১৩-র বরদান
ঘটনা টা বেশ ভয়ের এবং মজার…………
আমাকে বলেছিলেন আমার দাদু……………
আমার দাদু ডালহৌসির এক হোটেলে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। সেখানকার লোকেদের তিনি আদর ও যত্ন সহকারে সেবা করতেন ও কোন বাচ্চা থাকলে তার সম্বন্ধে সব জেনে রাখতেন, পাছে কিছু গণ্ডগোল না হয়ে যায় বা করে দেয়।
বিভক্ত ভারত। যুদ্ধ চলছে না, সবার রন্ধ্রে রন্ধ্রে শান্তি। নেতাজির নিখোঁজ হওয়ার ৭২তম বৎসর ছ মাস আগে পালন হল ঘাটালপুরে – বিভক্ত বাংলার সবচেয়ে ভুতুরে নগর, যেন ভুতেরা এখানে কুম্ভের মেলা দেখতে আসে এবং এই কারনেই বিভিন্ন কুসংস্কার ভিড় করে থাকে এখানে, যেটার লাভ উঠিয়েছে বহু ভণ্ড সাধুরা এবং অন্য সকল ভণ্ড মানুষগণ…..বহুবার….। ঠিক এমনই এক সময়ের কথা।
রথিন্দ্রনাথ, অরফে রথিন ছিল ঘাটালপুরের কুখ্যাত এক ছেলে। যত সব দুষ্টুবুদ্ধি খেলত ওর মাথায় কিন্তু সে ছিল পড়াশোনায় বেশ ভালো। কখনই ৯৫% নীচে সে পায়নি কিন্তু এরকম অসিম বিদ্যাধর হওয়ার পরও ওর কেবল একটাই ভয় ছিল। ভয়টা বেশ আজব। ভয়টা হল ১৩র ভয় যেটাকে ইংলিশে বলে ট্রিস্কাইডেকাফবিয়া [Triskaidekaphobia] ।
ভয়টা হওয়ার কারনটাও ছিল বেশ আজব। রীতিমত ভুতুরে ও খুব বাজে ভাবে কাকতালীয়। রথিনের জন্ম ১৩ই জানুয়ারি ২০০৬, মানে ১৩ তারিকের শুক্রবার – ভুতেদের নববর্ষ যেন সেই দিনেই পালিত হয়। তাই ওর জন্মদিন বাংলা তারিখে পালন করার কথা বলা হয় কিন্তু তাতে কি কিছু আসে যায়? সব সরকারি কাগজেও ওকে ডি.ও.বি ১৩ই জানুয়ারি ২০০৬ লিখতেই হবে। তাই সেই প্ল্যানও ক্যান্সেল হল।
আরও কাকতালীয় এই যে ও এতো ভালো রেসাল্ট করেও ক্লাস ৬ সেক্সন – সি এর প্রথম ছেলে শুধু রেজাল্টে। ওর আসল রোল নম্বর ১৩। আবার ইংলিশ-এ ওর নাম লিখলেই ওর নামে আসে ১৩টা অক্ষর [ Rathindranath ]। বেচারা এই নিয়ে খুবই চিন্তিত।
ভুতুরে কাণ্ডটা হয় ডালহৌসিতে – সেখানকার পাথরে পাথরে যেন লর্ড ডালহৌসির ভুত বাস করে। সেই ভুতের বাসই যেন তার বাঁশে পরিণত হয়। দিন টা ছিল তার জন্মদিন ১৩ই জানুয়ারি ২০১৭। শুক্রবার। আমার দাদু কাজের সুত্রে ডালহৌসির সেই হোটেলের ম্যানেজার। তার কাছেই আমি এ সব শুনেছিলাম। সেদিন রথিনরা সপরিবারে সেই রাতে ডালহৌসি ঘুরে ঘরে ফিরলেন।ওদের দেখেই মনে হচ্ছিল ওরা প্রচুর আনন্দ করেছে । বেশ কদিন ধরেই ওরা পাহাড়ে ঘুরছে । প্রথমে সিমলা তারপর মানালি তারপর এবার ডালহৌসি । পাহাড়ি ভ্রমণে ওরা কিছুটা ক্লান্ত হলেও ওর বাবা-মা কিন্তু বেশ সুস্থ সবল । অথচ রথিন ছেলেটা ভয়ে যেন কাঁপছিল। মুখ সাদা, হাত ঠাণ্ডা ও দাঁতে কাঁপুনি । একেই ১৩তারিখ তারপর আবার লর্ড ডালহৌসির ভুত তারপর আবার সেই রাতে সকলে মিলে দেখছিল “কাঞ্চনা”- মারাত্মক এক অর্ধনারিস্বরের কাহিনী [আশা করি পাঠকরা বুঝেগেছেন] যাকে তার পরিবারের সাথে মেরে ফেলা হয় ও সে তার প্রতিশোধ নিতে ফিরে আসে। ফ্লিমের সেই ২ঘন্টা ৫০মিনিট যেন রথিনের আত্মা বের করে নিচ্ছে। দাদু ওদের খোঁজ খবর নেবার জন্য ওদের ঘরে যায় । ওখানে গিয়ে রথিনের অবস্থায় ব্যাপারটা এতো মজে যায় যে দাদু ওর মজা দেখতে শুরু করেন। তার জায়গায় রেখে যান তারই এক কর্মচারীকে। ২ জনে ফিল্ম দেখছেন (রথিনের বাবা-মা), ১ জন ভয়ে রীতিমত কাঁপছে (রথিন ) ও আরেকজন মজা দেখছে (আমার দাদু)। ফিল্ম শেষ করার পর দাদু বিদায় নিলেন। রথিনের পরিবার প্রায় ১২টার দিকে ঘুমাতে গেল কিন্তু রথিনের কোনভাবেই ঘুম আসে না। সে একটু ফোনে খেলতে নেয়। তার বাবা-মার সঙ্গে শুয়ে শুয়ে সে একটু আড্ডা মারে। ফোন খুলেই সে দেখে যে ঘরিতে বাজে রাত ১:১৩। সে তখনই সেটা পালটে করে দেয় ১:১৫। সে দেখে যে তার বালিশের ওপর ১৩টা ফুল আঁকানো, তা দেখে সে সাথে সাথে বালিশ উল্টে নেয়। তার চোখের থেকে যেন ঘুমই উড়ে যায়। এমনিতে ও নিজের রোল, বার্থডে ও নাম নিয়ে ডিপ্রেস্ড, তারপর আবার এই সব বাজে সঙ্কেত। ঠিক যেন – “যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়”। তাও কোনভাবে সে ঘুমাতে যায় কিন্তু ঘুমেও কি শান্তি পাওয়া যায়, স্বপ্ন সব মাটি করে দেয়। রথিন স্বপ্ন দেখছে – সে বাড়ীতে ১৩:১৩ র সময়ে একা। দিন ১৩/১/১৭, শুক্রবার। পিশাচেরা তার পাশে তাণ্ডব নৃত্য করছে। কারোর মাথা নেই তো কেও উড়ে বেরাচ্ছে। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায়। রথিনের মনে হচ্ছিল যেন চাণক্য নন্দের শবের ওপর তাণ্ডব করছে আর তা স্বচক্ষে যেন দেখেছে রথিন । সেই কিংকর্তব্যাবিমূড় বাচাল তার বাচালত্ব ঘুঁচিয়ে নিজের “চলচলাচলশীল দূরভাষ যন্ত্র” অর্থাৎ ফোন নিয়ে “ক্ল্যাশ অফ্ ক্ল্যান্স” খুলল কিন্তু তাও কি কোন ছার আছে, তার টাউনহল ১৩, আছে ১৩০০০ এলিক্সার ও ১৩০১৩ গোল্ড [এগুলো গেম-এর কিছু অংশ]। রথিন এরকম হতভাগ্য মনুষ্যত্ব নিয়ে জন্মেছে জেনে এখন তার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে কিন্তু তখন মনে পরে যায় যে তাকে এখনও পরবর্তী ক্লাসে পরীক্ষা দিতেই হবে নাহলে ওপরে সরস্বতী দিদি আবার রাগ করবে। সে একবার নিচে নামতে চায় কিন্তু ভয়ে নামে না, পাছে খাটের নিচ থেকে কেও তাকে টেনে নেয়। সে যেন তখন নরক-নিবাশি। সারাক্ষণ ভয় ও ভয়। মনে হচ্ছে এখনি যেন কেও এই গাঢ় অন্ধকার থেকে তার ভয়ঙ্কর রক্তমাখা মুখ এনে রথিন কে ভয় দেখিয়ে কোথাও নিয়ে চলে যাবে। যেন ঘাটালপুরের সমস্ত ভুত [যাদের নামে রথিন খুব দূরনাম করেছে (এক সময়ে)]। তারা সেই ছোট্ট ঘরে ভুতসভা করছে। যেন সকল ভুত আজ মহাভজ করবে সেই দুরন্ত ছেলের কচি মাংসের ঝোল দিয়ে। এমন সময়ে যেন “চাঁদের পাহার”-এর শঙ্করের মত তার মাথাও বিপদের সময় খুব তাড়াতাড়ি কাজ করতে লাগে। সে আপন মনে মনে করতে থাকে
– আচ্ছা, এই সময়ে মা কি করত ?
অনেক্ষণ চিন্তা – ভাবনা করার পরে তার মাথায় আসে
– হ্যাঁ, ঠাকুরের নাম করি। কিন্তু কার ? হানুমান ? না ওই বাঁদরের বন্দনা করব না আবার আমি হনুমান চালিশাটাও পুরোটা জানি না এবং হতেই পারে যে আমার ওপর বাঁদরেরা আক্রমন করে। তাহলে, এক কাজ করি, শিবেরই নাম করি। ছেলেটাকেই একটু বলি, “ভাই একটু বাঁচায়ে দাও”।
এই বলে সে শুরু করে দেয়- “ওঁ নমঃ শিবায়”। বলতে বলতে সে ধ্যানে লীন হয়ে যায়। তার আজানুলম্বিত জামাটি হাতে ধরে সে বলেই চলেছে, “ওঁ নমঃ শিবায়”। এরকম করতে করতেই কাণ্ডটা ঘটে গেল।
একটু চোখ খুলে সে দেখে যে ছেলেটি চলে এসেছে। ছেলেটি আর কেউ নয়- স্বয়ং মহাদেব। শিব। তখন রথিন বলে
– একি আপনি কে ?
– চিনলি না। আমি হলাম শিব
– ও। শিব আজকাল ত্রিশূল ছেড়ে ফোন নিয়েছেন ! বোকা বানানোর যায়গা পাচ্ছেন না ! এখনি চিল্লাব কিন্তু।
– না না ! আরে আসলে মডারনাইসেসন্। অপরে আধুনিক না হলে কেও পাত্তা দেয় না।
– কি প্রুফ যে আপনিই শিব।
– তোর সামনে কি আমি নাচবো রে ? আচ্ছা, কেন ডাকলি বল?
– প্রুফ দিন।
– আচ্ছা। দেখ।
এই বলে চক্ষেরনিমেষে মহাদেব নিজের আসল চেহারায় চলে এলেন এবং কিচ্ছুক্ষণ পর আবার আগের রূপে ফিরে গেলেন
মহাদেব বললেন, “দেখলি”
– হ্যাঁ গো। আচ্ছা, এতো একেবারে শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা “লাভের বেলায় ঘণ্টা” ! আমি চাইলামই না আর এতো কিছু !
– অগুলো ছার। বল কি লাগবে? আমি যখন এসেছি তখন বর না দিয়ে যাব না।
– কিন্তু আমি ছেলে। ভবিষ্যৎে বৌ লাগবে ! বর লাগবে না।
– আরে বর মানে উইশ।
– আচ্ছা। ঠিক আছে। কিন্তু আগে বলুন আপনি কি করছেন। ফেসবুক ?
– না ! গডবুক।
– ওটা কি ?
– তোদের যেমন ফেসবুক তেমনি আমাদের গডবুক। দেখবি ?
– কই দেখি।
মহাদেব রথিন কে দেখালেন। ইন্দ্রর হাতি, ঐরাবতের জ্বর হয়েছে। সরস্বতী নতুন গিটার কিনেছে। কৃষ্ণ নিজের নাচের ভিডিও ছেড়েছে। রবিন্দ্রনাথ উপরেও গান লিখছেন। ইত্যাদি। এবার তিনি বললেন, কি নিবি বল।
– কি নেব। অপশন্স প্লিস।
– আই ফোন এক্স ?
– না না। হান্ডেলিং কঠিন।
– প্রেডেটার ? ২ লাখের জিনিশ ফ্রী তে ?
– না। আমি ওত গেম খেলিনা।
– তাহলে আর কি ? গতকালই একটা ছেলে এই দুটো নিল।
– আমি নেব না।
– তাহলে কারোর অটোগ্রাফ নিবি ? মাইকেল ? রবি ? কিশোর ? অ………
– না না। কি করব ওগুলো দিয়ে ?
– শো অফ।
– না। থাক।
– বডিবিল্ডার বানিয়ে দেব ?
– না মেন্টেন করতে পারব না।
– এতো ভালো ঝামেলা।
– হবেই তো। রথিনের হাতে পরেছ। এমনি ছারি।
– বল না বাবা। কি নিবি। তোর কার্তিক দাদার অ্যাডমিসন করাতে যেতে হবে।
– আরে দাঁড়াও। আচ্ছা এতো বাজে ও ফালতু অপশন্ দিলে কি হয়। তোমার এই সময়ে কি ভালো লাগতো ?
এখন মহাদেব গেলেন ফেঁসে। তার হাতে রাখা ফোনটাও গেল পরে। বড় ফ্যাঁসাদে পরলেন স্বয়ং মহাদেব। তার ছোটবেলার কথা তার তো কিছুই মনে নেই। তিনি এবার কি করবেন ? কবে যে তিনি ছোট ছিলেন, আদৌ ছিলেন কি না- তার তো কিছুই মনে নেই !
কি চাইতে পারে রথিন। সময় গড়াচ্ছে আর রথিন মজা নিচ্ছে।
– আচ্ছা ঠাকুর, আমি একটু ডাক দিলাম, আর তুমি চলে এলে ? ব্যাপারটা কেমন যেন একটু খটকা দিচ্ছে।
– আরে আসতে চাইনি। বৌ পাঠিয়ে দিল। অন-দা-ওয়ে মনে হল তোর কাজ গুলো করে দিই কিন্তু আমি তো আর ভাবিনি যে আমি এমন ফ্যাঁসাদে পরব।
– সে ঠিক। আচ্ছা ভাবনা কন্টিনিউ করো।
শিব ঠাকুর ভাবছেন। যেন তিনি “কৌন বনেগা করোরপতি” খেলছেন। তিনি আবার বললেন
– ফোনটা নিবি ?
– না থাক।
– আমার জামা কাপড় টা নিবি।
– দিলে দিতেই পারো কিন্তু নিজের সন্মান রক্ষা করতে পারবে তো ?
– কেন ?……অ…তাইত। তাহলে ?
– আরো অপশন্ দাও।
– খাবি কিছু ?
– কি ?
– আমেরিকান পিজা।
– না।
– বার্গার ?
– না।
– পাঞ্জাবি লস্যি ?
– না।
– দোসা ?
– না।
– কচুরি ?
– না।
– জয়নগরের মোয়া ?
– না।
– মালদার খাজা ?
– না।
– রানাঘাটের ছানার জিলিপি ? জনাইয়ের মনোহরা ? কেষ্টনগরের সরভাজা ? বর্ধমানের মিহিদানা ? পাঁশকুড়ার আমৃতি ? বাগবাজারের রসগোল্লা ? ভীমনগরের সন্দেশ ? নাটোরের দেদোমন্ডা ?
– গন্ডা গন্ডা ? ওটা কি ? আচ্ছা থাক। আর ?
– তারকেশ্বরের ডাব ?
– না। ডাব খেয়ে কি পেট ভরে !
– তাহলে কি এবার মঙ্গল গ্রহ থেকে তোর জন্য খাওয়ার নিয়ে আসব ?
– না থাক।
– এটাও না ?
– আর কিছু আছে ? খিদা পেয়ে গেল তো।
– আর কি ভাই ? আমি আর পারবনা । আমাকে ক্ষমা করো। বল কি লাগবে। আমাকে রেহাই দে হে রথিন !
– আচ্ছা। আমাকে বর দাও যে আমি যেন সব পরিক্ষায় ফুল মার্ক্স পাই আর যেন আমার সাথে কখন আর ১৩র সাক্ষাৎ না হয়। আমার কাছে থাকা সব ১৩ যেন ১৪ হয়ে যায় আর যেন আমি সব জায়গায় ১৪ দেখতে পাই।
– “বাঁচালে !”
এই বলে নিশ্বাস ছেড়ে ভগবান তাকে আশীর্বাদ করলেন। এই করে রথিন নিজের চিন্তার থেকে মুক্তি পায়।
সমাপ্ত
0 Comments