকে! এতক্ষণ যেন এদের মাঝেই ঘাপটি মেরে বসেছিল। গাড়ি বেসামাল হতেই টলে উঠে একধারে সরে গেল। সেই ঘোলাটে চোখ, মুখ ভর্তি বসন্তের দাগ, সাদা দাড়ি, মাথায় টাক… বিড়বিড় করছে না, সোজা খুঁড়োর দিকেই তাকিয়ে ইশারা করেছে – শেকলটা শক্ত করে ধরো! খুঁড়ো পাটাতনের গায়ে শেকলটা ধরেছিল… কিন্তু ততক্ষণে লরিটা রাস্তার ঢাল বেয়ে গড়িয়ে গেছে। একটা সশব্দ প্রবল ঝাঁকুনি… খুঁড়োর মাথাটা ঠুকে গেল শক্ত কিছুতে… তারপর সব অন্ধকার। 


ঝকঝকে নীল আকাশ, পেঁজা-তুলো মেঘ। চোখ খুলে এটাই প্রথম দেখল খুঁড়ো। এই প্রথম অনুভূতি। তারপর কানে এলো বাতাস আর সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ। কানে এলো শঙ্খচিলের ডাক। খুঁড়ো শঙ্খচিল চেনে না, ওর কাছে শুধুই পাখির ডাক। তারপর পিঠটা ভেজা লাগল… পায়ের পাতা বার বার জলে ভিজে যাচ্ছে। খুঁড়ো উঠে বসে দেখল… পায়ের থেকে সামান্য দূরে ঢেউ আছড়ে পড়ছে… সমুদ্র! সিনেমা আর ছবির বাইরে এই প্রথম সমুদ্র দেখলে খুঁড়ো! একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়তে দেখেই সেই দিকে ছুটে গেল। কিছুক্ষণ আত্মহারার মত তোলপাড় করল জলে… ঝাঁপালো, গড়াগড়ি খেল। তারপর নোনাজল-আর বালির দানা মেখে আবার ফিরে এলো। মনে করার চেষ্টা করল – কী করে এলো এখানে, কোথায় ছিল? কিন্তু কিছুই মনে করতে পারল না। একদিকে সমুদ্র আর একদিকে ঝাউবন। মাঝে সৈকত। ভিজে জামাটা গা থেকে খুলে একটানে ভেজা বালির ওপর ছুঁড়ে দিলো খুঁড়ো। একটা কাঁকড়া দ্রুতো ঢুকে গেল গর্তের ভেতর। আর তখনই খুঁড়ো আবিষ্কার করলে – সে একা নয়! সেই বুড়োটাও আছে! 


ক্রমশ…


পূর্ববর্তী পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

বর্তমানে হায়দ্রাবাদ নিবাসী  হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের শৈশব থেকে যৌবন সবটাই কলকাতার শহরতলী জুড়ে। জন্ম ২০শে আগস্ট, ১৯৮৬। বায়োটেকনলজিতে বি টেক শেষ করেই কর্মসূত্রে ২০০৮ সালে কলকাতা ছেড়ে বেঙ্গালুরু চলে যান, এবং তারপর হায়দ্রাবাদ। প্রায় দশ বছর হয়ে গেল, কলকাতার বাইরেই জীবন। বাংলা সাহিত্যের প্রতি নিবিড় ভালবাসা থেকেই একসময় লেখার ইচ্ছে জন্মায়। প্রায় সাত-আট বছর উনি একাধিক আন্তর্জাল পত্রিকা এবং মুদ্রিত পত্রিকায় লিখে চলেছেন গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য এবং কবিতা। ২০১৩ সালে 'আদরের নৌকা' প্রকাশনা থেকে প্রকাশ পায় ওনার প্রথম গল্প সংকলন 'প্রতিবিম্ব'। এর পর ২০১৫ সালে  'হাওয়াকল' প্রকশনা থেকে প্রকাশ পায় ওনার প্রথম উপন্যাস 'কৃষ্ণঘন যাম'। ২০১৭ সালে 'হাওয়াকল' প্রকশনা  থেকেই প্রকাশিত হয় প্রথম অণুগল্প সংকলন 'টিনিটাস'। ২০১৮ সালের কলকাতা বইমেলায় 'তবুও প্রয়াস' প্রকাশনা থেকে জয়দীপের প্রথম গদ্য সংকলন 'হৃদয়পুর কত দূর?' প্রকাশ পায়। এই লেখার মধ্যেই তিনি আনন্দ খুঁজে পান। আর প্রতিযোগিতামূলক এই জীবনে এই লেখাই তাঁর কাছে একটা রিফিউজ। লেখার প্রতি ভালবাসার টানেই উনি লিখতে চান... যতদিন পারেন।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।