সকালের চা

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় on

” এক কাপ চা দেবে বৌমা ?” সকাল থেকে প্রায় বার পাঁচেক কথাটা উচ্চারণ করল শিবশংকর। ঘড়িতে এখন ন’টা কুড়ি। সকালের চা খাওয়ার সময় যদিও অনেকটাই পেরিয়ে গেছে কিন্তু তবুও শিবশংকরের এটা প্রথম চা। তাই আশা ছাড়ে নি। একমাত্র ছেলের বৌ শমিতা যতবার তার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছে ততবারই সে একবার করে বলছে। কিন্তু একবারও উত্তর পায় নি।
               যখন চাকরি করত শিবশংকর তখন কতবার যে চা খেত তা গুণে শেষ করা যাবে না। যার সঙ্গে দেখা হতো তাকেই চা খাওয়াত। না খেতে চাইলে জোর করেও খাওয়াত। আর এখন কমতে কমতে এক কাপে এসে ঠেকেছে। তাও কতবার চাইতে হয়। 
               শিবশংকর এখন বিছানায় বসে। ঘুম থেকে ওঠার পর এক কাপ চা পেটে না পড়লে সে হাত পায়ে ঠিক জোর পায় না। তাই ব্রাশ করে এসে বিছানায় বসে থাকে চায়ের প্রত্যাশায়। তবে শিবশংকর জানে এত দেরিতে চা পাওয়ার জন্যে সে নিজেও অনেকটা দায়ি। কারণ এই বাড়িতে সকাল সাড়ে ছ’টায় একবার চা হয়। তখন যদি শিবশংকর তৈরি থাকে তাহলে তো কোনো সমস্যাই হয় না। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি উঠতে পারে না সে। বয়স প্রায় সত্তর ছুঁইছুঁই। একসময় সে পাঁচটায় উঠে সাতটায় অফিস বেরিয়ে যেত। কিন্তু এখন সে সব অতীত।                একদিন চায়ের লোভে সাড়ে ছ’টায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল শিবশংকর। বলতে হয় নি চা এসে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর সারাদিন কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব। খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন শিবশংকরের। তারপর থেকে সাড়ে আটটার আগে কিছুতেই বিছানা ছাড়ে না। তাছাড়া তাড়াতাড়ি উঠে করবেই বা কি। কাজ বলতে তো একটাই মোড়ের দোকানতলা থেকে একটা দুধের প্যাকেট নিয়ে আসা। বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের পথ।
               সদর দরজাটা শিবশংকরের ঘরের কাছাকাছি। সুতনু অফিস যাচ্ছে। ঠিক এইসময় বৌমা সুতনুর ব্যাগটা বয়ে নিয়ে যায়। সদর দরজা থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে তবে ব্যাগটা সুতনুকে দেয়। কল্যাণী উঠোনে এসে দাঁড়ায়। ছেলে মাকে হাতনাড়া দেয়।
               সুতনু চোখের আড়াল হয়। শমিতা ফিরে আসে। শিবশংকর আরও একবার চায়ের কথা বলে। উঠোন থেকে কল্যাণী ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ” চা চা করে সকাল থেকে পাগল করে দিলে ! দেখছ তো কেউ বসে নেই। একটু অপেক্ষা কর না, দেখো না দেয় কি না। ” কল্যাণী ছেলে বৌয়ের সঙ্গে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। এর জন্য শিবশংকর তাকে অবশ্য দোষ দেয় না। কারণ শিবশংকরের সঙ্গে শেষ দৃশ্যে অভিনয় করে কল্যাণীর খুব একটা লাভ হবে না। 
               শিবশংকর কল্যাণীর মতো নিজেকে অতটা ভাসিয়ে দিতে পারে নি। না, সে চেষ্টাও করে নি। যে মানুষটা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের একজন বড় অফিসার সে কি করে সংসারের যাবতীয় অনিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নেবে —– এটাই ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র কারণ নয়। আসলে শিবশংকরের মনে হয় বয়স হলেই কেন একজন মানুষকে তার ছেলের সংসারে সব কিছুর সঙ্গে আপোষ করতে হবে? ছেলের সংসারে বাবা কি কর্তা হতে পারে না?
               অবশ্য ঘুরে দাঁড়িয়ে শিবশংকরের খুব একটা লাভ হয় নি। আসলে এসব ক্ষেত্রে একার দ্বারা কিছু করা বেশ মুশকিল। কল্যাণী থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সে তো কাউকে কোনো ব্যাপারে অনুরোধ করে নি। যদি কল্যাণীর মনে হতো তাহলে সে নিজেই এগিয়ে আসত। তা যখন আসে নি তখন আর নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। 
               শিবশংকর মনে করে, সকালের চা-টা একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে চা খাওয়াটাই বড়ো নয়। চা তো ইচ্ছে করলেই যখন খুশি খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সকালের চা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সকালের চা খাওয়া মানে আমি সকালের আলোতে ডুব দিলাম। আর সকাল তার দুয়ার খুলে আমাকে তার দলভূক্ত করে নিল। অন্যদিকে একটা পরিবার তার সকালের চায়ে কাউকে ডাক দিল মানে সেই পরিবারটির মধ্যে আমি সকাল থেকেই প্রবেশ করলাম। 
               শিবশংকর বুঝতে পেরেছে, তার পরিবার তাকে আর নিতে চায় না পারিবারিক রোজ নামচায়। কেউ কোনো কিছু না চাইলে যেমন শুরু থেকেই জানিয়ে দেওয়া রীতি। এখানেও ঠিক তাই। তবে এজন্য শিবশংকরের কোনো দুঃখ নেই। একটা মানুষকে চিরদিন ভালো লাগবে এটা তো হতে পারে না। তার পরিবার সেটাই তাকে জানিয়ে দিয়েছে।
               শিবশংকর জীবনে কারও কাছ থেকে কোনো কিছু চায় নি। কোনো কিছুর জন্যে কাউকে অনুরোধ করে নি। মন দিয়ে নিজের কাজ করে গেছে। তার কাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কেউ তার কাছে আসতেই পারে, সেখানে তার কোনো নাম নেই। এতদিন পর্যন্ত পরিবারে শিবশংকরের যে ঘুরে দাঁড়ানো তা কিন্তু পরিবারে নিজের জায়গাটাকে আগলে রাখার জন্যে নয়। সে তার নিজের পরিবারে সবাইকে নিয়ে চলতে চেয়েছিল। কিন্তু পরিবার তাকে জানিয়ে দিয়েছে তার এই ইচ্ছায় তাদের সায় নেই। 
               শিবশংকর ঘড়ি দেখল। ন’টা চল্লিশ। আজ থেকেই শুরু করবে সে। সংসারের ওপর আর সে নির্ভর করবে না। চা-টা বাইরেই খেয়ে নেবে। বিছানা থেকে নেমে বইয়ের আলমারি থেকে “ঘরে বাইরে” পত্রিকার একটা সংখ্যা বের করল। পাতা উল্টে বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানাগুলো একবার দেখে নিল। তারপর দুধের ব্যাগটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

                      ************************

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

জন্ম ১৯৬৭ সালের ২ জানুয়ারি হুগলী জেলার ধনিয়াখালি গ্রামে। লেখালিখির শুরু খুব ছোটবেলা থেকেই। ছাপার অক্ষরে স্কুল ম্যাগাজিনে চিরাচরিত নিয়ম ভেঙেই প্রথম প্রকাশিত হয় "কেয়া" নামের একটি প্রেমের কবিতা। সাহিত্য নিয়েই পড়াশোনা। পেশায় গৃহশিক্ষক হলেও সাহিত্যই চব্বিশ ঘণ্টার ধ্যানজ্ঞান। মাসিক কৃত্তিবাস, একুশ শতক, ভাষাবন্ধন, প্রমা, কথাসাহিত্য প্রভৃতি পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থ ৫টি। From the spring of light (পলাশ পালের শিল্পীজীবন), তুমি অনন্ত জলধি (কবিতা), বিমূর্ততার অনন্ত প্রবাহে (কবিতা সংক্রান্ত গদ্য), চার ছক্কায় সচিন (ছড়া), দু'এক পশলা মান্না (ছড়া) ।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।