ছোট্টু
ক্রিকেট বল ড্রেনে গিয়ে পড়লে সে ছুটে যেত। ধুয়ে মুছে সাফ করে ছুঁড়ে দিত আমাদের দিকে। বলতে গেলে আমাদের কী চাই তা চোখের ঈশারাতে বুঝে যেত। বিনিময়ে আমরা তাকে সামান্য হাওয়াই মিঠাই আর হজমি গুলি দিতাম।
এই রোগা লিকলিকে বছর সাত-আটেকের ছেলেটিই হল ছোট্টু। তার সামান্য পরিচয় আমরা জানতাম। মামার বাড়ি থাকে আর সারাদিন টই-টই করে ঘোরে।
কিসে পড়িস জানতে চাইলে বলেছিল, আর একটু বড় হলে মামা কাজে লাগিয়ে দেবে কোনো দোকানে। তাই পড়ি না।
তুমুল বৃষ্টির একটা বিকেলে আমরা গ্রামের বাইরে জঙ্গলে ঘেরা সাহেব পুকুরের গল্পে মেতে উঠেছিলাম। রকি বলছিল, সন্ধে বেলা ওই পুকুরপাড়ে এক খন্ড কাগজে কী চাই তা লিখে এলে পরদিন সকালে তা পাওয়া যায়। দু একজন ভ্রু কুঁচকে তাকালে সে বলল, ওর দাদুর মুখে শুনেছে সব সত্যি।
রকি আমাদের ক্যাপ্টেন, তার কথা না মানলে পরদিন খেলা থেকে বাদ যাবার ভয়ে আমরা সব্বাই তার কথা মেনে নিলাম।
পরদিন সকালে পড়তে বসেছি। ছোট্টু এসে বলল, শুভদা আমায় পড়াবে? লেখা শেখাবে?
আমি তখন ক্লাস সেভেনে, ওই সময়ে একজন ছাত্র পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার ভেবে আনন্দে রাজি হলাম।যখনই সময় পাই ডেকে এনে পড়াই। স্যাররা যেমন সব জানেন ভাব করে বলেন, লেখাপড়াতে মন দাও… মন দাও। আমিও ছোট্টুকে তা বারবার বলতাম।
মাস চারেক বাদে এক সকালে সে পড়তে এলো না, খবর পেলাম আমাদের স্কুলের পেছনে বসে ছোট্টু কাঁদছে।
দৌড়ে গেলাম। ওর কাছে গিয়ে বললাম,কী হয়েছে ছোট্টু?কাঁদছিস কেন?
সে চোখ মুছতে মুছতে বলল, তোমরা খুব মিথ্যে কথা বলো, সব মিথ্যে। তোমাদের কথা মত আমার কী চাই লিখে ঢিল চাপা দিয়ে ঐ পুকুরপাড়ে রেখে এসেছিলাম, কই কিছুই তো পেলাম না।
—কী লিখেছিলি? কী?
ছোট্টু চুপ।
এক দৌড়ে গেলাম সাহেবপুকুরের পাড়ে, একটু খুঁজতেই দেখতে পেলাম ঢিল চাপা দেয়া এক খন্ড কাগজ।
ঢিল সরিয়ে কাগজটা হাতে তুলে নিলাম। তাতে কাঁচা হাতে লেখা ‘মা’।
0 Comments