বিসমিল্লা
আজ কেদারঘাটে বেশ ভোরেই এসে বসেছেন বৃদ্ধটি। উদিত সূর্য মুখটি বার করার আগেই জীর্ণ শিরা ওঠা কাঁপা কাঁপা হাতে ঝোলা থেকে অতিপ্রিয় কেউটে সানাইটিকে বের করেন। পাত্তুরে ওষ্ঠচুম্বন করে শুরু করেন রেওয়াজ। আহীর ভৈঁরো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যায় কাশীর প্রত্যন্ত গলি থেকে বুরুজে, অপার গঙ্গার জলে তিরতিরে কাঁপন লাগে তখন।
সাকরেদরা আজ অার কেউই আসেনা। আসরে শেষবার ডাক পেয়েছেন তাও কম করে বিশ বছর আগে। বুড়ো হয়েছেন, কানে কম শোনেন, চোখের দৃষ্টিও যাই যাই করছে। তবু বাজনা থামেনি, সকাল সন্ধের রেওয়াজ থামেনি। আজকাল কাশির সাথে তাজা রক্ত ওঠে,তবু তিনি জানেন একেবারে জানাজায় শোয়ার আগের ওয়াক্ত অবধি তাঁর কেউটে বাজবে।
এন্তেকালকে ভয় পেলে আর ওস্তাদি কি করে জমল? সারাটা জীবন দারিদ্রকে মুঠোর মধ্যে পুষেছেন। পঞ্চমে ফুৎকার দিলে সবকিছু পালায়, পালিয়েছেও সবাই। মৃতের ঢিপির মধ্যে বাস করে করে মৃত্যু তাঁর চবুতরা থেকে ফিরে গেছে। এবারে আশীবছর হবে। রোজ ফুকারের ধ্বনিতে আল্লাহ কে বলেন, সানাইটি কেড়ে নেবার আগে যেন টুঁটি চিপে তাঁর আওয়াজটা সময় বুঝে বন্ধ করে দেন।
অসি ঘাটে বসেছেন বিকেলে। ক্লান্ত সূর্য গঙ্গায় নিজের সুরৎ দেখতে দেখতে ডুব লাগায়। ইমনভোপালীতে গৎ ধরলেন। একেক বেলা একেক ঘাটে বসে রেওয়াজ চলে। পুরো কাশীটাকেই মেহফিলের আসর বানিয়েছেন বৃদ্ধ। জাদু আছে ঠোঁটের ফুঁয়ে তাঁর। সে বিলকিস বানু বলত যুবাকালে। হীরামান্ডির নজরকারা তবায়েফ ছিল সে।কেউটের আওয়াজে শুনতে শুনতে কেঁদে ভাসাত। তার চিকন গাল বেয়ে গঙ্গা নামতো, সাত দিন বয়সের মরা ছেলেটার দুঃখটা পাক দিয়ে উঠত নাড়ীর ভিতরে।
বৃদ্ধের নিজেরই আজকাল খেয়াল থাকেনা যে সে মুসলমান না হিন্দু। অন্নপূর্ণা মন্দিরের প্রসাদ বা জ্ঞানব্যাপীর সামনে ইফতার তার কাছে এক। সুরের রাস্তায় খোদা রসুল আর বিশ্বনাথ কে আলাদা করবে এমন ইবলিসের মাথায় সে লাথি কষাবে বাগে পেলেই।
শীতটা বেজায় এইবছর। বুড়ো হাড়ে জলো হাওয়ায় কাঁপুনি ধরে। ডিসেম্বর মাসের সবে পাঁচ তারিখ , মেরজাইটায় এখনই শীতে শানাচ্ছে না, এবছরের শীত আল্লার দোয়ায় উৎরোলে হয় !
রাতে জ্বর আসে। সঙ্গে কাশি। তাজা রক্ত দেখে আর ডর লাগেনা। সবাই তো পা বাড়িয়েই আছে, কেউ আগে, কেউ বা পরে। বুকের মধ্যে কেউটে সানাই জড়িয়ে পাশ ফেরে বৃদ্ধ। ঘুমের আবেশে কানে বিলকিসের ফিসফিসানি ভেসে আসে তার খুব প্রিয় একখানি শের, বহুযুগের ওপার থেকেই -‘ ইশক নে গ্বালিব নিকাম্মা কর দিয়া /ভরনা হম্ ভি আদমী থে কাম কে…’
বিকেল থেকে হঠাৎ মহল্লায় চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কিছু নালায়েক শয়তান ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় এক প্রাচীন মসজিদকে সে খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে যায় সর্বত্র। ধর্মের জিগিরে সবাই রক্ত স্নানের নেশায় জাতধর্মের ভেদাভেদ ভুলে যায়।
দুকোম্পানী পল্টন টহল দেয় সারা মহল্লা জুড়ে। এই মারদাঙ্গায় বৃদ্ধ সারাটি রাত এক প্যাকিং বাক্সের আড়ালে রয়ে যায় সঙ্গে তার কেউটের ঝোলাটাকে নিয়ে। রক্তের আঁশটে গন্ধ নাকে আসে তীব্র ভাবে।
আবার ভোর হয় নিয়ম মেনে। উদিত সূর্যের আলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে কুয়াশার আস্তরণ ভেঙে ছড়িয়ে পরে গঙ্গায়, বুরুজে, চবুতরায়, ঘাটের সিঁড়িতে, থমথমে মহল্লায়ও সেই আলো ঢোকে, বিশ্বনাথের সোনালি চুড়োও নিস্তব্ধ হয়ে আলো মাখে।
চৌষট্টীঘাটের একটা ভগ্নপ্রায় মন্দিরের হাতায় কুয়াশামাখা ভোরে একজনকে হামাগুড়ি দিতে দেখা যায় ছায়ার মতন। মানুষটি শরীরটা টেনে নিয়ে যায় অতি কষ্টে। হঠাৎ চারদিক বাঙ্ময় হয়ে ওঠে, পূরবী ঠাটে বিশুদ্ধ ললিত রাগে ফুকরে ওঠে কেউটে সানাই।
সেই সুর রক্তস্নাত ভোরবেলাটিকে শুদ্ধ করে পূর্বপুরুষের পাপের শাপমুক্তি ঘটিয়ে।
(বিঃদ্রঃ – এটি কোন ভাবেই সানাই বাদক ওস্তাদ বিসমিল্লা খানের কাহিনী নয়। তবে সানাই এর সাথে বিসমিল্লা খান সাহেব সমার্থক ! তাই নামকরণের লোভ সংবরণ করতে অক্ষম)
0 Comments