হায় বসন্ত !

বর্ণালি বসাক বোস on

সুগত,

     আশা করি ভালো আছো। অবাক হচ্ছো ? ভাবছ এতদিন পরে হঠাৎ কি মনে করে তোমায় চিঠি লিখছি ? আচ্ছা আমি কি তোমার মনের কোন এক কোনে কোথাও কি নেই ? অবশ্য না থাকারই কথা। সুগত সত্যি কথা বলতে আমি নিজেও কিন্তু জানিনা কেন আজ আমি এত অস্থির, কেন আজ তোমার কথা আমার এত মনে পড়ছে। জান যে টেবিলটায় বসে আমি এখন তোমায় চিঠি লিখছি ঠিক তার সামনে একটা পলাশফুলের গাছ। জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি কি অপূর্ব লাল হয়ে আছে গাছটি,যেন প্রকৃতি তার গোটা বসন্তের  রঙ ঐ গাছটাতে ঢেলে দিয়েছে আর হাওয়ার সাথে সাথে সেই রঙ এসে লাগছে আমার গালে, ঠোঁটে। কি অদ্ভুত সেই স্পর্শ, খুব চেনা!

                 জান জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি নানা বয়েসের ছেলেমেয়েরা রঙ খেলছে, খুব মজা করছে ওরা। আমি শুধু একা ! আমি ওদের কাছে খুব রাগী এবং খুব অহংকারি একজন মহিলা। তাই আমার বাড়িতে কেউ আমাকে রঙ দিতে আসে না। বলতে পারো এই ইমেজটা আমার নিজেরই তৈরি করা। এর জন্যই তো আমি সকলের থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পারি। কেউ অযথা আমার প্রতি কৌতূহল দেখায় না।

                                  জান বড্ড মনে পড়ছে সেবারের হোলির কথা যেবার বসন্ত উৎসবে তুমি আমায় শান্তিনিকেতনে নিয়ে গেছিলে। দেখতে দেখতে পঁচিশটা বছর পেরিয়ে গেল। মনে হছে এই তো সেদিনের কথা সকালবেলায় হলুদ জামদানীটা পরে যখন আমি তোমার সামনে দাঁড়ালাম তুমি বলেছিলে বসন্তে আমি নাকি বাসন্তি। এক মুঠো লাল আবির এনে আমার গালে লাগিয়ে দিয়ে বলেছিলে এই গাল দুটোতে সবার আগে আবির লাগানোর আধিকার কেবল নাকি তোমার। কত মজা করেছিলাম তাই না সেবার ? আজ এই লাল পলাশফুলগুলো দেখে স্মৃতি গুলো কেমন তাজা হয়ে উঠছে। জান সুগত কোথাও হয়তো বসন্ত উৎসব হচ্ছে দূর থেকে রবীঠাকুরের গান ভেসে আসছে। “রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও,যাও গো এবার যাবার আগে ”। গোটা শরীর মন জুড়ে বসন্ত আজ আমায় বড় উতলা করে তুলছে। তোমার কাছ থেকে চলে আসার পর এমন ভাবে বসন্ত আমায় কক্ষনো নাড়া দেয় নি। কক্ষনো অন্যদের রঙ খেলা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নি। এসব এত দিন আমার অসহ্য লাগত। হয়ত নিজে উপভোগ করতে পারতাম না বলেই।

      সুগত চিঠিটা কি তুমি পড়ছ ? আচ্ছা আজও কি তুমি একা ? নাকি জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছ কাউকে ? জান এখন মনে হয় সবার জীবনেই একজন সঙ্গীর বড় দরকার। শুধু চাকরিটা করব বলে তোমায় ছেড়ে সেদিন আমি চলে এলাম। তোমার কোন আপত্তি শুনলাম না। মনে হয়েছিল নিজের যোগ্যতায় চাকরিটা পেয়েছি। কোন ভাবেই সেটিকে আমি হারাতে চাইনি।আমি একজন শিক্ষিত মেয়ে সামান্য সামান্য কারনে টাকার জন্য তোমার কাছেহাত পাততে আমার আত্মসন্মানে লাগত। জান আজও আমি বুঝতে পারলাম না কিসের আপত্তি ছিল তোমার। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা পাবার পর যখন তুমি দেখলে আমার পুরুলিয়ার একটি গ্রামের স্কুলে চাকরি হল তুমি একবাক্যে আমায় বলে দিলে চাকরিটা আমার করা হবে না। যে কোন একটা জিনিস তুমি আমায় বেছে নিতে বললে হয় চাকরি না হয় তোমাকে। আমি আবাক হয়ে চেয়ে রইলাম তোমার দিকে। যে সুগত কে আমি চিনতাম কয়েক মুহূর্তে কেমন অচেনা হয়ে উঠল আমার কাছে। আজও চোখ বুজলেই  তোমার চোখে মুখে ফুটে ওঠা সেদিনের পুরুষত্বটা ভেসে ওঠে।আমি চাকরি আর সংসার একসাথে সামলাতে পারব কিনা সেটা বোঝার কোন সুযোগই আমায় তুমি দাও নি।তোমার বদ্ধমূল ধারনা চাকরি আর সংসার নাকি একসাথে হয় না। অতএব তুমি বাধ্য করলে আমায় একটা জিনিস বেছে নিতে। আমার খুব অভিমান হল তোমার উপর আমি চাকরিটা বেছে নিলাম। এক মুহূর্তের মধ্যে আমার নিজের হাতের গড়া সাংসারটা থেকে আমি আলাদা হয়ে গেলাম।আমি চাকরিটা বেছে নিলাম চলে এলাম তোমায় ছেড়ে পুরুলিয়ার অজ পাড়াগাঁয়ের এই স্কুলে। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত জান কারন ততদিনে তুমি যে আমার অভ্যেসে পরিনত হয়ে গেছ। একসাথে খাওয়া,টি ভি দেখা,গল্প করা,ঘুরতে যাওয়া সবকিছু তে যে আমরা দুজনে ওতপ্রত ভাবে জড়িয়ে ছিলাম। সেই আমি একদম একা হয়ে গেলাম। তোমার খয়ার সময় হলে শুধু মনে হত কে তোমাকে খেতে দেবে তুমি তো একা নিয়ে খেতে পার না। কে তোমার জিনিস পত্র গুছিয়ে হাতের কাছে দেবে। অফিসে বের হবার সময় তুমি তো কিছুই খুজে পাবে না। সব কিছু ভেবে ভেবে আমি খুব কষ্ট পেতাম জান। তারপরে মন কে বোঝালাম কার জন্য কিচ্ছু থেমে থাকে না।তুমি ঠিক একা চলতে শিখে যাবে।ঠিক দেখ তুমি তো পারলে, একদিনের জন্যও আমাকে মনে করনি। জীবনের পঁচিশটা বছর কাটিয়ে দিলে আমাকে ছাড়া। যখন আমি প্রথম এখানে আসি মানুষের অহেতুক কৌতূহলে আমি ভিষন বিব্রত বোধ করতাম।নিজেকে চারদেওয়ালে বন্দি করে ফেললাম। যে আমি অনবরত কথা বলতে ভালবাসতাম সেই আমি কার সঙ্গে কথা না বলে চুপচাপ থাকতাম সকলে আমাকে খুব অহংকারি মনে করত।কিছুদিনের মধ্যে সকলে আমাকে অপছন্দ করতে লাগল। আমি আরো একা হয়ে পরলাম।

                জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একটা জিনিস আমি খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি জান সেটা আমাদের জীবনটাও ঋতুরঙ্গের মত বৈচিত্রময়। প্রত্যেকের জীবনে যখন গ্রীষ্ম আসে তখন তার রক্ত থাকে গরম অনেক অসাধ্য সে সাধন করতে পারে সে। কোন পরিস্থিতিই তাকে দমাতে পারে না। যখন বর্ষা আসে মন তখন নতুন করে সেজে উঠে সবুজ সতেজ হয়ে ওঠে। শরতে চারিদিকে যেন উৎসবের আনন্দ। একটি জীবন আর একটি জীবনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। হেমন্তে কার জীবন চলে ধিরস্থির কারো বা প্রচণ্ড ব্যাস্ততায় আবার কারোবা আমার মত একাকীত্বে। শীতে এসে সব ঠাণ্ডা, রক্তের তেজ কমে আসে। সব কিছুকে অন্য ভাবে দেখার মানসিকতা তৈরি হয়। সবার শেষে বসন্ত। ঝড়াপাতার মত ঝড়ে পড়ে যাবে জীবন পড়ে থাকবে শুধুই স্মৃতি। হাজার চেষ্টাতেও গ্রীষ্ম আর ফিরে আসবে না।  আমার জীবনের বাঁকি পাঁচটি ঋতু তো কেটে গেল কোন রকমে কিন্তু বসন্তে এসে মন যে পিছে ফিরে তাকাতে চায়। ফেলে আসা দিন গুলকে আঁকড়ে ধরতে চায়। যখন ফিরে যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ তখনও হোলির দিন তোমার হাতের আবিরের স্পর্শ অনুভব করে আমার গালদুটো। বাইরে যারা আমায় রাগী,আনসোশ্যাল মনে করে তারা জানে না আমারও একটা মন আছে যেখানে রঙ আছে, গান আছে, কবিতা আছে আর আছে শুধুই স্মৃতি। জীবনের শেষ দিন গুলো যেন এসব নিয়েই বাঁচতে পারি এই আশীর্বাদ কর। তুমি ভালো থেকো। খুব ভালো থেকো।

মধুমিতা

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


বর্ণালি বসাক বোস

বর্ণালি বসাক বোস একজন পুরপুরি গৃহবধূ । রাষ্ট্র বিজ্ঞানে মাষ্টার ডিগ্রি করেছেন বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে । ছাত্রজীবন থেকেই লিখতে ভালোবাসেন । স্বামীর উতসাহে, ছেলের উদ্দীপনায় ও ভাগ্নির আব্দারে আবার লেখার জীবনে ফিরে আশা । সংসারের কাজের ফাঁকে গান আর লেখা তার সঙ্গী । সমাজের চারিপাশের বিভিন্ন রকম চরিত্র যেটা তার মনকে নাড়া দেয়, তাই নিয়েই তিনি লিখতে ভালোবাসেন । এসবের পাশাপাশি সংসারের সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন । এতদিন স্বামীই ছিলেন তার লেখার একমাত্র পাঠক তারই অনুপ্রেরণায় আজ এই লেখা সকলের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য প্রকাশিত । বাবা, মা এবং শাশুড়ি মায়ের আশীর্বাদকে ও ছোট বোনের ভালোবাসাকে জীবনের পাথেয় করে চলতে চান ।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।