বন্ধ ঘরের রহস্য

বর্ণালি বসাক বোস on

পিকলু চুপিচুপি এসে দরজায় দাঁড়িয়ে কান লাগিয়ে আড়ি পেতে শুনছে। ভেতর থেকে কেমন একটা কান্নার আওয়াজ আসছে না? একটু ধাক্কা লাগতেই দরজাটা খুলে যায়। আনেক দিনের দরজা তাও আবার বছরে এক দিনই খোলা হয় তাই বিশ্রি ভাবে ক্যাঁক করে শব্দ করে উঠলো। অমনি ঘরের ভেতরের মানুষ গুলো কেমন যেন চমকে উঠলো। পিকলুর ও মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অসিত বাবু বললেন

— এ কি দাদুভাই তুমি ঠাকুর দেখতে যাও নি ?

— না দাদাই

— কেন?

— রহস্যা উদ্ঘাটন করব বলে।

— কিসের রহস্য দাদুভাই?

— এই যে তোমরা প্রতি বছর পঞ্চমীর দিন রাতে এই ঘরে কি কর? এই ঘরটা সারা বছর বন্‌ধ থাকে শুধু পঞ্চমীর দিন রাতে খোলা হয় কেন?

— তুমি এতো কিছু জানলে কি করে? তুমি তো প্রতি বছর ঠাকুর দেখতে বাবা–মার সঙ্গে শহরে যাও।

— হ্যা আমি যাই কিন্তু আমার বন্ধুরা তো যায় না। ওরা গত কয়েক বছর ধরে খেয়াল করছে ব্যাপারটা। তাই এ বছর আমরা ঠিক করেছি যে এই রহস্য থেকে এবার পর্দা তুলতেই হবে। দাদাই বল তোমরা এখানে কি করছ? এই ছবিটিই বা কার?

— ওরে বাবা এ যে পিকলু গয়েন্দা। সে তো আবার দেখছি জেরাও করছে।

— ইয়ার্কি করো না দাদাই আমি এই ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ পাছিলাম। আর এই ঠাম্মিটা কে। ওনাকে তো এখানে আগে কখনো দেখিনি।

— এই ঠাম্মিটা আগে এখানেই থাকতেন। এখন শহরে থাকেন।

— দাদাই তোমাকে বলতেই হবে। তোমরা এখানে কি করছ?

— দাদুভাই সব বলব তুমি আর একটু বড় হও।

— আমি বড় হয়ে গেছি ক্লাস টেনে পড়ি। তুমি আমাকে বল।

পাশ থেকে খোকনবাবু বললেন ,“ অসিত তুই বরং ওকে সব কিছু খুলেই বল না হলে ওর মনটা অশান্ত হয়ে পরবে।” তপনবাবু ,অনিমেষবাবু , রতনবাবু ও টুসিদেবী সকলেই সম্মতি দিলেন।

–ঠিক আছে দাদুভাই তুমি তোমার বন্ধু দের নিয়ে এসো। সবাই বাড়িতে বলে এসো যে তোমরা এখানে আছ আর বাড়ি যেতে তোমাদের রাত হবে। আমরা তোমাদের পৌঁছে দেব।

–আচ্ছা দাদাই। তোমরা এখানেই থাকো। যাবে না কিন্তু। আমরা এখুনি আসছি।

–না না যাবো না দাদুভাই যাবো না। তোমরা এসো আমরা আছি।

কিছু পরেই জনা পাঁচেক ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এলো। যাদের বয়েস পনেরো– ষোল হাবে। তাদের মধ্যে একজন অসিতবাবুর নাতি আর একজন রতনবাবুর নাতি আর বাঁকিরা তাদের বন্ধু। ওরা এই মিশনটার নাম দিয়েছে ‘বন্ধ ঘরের রহস্য’

–দাদাই আমরা এসে গেছি। এবার বল।

–তবে শুনবেই দাদুভাই?

–হ্যা শুনবই ।

–আচ্ছা শোন তবেঃ। এই যে ছবিটি দেখছ এটি আমাদের বন্ধু বাবাইয়ের। বড় ভালছেলে ছিল। এসব কথা বলতে গেলে আমাদের চল্লিশ বছর পেছনে চলে যেতে হবে।আমাদের বয়স তখন পঁচিশ–ছাব্বিশ হবে। টুসি তুই বল বাবাই কেমন ছিল।

টুসিদেবী ফিরে গেলেন সেই সব দিনে যখন টুসিদেবী, সুপ্রিয়াদেবী (টুসিদেবীর মা),সুজনবাবু (টুসিদেবীর বাবা),আর সুপ্রিয় (টুসিদেবীর দাদা –বাবাই) সকলে এক সঙ্গে থাকতেন। হাসিখুশি সুখী পারিবার ছিল তাদের। কথা বলতে বলতে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই দিনটি– ‘আমার রাত পোহাল…’ অ্যালার্ম বেজে উঠল ফোনে ।

বাবাই এক লাফে উঠে পড়ল, হাতে ব্রাশ নিয়ে যেই বাইরে বের হচ্ছে অমনি সুপ্রিয়াদেবী ডেকে বললেন

–কী রে বাবাই সাতসকালে কোথায় চললি রে? নিশ্চই ক্লাবে না? দাঁড়া । তোর ব্যপারটা কি বলতো সারাদিন নাওয়া নেই খাওয়া নেই ক্লাবে পড়ে আছিস। দেব নাকি কানটা মুলে?

–এখুনি চলে আসব মা। একটু দেখে আসি না ঠাকুরের গায়ে মাটিটা লাগানো হল কি না।

–তোর এখুনি মানে তো দু ঘণ্টা। তাড়াতাড়ি আসবি কিন্তু। আমি চা চাপালাম। কত বার চা করব বলতো?

–আচ্ছা ঠিক আছে

(পাশ থেকে টুসি বলল)

–অ্যাই দাদা এবার আমাদের পূজোর থিমটা কি রে? সবলনা দাদা। আমি কাউকে বলবো না। দয়া করে বল না।

–না না কিছুতেই না। তোকে তো বলবই না। ঘোষ পাড়ার রিঙ্কির সাথে তোর খুব ভাব। তারপর তুই ওকে বলে দে আর ওরা আমাদের থিম চুরি করে আমাদের থেকে ভাল করে ফেলুক। কখনই না।

–হ্যাঁ তুই তো বেশী জানিস। বলছি বলব না।

বাবাই পেছন থেকে টুসির চুলটা টেনে দিল। টুসি চিৎকার করে মা কে বলছে

–ও মা দ্যাখ দাদা আমাকে মাড়ল।

–কি রে বাবাই তোরা কি বড় হবি না? কেনও টুসিকে মাড়ছিস ? বাবা কে ডাকব ?

ওমনি বাবাই ছূটে পালিয়ে গেল। টুসি মার কাছে গিয়ে বসল।

–মা সবার পূজো শুরু হয় ষষ্টী থেকে দুর্গা মায়ের বোধনের পর। আর আমাদের বাড়ীতে জুলাই মাস থেকেই কেমন একটা পূজো পূজো ভাব বল?

–হ্যা বাবাই যে পূজোর সব দ্বায়ীত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। কাঠামো তৈরি থেকে বিসর্জন ওর চোখে ঘুম নেই। অন্য সময় হাজার ডাক বাবুর দশটার আগে ঘুম ভাঙে না। আর এখন দ্যাখ ছটা বাজতেই কেমন লাফ দিয়ে উঠে পড়ে।

–হ্যা ওরই যেন সব দ্বায়ীত্ব। আগামী বার ও যখন থাকবে না দেখব তখন পূজো হয় কী না।

–আহা তুই এতো রাগ করছিস কেন মা?

–দ্যাখ না মা বলছি থিমটা বল। কিছুতেই বলছে না। আমি নাকি ঘোষপাড়ার রিঙ্কিকে বলে দেব। নিজের বোনের প্রতি এতটুকু বিশ্বাস নেই?

— রাগ করিস না মা। জানিস তো দাসপাড়া আর ঘোষপাড়ার একেবারে দা– কূড়াল সম্পর্ক। তারপর তো এবার আবার দুটো ক্লাবেরই ২৫ বছর পূর্তি। এবার তো আর কথাই নেই। তবে আমি বাবাইকে বলে দেব পাড়ার কারো কাছে যেন চাঁদা নিয়ে ঝামেলা না করে। পরে সবাই আমাকে বলে আমার ভীষণ খারাপ লাগে।

— দাদা জুলুম করে না । ঐ খোকনরা করে। নাম হয় দাদার। আমার দাদা কি ওরকম ছেলে?

— এই মেয়ে একটু আগেই দাদার নামে কত নালিশ হচ্ছিল যেই দাদার

দুর্নাম হল অমনি দাদার দিকে চলে গেলি?

— আমার দাদা আমি যা ইচ্ছা তাই বলব। লোকে কেন বলবে?

— সত্যি রে টুসি সামনে আর কটা দিন বাবাইটা আর্মিতে জয়েন করবে। জানিস তো আমি মা দুর্গার কাছে মানত করেছি বাবাই জয়েন করলে সামনের বছর অষ্টমীতে পুরো পূজোর খরচ আমি দেব।

— দেখ মা দাদা ঠিক কোনভাবে ম্যানেজ করে পূজোতে আসবেই। ও পাড়ার পূজো না দেখে থাকতেই পারবে না।

— কি জানি ওকে ছেরে যে কেমন করে থাকব। এত দিন তো কোন দিন ওকে ছাড়া থাকিনি। আচ্ছা নে তুই এখন পড়। কথা বলিস না। কলেজে পড়ছিস তাও তোকে পড়ার কথা বলতে হয়। কবে যে বড় হবি ?

টুসিদেবী বলে চলেছেন– এই ভাবে দেখতে দেখতে পূজো চলে এলো। দাদা মিটিং ডেকে সকলকে সব দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দিল। পূজোর ফলমূল বাজার,দশকরমার বাজার সব কিছু। সব বাড়ীর বউ–মেয়েদেরও ডেকেছে।পাড়ার বৌদের বলল

–কাকিমা তোমরা কিন্তু সকলে মিলে প্রতিদিন পূজোর জোগাড় করবে। কেউ দেরি করবে না। সব কিছু সময়ের মধ্যে হওয়া চাই।

–আচ্ছা বাবা তুই আর টেনশন করিস না। আমাদেরও তো একটা দ্বায়িত্ব আছে নাকি? প্রতিবছর হয় এবারও হবে।

–নিশ্চয় হবে। আমাদের ক্লাবের তো এটাই বিশেষত্ব পূজো যতই বড় হোক একটা ঘরোয়া ব্যাপার থাকে।আর প্রতিবছরের মত তোমরা কেউ বাড়ীতে রান্না করবে না কিন্তু।এখানে প্যান্ডেলে গোটা পাড়ার লোক একসাথে খাব। কাকু, তোমরা কিন্তু রান্না খাওয়ার দিকটা দেখবে।আমি এবার শহর থেকে রান্নার ঠাকুর ঠিক করেছি। চার দিনই ও রান্না করবে।

পাড়ার প্রবীণরা বলছে– বাবাইটা খুব দ্বায়িত্ববান ছেলে হয়েছে। কেমন দেখেছ সকলকে পূজোর কাজে ঢুকিয়ে দিল কেউ মন খারাপ করবে না। খুব বুদ্ধিমান ছেলে।দাসপাড়ায় পূজোটা সকলকে নিয়েই হয়। ঘোষপাড়ায় কি এসব আছে? ওরা তো শুধু থিম নিয়েই ব্যাস্ত। আরে পূজো মানে কটা দিন মা দুর্গার সাথে থাকা,সবাই মিলে আনন্দ করা। ঘোষ পাড়ায় তো এসবের বালাই–ই নেই।

প্রবীণ মহিলারা সমস্বরে বলে উঠল– এই বার শুরু হল। থাম তো তোমরা নিজেদের ঝগড়াটা তো ছেলেগুলোর মধ্যে ঢুকিয়েই দিয়েছ।আর নিজেরাও সারাদিন ঘোষ পাড়ার নিন্দা করে চলেছ। ছেলেগুলোর মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছ তোমরা,দু–পাড়ার মধ্যে একদম দা–কুড়াল সম্পর্ক। আমাদের কিন্তু এসব ভালো লাগে না।এবার এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।এই দ্বায়িত্ব তোমাদেরই নেওয়া উচিত।তোমাদের সময়ের ঝগড়া আর এখনকার ঝগড়ার মধ্যে রাতদিন তফাত। আগে ঝগড়া হত মুখে–মুখে এখন হয় লাঠিতে– লাঠিতে। তোমরা তো দিব্যি আছ আর আমরা ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি। যুগ পালটেছে তোমরাও পালটাও।এখনকার ছেলেরা তো জানেই না আসলে ঝগড়াটা কি নিয়ে।তোমরাও তো বুঝি ঠিকঠাক বলতে পারবে না। তা হলে এই ঝগড়াটা জিয়িয়ে রাখার দরকারটা কি?

–হ্যা বাপ ঠাকুরদার মুখে শুনেছি দুই পাড়ার দুই জমিদারের আমল থেকেই ঝগড়া।

–কোথায় জমি আর কোথায় জমিদারি। সবই তো চুকে–বুকে গেছে।আছে বলতে শুধু এই ঝগড়াটা এটাও এবার চুকে যাওয়া দরকার।

–সেটা তো দু তরফেরই দ্বায়িত্ব। তোমাদের কথা শুনে আমরা যাই আর আপমান হয়ে আসি তাই না?না না ও সব আমরা পারব না। সুতরাং যেমন আছে তেমনি থাকুক।

ক্লাবের নবীন সদস্যরা এতক্ষণ সবাই চুপ করে ছিল। বড়রা এবার চুপ করে গেলে দাদা বলল

–আচ্ছা কাকিমারা তোমরা সকলে তোমাদের দ্বায়িত্ব বুঝেছ? আর বাগচীকাকিমা

ভোগ কিন্তু তুমিই রান্না করবে।

–হ্যা অবশ্যই করব। কত ভাগ্যে মা কে রান্না করে খাওয়ানোর সুযোগ পেয়েছি তা কি আর হাতছাড়া করি বাবা।

–আচ্ছা টুসি তুই পাড়ার মেয়েদের নিয়ে বাগচীকাকিমাকে সাহায্য করবি।

পাড়ার এক কাকিমা মার কাছে এসে বলল

–বাবা সুপ্রিয়াদি তোমার ছেলে তো সব কাজে নিপুন হয়ে গেছে।

–সে তো তোমাদেরই আশীর্বাদ ভাই।

–শুনছি সামনে বার তো ও থাকবে না। তাহলে পূজো হবে কি ভাবে?

–কারোর জন্য কিছু থেমে থাকে না। দেখবে সব হয়ে যাবে। আর তোমার ছেলেটিও তো খুব কাজের। বাবাই ঠিক ওদের সব শিখিয়ে দেবে।

বেলা গড়িয়ে এলো সবাই যে যার বাড়ী চলে গেল।পরের দিন ষষ্টি মায়ের বোধন। গোটা পাড়া আনন্দে মেতে উঠেছে। সবার বাড়ী সাজান হয়েছে। পাড়ার এক কোনে একটা জীর্ণ বাড়ী ছিল যেখানে একজন বিধবা মহিলা তার ছেলেকে নিয়ে থাকতেন। ছেলেটি সাত–আট মাস হল বাইরে গেছে কাজের খোঁজে।তাকে দেখার কেউ নেই।দাদাই তার খোঁজখবর নিত দেখাশোনা করত। সেবার দাদা জামা কেনার জন্য বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেয়।সেই টাকা থেকে বাঁচিয়ে দাদা ওই মহিলার জন্য একটি শাড়ী কিনেছিল।পূজোর মিটিংয়ের পরে দাদা গিয়ে ওনাকে শাড়ীটা দিয়ে বলল –ঠাম্মা এই ক দিন বাড়িতে রান্না করবে না মণ্ডপেই খাবে।এই শাড়ীটা পরে ঠাকুর দেখবে কেমন?

বুড়ি ওকে অনেক আশীর্বাদ করল। ও বাড়ী ফিরে আসার পথে মণ্ডপটা ঘুরে এলো। সব কাজ শেষ । প্যান্ডেলের মিস্ত্রিরাও চলে গেছে। ঠাকুর বানানও পুরো শেষ। ও বাড়ী ফিরে গিয়ে মা কে বলল

–মা আসার সময় মণ্ডপটা ঘুরে এলাম । কি দারুন লাগছে গো মা। আজ এখন মণ্ডপটা ফাঁকা পরশু থেকে কত লোকজন হবে বল?

–তোর আর কাজ কি বাবা সকাল থেকে রাত শুধু মণ্ডপ আর মণ্ডপ। এখন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। সারাদিন খুব খাটাখাটনি যাচ্ছে।

–হ্যা মা তাড়াতাড়ি খেতে দাও খুব খিদে পেয়েছে।

–হ্যা বাবা বোস। টুসি আয় মা খেতে আয়।বাবাকেও ডেকে নিয়ে আয়।

খাওয়া শেষ করে আমরা সবে ঘুমতে যাচ্ছি তখনি রতনদা…..

(রতনবাবুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে)তিনি বললেন।

–হ্যা আমিই আমিই।হায় কেন যে সেদিন ওকে ডাকতে গিয়েছিলাম। সব না হয় শেষ হয়ে যেত ওতোথাকত।

কি? কি হয়েছে দাদু? তুমি কাঁদছ কেন? প্রশ্ন করল রতনবাবুর নাতি।

— আর কি দাদুভাই। আমি সেদিন ঘুমতে যাবার আগে ভাবলাম মণ্ডপটা একটু ঘুরে আসি। গিয়ে দেখি চারিদিকে আগুন । আমি কি করব বুঝতে না পেরে চিৎকার করতে লাগলাম

— কে কোথায় আছ শিগগির এস, আগুন লেগেছে ,সব যে শেষ হয়ে গেল।আমার চিৎকারে ততক্ষনে পাড়ার লোকজন বেরিয়ে এসেছে । সবাই আগুন আগুন লেগেছে বলে চিৎকার করছে। যে যার মত জল ঢালছে। আমি দৌড়ে গেলাম বাবাইকে ডাকতে , বললাম বাবাই শিগগির চল মণ্ডপে আগুন লেগেছে। বাবাই বলল বলিস কি? চল তো। আমরা দৌড়ে এলাম মণ্ডপে।

রতনবাবুর কথা শেষ হবার আগেই টুসিদেবি বলতে শুরু করলেন

— আমি, মা, বাবা সবাই দাদার সঙ্গে দৌড় দিলাম। দাদা পাগলের মত ছুটছে। ততক্ষনে পাড়ার সবাই বালতি করে জল এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাঁশ আর বেতের তৈরি মণ্ডপ দাউদাউ করে জ্বলছে বালতির জলে কি আর সে আগুন নেভে । কামাক্ষা মন্দিরের আদলে মণ্ডপ হয়েছিল সে বার। না রতনদা ?

— হ্যা রে টুসি।

— দাদা পাগলের মত চিৎকার করতে থাকে “সব যে শেষ হয়ে গেল গো হায় হায় কি হবে? কি করব এখন?” বলতে বলতে ও ছুটে জ্বলন্ত মণ্ডপের ভেতরে ঢুকে যায় যদি প্রতিমাগুলোকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু ততক্ষণে প্রতিমাগুলোর শাড়ি, চুল সব পুড়ে গেছে। আমরা বাইরে থেকে চিৎকার করছি দাদা চলে আয় যাস না। মা ডাকছে–“বাবাই ফিরে আয় আগুনের মধ্যে যাস না।” কিন্তু ও আমাদের কথা কানেই তুলল না।আমরা ওকে দেখতে পাচ্ছি ও শুধু এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে হঠাৎ ওপর থেকে জ্বলন্ত বাঁশগুলো নিচে পড়তে শুরু করল। একটা বাঁশ দাদার গায়ের উপর পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দাদার জামাকাপড়ে আগুন ধরে গেল। দাদার পাগলের মত করছে ও যেন আগুনের তাপ মালুমই করতে পারছে না। দাদার গোটা শরীরটাই জ্বলতে শুরু করল। চারিদিকে তখন লোকে লকারন্য।সবাই বলছে ফিরে আয় বাবাই ফিরে আয়। দাদা আসতে পারছে না ,আমরা কেউ আগুনের অত তাপে দাদার কাছাকাছিও যেতে পারছি না। মা শুধু দৌড়ে দাদার কাছে চলে যাচ্ছিল পাড়ার কাকিমারা কোনোমতে মা কে আটকেছে না হলে সে দিন হয়ত মা ও…।মণ্ডপের বাঁশ আর বেতের সঙ্গে আমার দাদাও ভস্মীভূত হয়ে গেল। পড়ে থাকল শুধু একটা দলা পাকান পিণ্ড। এরপর সব শেষ। চোখের সামনে দাদাকে পুড়ে যেতে দেখলাম কিচ্ছু করতে পারলাম না। আজও নিজেকে বড্ড স্বার্থপর মনে হয়। প্রানের ঝুঁকি নিয়ে ঐ আগুনের মধ্যে যাবার সাহস আমাদের ছিল না। এখানেই দাদার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। মা দাদাকে ঐ ভাবে জ্বলতে দেখে পড়ে গেল। আমরা ভাবলাম মা

হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছে। পাড়ার লোকেরা মাকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে গেল।বাবাও বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন। আর আমার অবস্থাটা ঠিক কি ছিল আমি জানি না। চারিদিকে শুধু চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের পাড়াটা শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। সারারাত সবাই মণ্ডপেই কাটিয়ে দিল।আমি এক কোনে বসে রইলাম। দেখতে দেখতে ভোর হয়ে গেল। পুলিশ এল। পোস্টম্রটাম করার মত কিছুই তো অবশিষ্ট নেই। ডাক্তারবাবু ডেথ সার্টিফিকেটে লিখলেন আগুনে পুড়ে মৃত্যু। কারো মাথায় তখন আসেনি আগুনটা এলো কোথা থেকে। সবাই তখন দাদার শোকে কাতর। এই তো কয়েক ঘণ্টা আগে ছেলেটা সকলকে পূজোর দ্বায়িত্ব ভাগ করে দিল, কত কথা বলল, কত হাসল। আর এখন চোখের সামনে ছেলেটি শেষ হয়ে গেল। পোড়া শরীরটা তো আর পোড়ানোর মত কিছু নেই তাই ঠিক হয় যতটুকু আছে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হবে। বাবারা গঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে এমন সময় খবর এল মা নাকি কোমায় চলে গেছে। আমি আর বাবা হয়ত পৃথিবীর সব খারাপ ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। বাবা দাদার পোড়া গলা শরীরটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। এমন সময় চার–পাঁচটি ছেলেকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। ছেলেগুলি ছিল ঘোষপাড়ার। আমাদের কারন আজানা চিরশত্রু তাই না অসিতদা?

–হ্যা । হঠাৎ আমরা দেখি ওরা বাবাইয়ের শরীরটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল । বলতে লাগল “আমাদের ক্ষমা করে দে বাবাই। আমরা বুঝতে পারিনি মণ্ডপ বাঁচাতে তুই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়বি। আমরা যে নিজেদের কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব না।” আমরা আশ্চর্য হয়ে ওদের কথা গুলো শুনছিলাম আমি বললাম তার মানে তোরা? তোরা আমাদের মণ্ডপে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিস? তোদের প্রাণের ভয় নেই? সেটা আবার বাহাদুরি দেখিয়ে বলতে এসেছিস? দাঁড়া তোদেরও বাবাইয়ের মত পুড়িয়ে মারব । সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার বড়রা এগিয়ে এসে বলল–

“ না রতন, অসিত তোরা আইন নিজের হাতে তুলে নিস না । ওরা যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। আমরা ওদের পুলিশের হাতে তুলে দেব তারপর আইনে ওদের যা শাস্তি হবে ওরা তা ভোগ করবে।”

আমরা দেখলাম ওদের পিছু পিছু ওদের বাবা–মাও এসে হাজির । ওনারা আমাদের হাতে পায়ে ধরতে লাগলেন। কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন। বললেন, “দয়া করে ওদের পুলিশে দেবেন না। ওদের জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। বিনা কারনে শত্রুতা পুষে রাখতে গিয়ে আজ এতবড় মাশুল দিতে হল । একটা জলজ্যান্ত প্রান চলে গেল।”

টুসিদেবী বলতে লাগলেন –সব দেখে শুনে বাবা বললেন তোমরা ওদের ছেড়ে দাও। ওদের পুলিশে দিলেও আমার বাবাই তো আর ফিরে আসবে না। বরং আমার বাবাইএর বলিদানে তাও যদি দুই পাড়ার শত্রুতাটা চিরদিনের তরে শেষ হয়ে যায়।তাই হল আমরা পুলিশকে কিছু জানালাম না। সবাই দাদাকে নিয়ে রওনা হল। মণ্ডপে পড়ে রইল শুধু কালো ছাই। আমি হসপিটালে মার কাছে গেলাম ।দেখলাম মা শুয়ে আছে। ডাক্তারবাবু বললেন–“ আপনারা ওনাকে কোলকাতায় নিয়ে যান ওখানকার চিকিৎসায় যদি উনি সুস্থ হন।” ন’মাস ধরে বাড়ী ঘর ছেড়ে বাবা আর আমি কোলকাতায় পড়ে রইলাম মার চিকিৎসা করাতে আমরা প্রায় সর্বশান্ত হয়ে গেলাম। আমি আর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারলাম না। ন’মাস পর হঠাৎ একদিন নার্সিংহোম থেকে ফোন করল–“আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন আপনাদের পেসেন্টের ঞ্জ্যান ফিরে এসেছে।” গিয়ে দেখি মা কে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে । আমাকে দেখে মা বলল, “টুসি আমার বাবাই কি আর নেই?” বুঝতে পারলাম ঞ্জ্যান ফেরার পর থেকে মা দাদার কথাই ভাবছে। কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। সত্যি টা বলব? না না মা সত্যিটা নিতে পারবে না। আমি মাকে বললাম –মা এখন তোমার কেমন লাগছে? বাড়ী যাবে? মা কে বাড়ী নিয়ে এলাম এভাবে মা বছর পাঁচেক বাঁচল তারপর একদিন মা ও চলে গেল ছমাস পড়ে বাবাও। তখন আমি একদম একা । হসপিটালের ডাক্তারবাবু আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। আমিও রাজি হয়ে যাই। আজ আমি তার গৃহিনী হয়ে শহরে আছি। আমি ভাল আছি। কিন্তু অতীতকে ভুলতে পারিনা। পূজো এলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। ঐ ঘটনার পর আমি আর দুর্গা ঠাকুরের মুখ দেখি না। শুধু পঞ্চমীর দিন এখানে আসি তারপর নিজেকে ঘর বন্দি করে রাখি। আমার ছেলে মেয়েরা ওদের বাবার সাথে ঠাকুর দেখতে যায়। উনি সব জানেন তাই আমাকে কক্ষনো জোড় করেন না ।

অসিতবাবু বললেন – আমরাও তারপর থেকে ক্লাবে আর দুর্গা পূজো করিনি। তোমাদের বাবারা পূজো করতে চেয়েছিল আমরা বাধা দিয়েছিলাম । ওদের সাথে আমাদের তখন একটু মনমালিন্য হয়েছিলো বটে। দাদুভাই, আমরা যতদিন বেঁচে আছি আমরা দুর্গাঠাকুরের মুখ আর কোনোদিন দেখব না। আমরা মারা যাবার পর তোমরা না হয় আবার দুর্গা পূজো কর।

–সরি দাদাই আমরা তোমাদের মন খারাপ করে দিলাম।এত ঘটনা তো আমরা জানতাম না।

–না দাদুভাই ।আজকে তো আমাদের মন খারাপেরই দিন। অভিশপ্ত দিন !

কথা বলতে বলতে তপনবাবু দরজার দিকে তাকাতেই তার মনে হল দরজার বাইরে কে একটা দাঁড়িয়ে আছে । তিনি চিৎকার করে উঠলেন –“কে?কে ওখানে?কে একটা যেন সরে গেল না?অন্ধকারে ঠিক বোঝা গেল না। যেন মনে হল একজন মহিলা।টুসি একটু দ্যাখ না ।”

–হ্যা দেখছি তপনদা।

টুসিদেবী বাইরে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন সাদা থান পরা একজন মহিলা এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে।

–কে? কে ওখানে? এদিকে এসো বলছি।

ভদ্রমহিলা কেমন একটা জড়সড় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

–কি হল ?এসো এদিকে।

এবার ভদ্রমহিলা এক পা –দু পা করে টুসিদেবির দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন – টুসি চিনতে পারছিস?

–কে? ঠিক চিনতে পারলাম না তো।

— একটু ভালো করে চেয়ে দ্যাখ তো, সত্যিই চিনতে পারছিস না?

— এ কি? রিঙ্কি না?

— হ্যা।

— রিঙ্কি তুই ? এখানে? এখন? কি ব্যাপার? কোথায় ছিলিরে এত দিন? তোর কত খোঁজ করেছি , কারো কাছে তোর সন্ধান পাই নি। কেমন আছিস?

— ওরে বাবা একবারে এত প্রশ্ন।

— কি চেহারা হয়েছে রে তোর। কোথায় থাকিস এখন? এখানে কি করছিস? জানিস বছর দুই আগে ঠিক এই দিনটাতে আমি এখানে আসছিলাম তখন স্টেশন রোডে মনে হল যেন তোকে দেখলাম । গাড়ি থামিয়ে কত খুঁজলাম আর দেখতে পেলাম না। সে দিন যাকে দেখেছিলাম সেও এরকম সাদা থান পরা ছিল। উফ্‌ আমি তোর এই রুপ আর দেখতে পারছি না। কেন তুই এই বেশে?

ভেতর থেকে তপনবাবুরা টুসিদেবিকে ডেকে বললেন

— কি রে টুসি কে ওখানে? কার সঙ্গে কথা বলছিস?

— দেখ তপনদা রিঙ্কি এসেছে। আমার বন্ধু রিঙ্কি।

— সে কি ও এত রাতে এখানে কি করছে।

রিঙ্কিদেবী বললেন – টুসি আমি আসি রে। তোদের বিরক্ত করলাম ।

— কোথায় যাচ্ছিস?

— আমি চলে যাই।

— দাঁড়া আমার প্রশ্ন গুলোর উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত তোর ছুটি নেই । অনেক দিন পর তোর সাথে দেখা এত তাড়াতাড়ি তোকে ছাড়ছি না। কিন্তু আজকের দিনটাতে তো কোন উচ্ছাস আসে না ।

— আমি জানি। তাই তো বলছি আজ আমি আসি। যদি বেঁচে থাকি তো আবার দেখা হবে।

— কেন বারবার যাই যাই করছিস বল তো? তুই কি পালিয়ে যেতে চাইছিস?

— না না পালিয়ে যাব কেন।

— চল ঘরের ভেতরে চল। এবার বলতো এত রাতে তুই এখানে কি করছিস?

ঘরের ভেতরে এসে রিঙ্কিদেবী চোখের জল সামলাতে পারলেন না ।তার দুচোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল । বাবাইএর ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন টুসিদেবীর কথা তিনি শুনতেও পেলেন না । চল্লিশ বছর পর এই মুখটি তিনি দেখছেন । এই তো সেই মুগ্ধ করা হাসি। হঠাৎ তার হাত থেকে একটি গোলাপ ফুল মাটিতে পড়ে গেল যেটা তিনি এতক্ষণ শাড়ীর আঁচলের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। ফুলটা পড়ে যেতেই তার চেতনা ফিরে এলো।

টুসিদেবী বললেন–রিঙ্কি এই গোলাপটা কি তুই দাদার জন্য এনেছিস?

রিঙ্কিদেবী ভয়ে লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছিলেন । কোন কথার উত্তর দেওয়ার সাধ্য তার ছিল না। তিনি নিরুত্তর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিন্তু চোখের জল সামলাতে পারলেন না।

টুসিদেবী অসিতবাবুকে বললেন –অসিতদা তুমি বরং পিকলুদের বাড়ী দিয়ে এসো। রাত নটা বাজে ওদের বাড়িতে চিন্তা করবে। আমরা রিঙ্কির সঙ্গে কথা বলছি । তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। টুসিদেবী তার স্বামীকে ফোন করে জানালেন আজ তার যেতে একটু দেরি হবে। এবার তিনি রিঙ্কিদেবীকে বললেন– আচ্ছা রিঙ্কি তুই এখন কোথায় থাকিস বলতো?

— কাশীতে

— কাশী মানে বেনারস?

— হ্যা

— কবে থেকে?

— অনেক দিন।

— তাহলে আজ এখানে?

— থাক না টুসি এত দিন যা সবার অলক্ষ্যে ছিল । আজ তা নিয়ে কথা নাই বা বললাম।

— না না আমার কেমন একটা লাগছে ।তুই দয়া করে আমায় সব খুলে বল। তুই কি তবে আজ দাদার জন্যেই……?

— হ্যা হ্যা। ও আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। একবারও ভাবলনা আমি বাঁচব কি করে। সব কিছুতে বাহাদুরি। কেন অত আগুনের মধ্যে ওকে যেতে হবে ? সব মিথ্যে কথা বলতো। ও আমাকে মোটেই ভালবাসত না । তা হলে আমায় ছেড়ে ও যেতে পারত না ।

— রিঙ্কি দাদা তোকে ভালবাসত?

— আজ এই বয়সে এসে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমাকে এসব বলতে হবে টুসি? আমার ভালো লাগছে না।

— তুই বল রিঙ্কি । কেউ জানবে না বিশ্বাস কর। আজ এই বন্ধ ঘরের আরও একটি রহস্য উন্মচন হবে। আর তা এই বন্ধ ঘরেই থেকে যাবে। আমাদের এই কজন ছাড়া এ কথা আর কেউ জানবে না। আমি কথা দিচ্ছি ।

রতনবাবুরাও বললেন বল আমরাও শুনি যে রহস্য এত দিন আমাদের কাছেও আজানা ছিল।

— আর কি বলব রতনদা।টুসি আর আমি এক সাথে পড়ার সুবাদে ওদের বাড়ীতে প্রায়ই আমার যাতায়াত ছিল। তখনি সুপ্রিয়র সাথে আমার আলাপ হয় । আস্তে আস্তে আমরা দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলি। তখন কাউকে কিছু জানানোর সাহস হয়নি আমাদের। দু পাড়ার মধ্যে যা গণ্ডগোল ছিল। জানলে যে কি হত? ভয়ে আমরা ব্যাপার টা গোপন রাখলাম ।সুপ্রিয় আর্মিতে চান্স পেল। ঠিক হল ও জয়েন করে এলে ওর মা কে বলবে। তারপর আমরা বিয়ে করব ।কত স্বপ্ন দেখেছিলাম দুজনে। কত কথা, মান,আভিমান।তারপর একদিন রাতে সব শেষ। আমার জীবনটা রাতের মত অন্ধকার করে দিয়ে ও চলে গেল। ও ওর কথা রাখল না। ও যাবার পরে আমি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। মা আমাকে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে আমার বিয়ে নিয়ে উঠে পরে লাগলেন। আমার বিয়ে ঠিক হল।কার সঙ্গে বিয়ে, কোথায় বিয়ে কোন কিছুই আমার জানার আগ্রহ ছিল না। একটা জড় পদার্থের মত আমি বিয়ের পিড়িতে বসলাম। কখন বিয়ে হল কখন শুভ দৃষ্টি হল আমি জানি না। আমার সামনে শুধু সুপ্রিয়র মুখটা ভেসে উঠছিল। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ী গেলাম । ছেলেটি হয়ত ভালই ছিল। আমার ভালমত মনেও পরে না। মুখটাও ঠিক মনে নেই। শয়নে, স্বপনে , জাগরণে যে একটি মুখের ছবিই আমার প্রানে প্রতিষ্ঠা করে রেখেছি। আর একটি ছবি বসানর যে জায়গা ছিল না। আমরা দ্বিরাগমনে এলাম এখানে এসে থেকেই ওনার একটু একটু জ্বর এসেছিল। বাবা মা জামাইকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। মার সেবা যত্নে উনি একটু সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন । যাবার দিন মা আমাকে বললেন – “ জামাইয়ের একটু সেবা যত্ন করিস । জ্বরটা যেন ঘুরে না আসে ঠিক সময় মত ওষুধ গুলো দিস ।”

মা এখানে মনে করে ওষুধ গুলো তাকে খাওয়াতেন । ওখানে গিয়ে তার জ্বর বাড়ল । মিথ্যে কোথা বলব না আমার উদাসীনতায় আমি তাকে ঠিক মত ওষুধ গুলোও খাওয়াইনি । আমি যেন ওনাকে ঐ জায়গায় বসাতেই পারছিলাম না । সুপ্রিয়র স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল । সাত দিনের জ্বরে আমার স্বামী মারা যায় । তারপর শুরু হয় আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের কুকথা । আমাকে অপয়া বলে গালিগালাজ । আমি বাবা মায়ের কাছে চলে আসি । আমি ফিরে আসাতে আমার দাদা বউদি খুব অসন্তুষ্ট হয় । কোন বিধবা ননদ কে কি কেউ পুষতে চায় ? আমি সব দিক চিন্তা করে বেনারস চলে গেলাম । বাবা বিশ্বনাথের চরণে নিজেকে সঁপে দিলাম তারপর থেকে তিনি ই আমার ভরসা । শুধু পঞ্চমীর দিন বিকেলে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে এই ঘরটার সামনে আসি তোমরা যখন এখান থেকে চলে যাও । আমি কিছুক্ষন এই দরজাটার কাছে দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর রাতের ট্রেন ধরে বেনারস ফিরে যাই । আজকে তোমরা বের হতে দেরী করছিলে বলে তোমরা থাকতেই আমি এখানে চলে এলাম । আমার যে আবার ট্রেন ধরতে হবে । আজকের দিনটা তে এখানে না এসে থাকতে পারিনা জান । এখানে এলে আমি সুপ্রিয় কে অনুভব করতে পারি । আমি চল্লিশটা বছর যে ওর স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি । এতক্ষন সবাই বাক্‌রুদ্ধ হয়ে সব শুনছিল আর অবাক হয়ে ভাবছিল এতদিন তারা এসবের কিছুই টের পায়নি ? টুসি দেবী বললেন – তাহলে রতনদা সত্যি এই বন্ধ ঘরে অনেক রহস্যই লুকিয়ে ছিল । রিঙ্কি তুই ভাবিস না এরপরেও এটা রহস্যই থেকে যাবে । আর একটা কথা আজ আর তোর ফেরা হবে না । এখন তুই আমার সাথে আমার বাড়ীতে চল । ওখানে কদিন কাটিয়ে তারপর যাবি । চল আমার গাড়িতে উঠে বস ।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন

Categories: গল্প

বর্ণালি বসাক বোস

বর্ণালি বসাক বোস একজন পুরপুরি গৃহবধূ । রাষ্ট্র বিজ্ঞানে মাষ্টার ডিগ্রি করেছেন বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে । ছাত্রজীবন থেকেই লিখতে ভালোবাসেন । স্বামীর উতসাহে, ছেলের উদ্দীপনায় ও ভাগ্নির আব্দারে আবার লেখার জীবনে ফিরে আশা । সংসারের কাজের ফাঁকে গান আর লেখা তার সঙ্গী । সমাজের চারিপাশের বিভিন্ন রকম চরিত্র যেটা তার মনকে নাড়া দেয়, তাই নিয়েই তিনি লিখতে ভালোবাসেন । এসবের পাশাপাশি সংসারের সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন । এতদিন স্বামীই ছিলেন তার লেখার একমাত্র পাঠক তারই অনুপ্রেরণায় আজ এই লেখা সকলের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য প্রকাশিত । বাবা, মা এবং শাশুড়ি মায়ের আশীর্বাদকে ও ছোট বোনের ভালোবাসাকে জীবনের পাথেয় করে চলতে চান ।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।