একটি গোলাপ

বর্ণালি বসাক বোস on

হাতে এক গোছা গোলাপ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে শুভ।  কলিং বেলটা বাজিয়ে চলেছে ।  ভেতর থেকে মধুরিমা বলছে –  আসছি…..ই ।  একটুও অপেক্ষা করো না কেন ? সমানে বেলটা বাজিয়ে চলেছ   দরজাটা  খুলতে তো একটু সময় লাগবে নাকি?
দরজা খুলতেই  এক গোছা গোলাপ সহ  হাতটা একদম মধুরিমার সামনে ।
–  ওরে বাবা এত গোলাপ ?  কি  দারুন লাগছে গো !
–    তোমার ভালো লাগছে ?
–   দারুন !
–  দোকানের ছেলেটাই সাজিয়ে দিল ।   শুনেছে আজ তোমার জন্মদিন  তাই ওর দোকানের যত রংয়ের গোলাপ ছিল  সব দিয়ে গোছাটা বানিয়ে দিল । আর প্রতিদিনের মত  একটা গোলাপ ফ্রী ।
–  ছেলেটা রোজ তোমায় একটা করে গোলাপ ফ্রী  দেয় কেন?
–  দেবে  না ?  আমি যে ওর রোজকার খোদ্দের । অফিস থেকে ফেরার পথে ওর দোকানের সামনে দিয়েই তো আসি । ফুলগুলো দেখে তোমার জন্য না এনে থাকতে পারিনা ।  আমিতো জানি তুমি কেমন ফুল ভালোবাসো ।
–   তা ঠিক ।   ফুল আমার ভীষণ ভালো লাগে ।
–  আচ্ছা শোনো তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও ।  আজ আমরা বাইরে খাবো ।  রেস্টুরেন্টে টেবিল বুক করে এসেছি ।  তোমার জন্মদিন বলে কথা ।
–  যাঃ ।
        শুভ আর মধুরিমা  দুজনেই  বেরিয়ে পড়ল ।  মধুরিমা খুব সুন্দর করে সেজেছে ।  শুভ দোকানদারের ফ্রীতে দেওয়া ফুলটা মধুরিমার খোঁপায় গুঁজে দিল ।  দুজনে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলো ।  কর্ণারের টেবিলটা বুক করে রেখেছিল শুভ । মধুরিমা খাবারের অর্ডার দিল ।  খাবার এলো  তার সঙ্গে এল সুন্দর একটা কেক যেটা শুভ আগেই অর্ডার দিয়ে রেখেছিল ।  হোটেল থেকেও মধুরিমা কে জন্মদিনের অভিনন্দন জানালো ।  মধুরিমা কেক  কাটলো । সে এক অদ্ভুত রোমান্টিক অনুভূতি । এই প্রথম তার জন্মদিন এই ভাবে পালন করা হলো।   দুজনে কত ছবি তুলল গল্প করল ।  সব শেষে বাড়ি ফেরার পালা ।  শুভ এবার মধুরিমাকে ওর জন্মদিনের উপহারটা দিলো । একটা নেকলেস ।  মধুরিমা তো একদম আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল ।
                  পরের দিন শুভ সময়মতো অফিসে রওনা দিলো ।  মধুরিমা বাড়িতে সারাদিন একা ।  সন্ধ্যায় সে শুভর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ।  আজ শুভ  বড্ড বেশি দেরি করছে ।  রোজ তো সে সাতটার মধ্যে চলে আসে । আটটা বাজতে চলল আজ কেন আসছে না । মনে মনে মধুরিমা ভাবে, ” না একবার ফোনটা করেই দেখি। অন্যদিন তো এত দেরি করে না ।” ফোনটা হাতে নিয়ে যেই কল করতে যাবে তখনই কলিংবেলটা বেজে উঠলো ।  মধুরিমা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো ।  যথারীতি শুভ অন্যদিনের মত মধুরিমার হাতে ফুল দেয় । আজ রজনীগন্ধা এনেছে শুভ কিন্তু আজ অন্য দিনের মত সেই রোমান্স নেই ।  কেমন যেন ক্লান্ত অবসন্ন দেখাচ্ছে ওকে ।  ফুলটা হাত থেকে নিয়ে ফুলদানিতে জল দিয়ে রেখে দিলো মধুরিমা ।  শুভ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে টেবিলে এসে বসলো।  মধুরিমা চায়ের সঙ্গে কচুরি নিয়ে এলো ।
–  এত দেরী করলে কেন গো ?  সেই কখন কচুরি ভেজেছি ।  এত রাতে এসব খেলে ডিনার করবে কখন?  এ বাবা !  কচুরিটাতো  ঠান্ডা  হয়ে গেছে   দাঁড়াও মাইক্রোওভেনে গরম করে আনি ।
–   তার  আর দরকার নেই মধু । এখন ওসব থাক ।  আমাকে শুধু চা দাও ।  এখন আর ওসব খাব না । একদম ডিনার করবো ।
–  কি   হয়েছে বলতো তোমার ?  আসার পর থেকেই দেখছি  কেমন একটা মনমরা ভাব ।   অফিসে কি কোন ঝামেলা হয়েছে ?  বস নিশ্চয়ই কিছু বলেছে না ?  ওই লোকটা তো দেখছি কোন কিছুতেই খুশি হয় না ।  স্টাফদের বকাঝকা না করলে ওর খাবারই হজম হয় না ।  কাউকে মানুষ বলে ভাবতেই পারে না ।   বাজে লোক একটা ।
–  আরে না না।  বস কিছু বলেননি ।
–  তাহলে ?  অমন করে আছো কেন ?  সারাদিন আমি একা থাকি ।  সন্ধ্যের পর থেকে তোমার অপেক্ষায় বসে আছি কখন তুমি আসবে ।  আর বাড়ি এসে তুমি যদি চুপচাপ থাকো কার ভালো লাগে বলতো?
–  রাগ করো না মধু ।  সত্যি আজ আর কিচ্ছু ভালো লাগছেনা ।
–  তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ।
–  নাঃ ।
        মধুরিমা রান্নাঘরে চলে গেল । শুভ খবরের কাগজ টা নিয়ে টেবিলে বসে রইল ।  রাত দশটা বাজে মধুরিমা টেবিলে খাবার নিয়ে এলো ।  দুজনে খেতে বসলো।   মধুরিমা  খেয়াল করল  শুভ আজ একটু অন্য মনস্ক হয়ে আছে ।  ও আর কথা বাড়ালো না ।  খাওয়া সেরে শুভ বিছানায় গেল ।  একটু পরে মধুরিমা ও বিছানায় গেল । এবার মধুরিমা নাছোড়বান্দা।  কি হয়েছে বলতেই হবে ।
শুভ বললো –  একটা নিষ্পাপ জীবন কেমন করে কারোর জন্য শেষ হয়ে যায় ।
–  মানে?
–  দেখো আমি বলতে পারি কিন্তু তোমার মন খারাপ করা চলবে না ।
– আগে বল তো দেখি।
–   আরে ওসমান ,  ফুল বিক্রি করে যে ছেলেটি ।  আজকে অফিস থেকে আসছি দেখলাম আব্দুল মিঞা  মানে ওর দোকানের মালিক ওকে খুব বকাবকি করছে ।  কেন সে ফ্রিতে সবাইকে একটি করে গোলাপ দেয় তাই।  বলছে,  “খেতে পাচ্ছিলি  না রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলি ,  আমি আশ্রয় দিলাম বলে  খেয়ে পড়ে  বাঁচলি   আবার আমারই ক্ষতি করছিস ।” ওসমান মন খারাপ করে এক কোনায়  দাঁড়িয়ে আছে । আমার ভীষণ খারাপ লাগলো । ও তো আমাকেও রোজ ফ্রিতে একটা করে গোলাপ দেয়  ।  মালিক তো রাগ করবেই  ।  কিন্তু আব্দুল মিয়া এটা বুঝলে না এজন্যই কিন্তু ওর দোকানে বিক্রি বেশি ।   আমি হিসেব করে একটা 200 টাকার নোট তাকে দিয়ে বললাম ভাই ওকে বলবেন না । ও খুব ভালো ছেলে । ওর ব্যবহারের জন্যই আমি রোজ এই দোকানে আসি । আমার স্ত্রী খুব ফুল ভালোবাসে আমি রোজ এখান থেকে ফুল নিয়ে যাই ।  এই টাকাটা রাখুন আমিও অনেকদিন ফ্রির গোলাপ নিয়েছি ।  আব্দুল মিঞা টাকাটা নিয়ে বললে,”  আরে না না দাদা আপনার মতো তো আর সবাই না “।  দেখলাম ওসমানের ফুল প্রায় শেষ শুধু রজনীগন্ধাটাই পড়ে আছে । আমি সব কটি রজনিগন্ধা কিনে নিলাম ।  ওসমান দোকান বন্ধ করে দিল । বুঝলাম আজ হয়তো ওর কপালে খাওয়া জুটবে না ।  বললাম ওসমান চলো নদীর ধারে গিয়ে বসি ।  ও মাথা নাড়লো  । আমার পেছনে পেছনে চলল। মুখে কোন কথা নেই ।যাবার সময় দুজনের জন্যই রুটি তরকা কিনে নিলাম।  শুধু ওর জন্য নিলেও যদি না খায়। দুজনে রুটি তড়কা খেলাম জান নিমেষের মধ্যে ওর খাওয়া শেষ হয়ে গেল খুব খিদে পেয়েছিল ওর ।আমার থেকে আরো একটা রুটি ওকে দিলাম নেবে না, জোর করেই দিলাম। খেতে খেতে ওসমানের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল আমি ওর চোখের জলটা মুছিয়ে দিয়ে বললাম ওসমান খুব কষ্ট পেয়েছো না? মন খারাপ করোনা ও মালিকরা একটু বকে। আমার বস তো আমায় কত বকেন খারাপ লাগে কিন্তু পরে মনকে মানিয়ে নেই। তোমার বাড়িতে কে কে আছেন ?বাবা-মা-ভাই -বোন ।
– কেউ নেই ।
         এই প্রথম ওর মুখে আমি কোন শব্দ শুনতে পেলাম ।  এটা অন্তত বুঝলাম যে ও বোবা নয় ।  আবার প্রশ্ন করলাম কেউ নেই ? কেন ? তারা কোথায়?
– সবাই ছিল সব হারিয়ে গেল!
–  কোথায় হারিয়ে গেল  ওসমান?
–  ওর সঙ্গে আমার সব চলে গেল!
–  কার সঙ্গে?
–  আমার প্রাণ ,আমার ফুল ,আমার জীবন।
–  কে সে?
–  সে আছে না সরি  ছিল একজন ।
–  আমায় বলবে না ? আমি তোমার বন্ধু হতে চাই।
–  আমি চাইনা ।কেউ আমার বন্ধু হতে পারেনা।
–  কেন পারে না?  আমরা তো প্রায় একই বয়সী আমাকে তোমার বন্ধু ভাবতে পারো ।
–  কি করবেন আপনি আমার বন্ধু হয়ে? ফিরিয়ে দিতে পারবেন আমার হারিয়ে যাওয়া জীবনটা?
– তা হয়তো পারবোনা কিন্তু একটা চেষ্টা করে তো দেখতে পারি । অন্তত নিজেকে হালকা করার জন্য বল। যে কষ্টটা এতদিন বুকে চেপে রেখেছো আমাকে বলে দেখো অনেকটা হালকা লাগবে।
–  আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু রিমেম্বার হার ।গড় নোস  হাউ আই লাভড হার ।  এভরিথিং ইন মাই লাইফ হাস বিন ফিনিশড বাই হার ।
–  ওসমান তুমি পড়াশুনা জানো?
–  আমি এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলট ছিলাম ।  খুব আকাশে ওড়ার শখ ছিল আমার।  ছোটবেলা থেকেই আকাশে পাখিদের দিকে চেয়ে থাকতাম ভাবতাম ,আমিও যদি ওদের মতো মেঘের দেশে যেতে পারতাম। অনেক অনেক উপরে উড়তাম ।
–  তারপর ?
–  জানেন তারপর একদিন আমার স্বপ্ন পূরণ হলো ।  আমি এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলট হিসেবে জয়েন করলাম ।  আমি আজও ওই দিনটার কথা ভুলতে পারিনা ।  জয়নিং লেটার টা পেয়ে আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে ওপরে তুলে নিয়ে বললাম মা  আমি এবার  মেঘেদের দেশে যাব।  আমার স্বপ্ন স্বার্থক হল মা । বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরল।
বোন বলল  দাদা আমাকে কিন্তু প্লেনে ওঠাতে হবে ।  আমি বললাম চড়বি বৈকি। সবাই চড়বো ।  খুব ভালো কাটছিল জানেন! বাবা মা বোন সবাই কত খুশি । তারপর আমি ওকে ফোন করলাম  ও তখন  দিল্লিতে ইউনিভারসিটিতে পড়তো ।  খবরটা পেয়ে তো ভীষণ খুশি।  বললাম এবার ছুটিতে তুমি বাড়ি এলে বাবা মা কে নিয়ে তোমাদের বাড়ি যাব বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ।
– তারপর ?
–  ওর পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে ও বাড়ি এলো ।  আমি বাবা মাকে নিয়ে ওদের বাড়ি গেলাম ।  আমার বাবা ওর বাবাকে আমাদের বিয়ের প্রস্তাব দিলেন ।  ওর বাবা একরকম অপমানজনকভাবে প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন ।  বললেন  ,”আপনারা তো ব্রাহ্মণ নন ।  আমরা ব্রাহ্মণ ছাড়া মেয়ের বিয়ে দেব না ।”  আমার বাবা ওনাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন বললেন,” ওরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে ।  ওরা খুব ভালো থাকবে ।  মেয়ের কোন কষ্ট হবে না ।  আপনার মেয়ে দেখে আমার ঘরের লক্ষী করে পাঠান না দাদা ।”  পাশ থেকে ওর মা বলল,” না না তা কি করে সম্ভব ।  অন্য কাস্টে মেয়ে বিয়ে ।  কখনোই সম্ভব না।  আমাদের আত্মীয় স্বজনরা কি বলবে । ” আমার মা ওর মায়ের হাত দুটো চেপে ধরে বললো, “আজকাল কি এসব আর কেউ মানে দিদি ?  ওরা যে পরস্পরকে খুব ভালোবাসে ।  আর আমার ছেলেটি ও তো অযোগ্য নয় । ” আমার বুকের ভেতরটা যেন ফেটে যাচ্ছিল ।  আমার জন্য বাবা মাকে এত ছোট হতে দেখে নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিচ্ছিলাম ।  অবাক হলাম যখন দেখলাম ও কোনো প্রতিবাদ করলো না ।  শেষে আমি মাকে বললাম মা চলো ।  যেখানে এতোটুকু সম্মান নেই এখানে আত্মীয়তা হবে কি করে ?  মা বলল সম্মান না করুক তোদের সম্পর্কটা তো মেনে নেবে ।  তখন মনে হচ্ছিল কায়স্থ না হয়ে যদি ব্রাহ্মণ হতাম তাহলে সারাটা জীবন ওর সঙ্গে থাকতে পারতাম ।
–   সে কি তুমি হিন্দু ?
– হ্যাঁ ।
–  তাহলে তোমার নাম ওসমান কেন ?
–  এত আবদুল মিঞার দেয়া নাম ।  লোকটা রাগী হলেও মনটা নরম ।  আমাকে ফুটপাতে পড়ে থাকতে দেখে নিজেই ওর দোকানে কাজ দেয় ।  ওই আমাকে ওসমান বলে ডাকে ।  ও কখনো আমার নাম জিজ্ঞেস করেনি আমিও বলিনি । নামে আর কি এসে যায় ।
–  তারপর?  তোমরা বাড়ি ফিরে  এলে?  ওনারা বিয়েতে রাজি হলেন না?
– নাঃ ।  আমার বিশ্বাস ছিল ও এসব মানবে না ।  ছুটে আমার কাছে চলে আসবে ।  আমরা দুজনে সংসার করবো ।   পরের দিন আমি ওকে ফোন করলাম ।  ওর সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম ।  প্রথমে ও কিছুতেই দেখা করতে রাজি হচ্ছিল না ।  অনেক অনুরোধের পর  ও অাসল কিছুক্ষণের জন্য ।  আমি একটা গোলাপ নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।  ও এল  আমি এক হাঁটু গেড়ে গোলাপ টা হাতে নিয়ে বললাম উইল ইউ ম্যারি মি ? ভেবেছিলাম আমারে রোমান্টিক অ্যাপ্রোচে গোলাপ টা হাত থেকে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরবে ।  কিন্তু……..।
–  কিন্তু কি? কি করলো সে?
–  সে বলল, ” না। আমি তোমায়  বিয়ে করতে পারবোনা ।  বাবা মা তোমার সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করেছে ।  ভবিষ্যতে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করো না ।”
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল ।   আমি যেন আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ।    এটা কে ?  একে তো আমি চিনি না ।  এক রাতে এত পরিবর্তন ?  আমি আবার বললাম ।  ওর হাতে পায়ে ধরলাম ।  বললাম আমায় ছেড়ে যেও না ।  আমি তোমায় ছাড়া বাঁচবো না ।  ও শুনলো না ।  চলে গেল ।  নিয়ে চলে গেল আমার সব ।   আমি শেষ হয়ে গেলাম ।  একবার ভাবলাম নিজেকে শেষ করে দেই ।  কিন্তু বাবা-মার কথা ভেবে তা পারলাম না ।  ওরা তো কোন দোষ করেনি ।  আমার বাবা-মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন ।  ওরা আমার মৃত্যু সইতে পারতেন না।  কি করব কোথায় যাব কিছুই ভেবে উঠতে পারছিলাম না ।  সারাদিন ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম ।  আমাদের হাসিখুশি পরিবারে কেমন একটা শোকের ছায়া পড়ে গেল ।  হাসি যেন আমাদের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল ।  কয়েকদিন পরেই এয়ার ইন্ডিয়া থেকে ওয়ার্নিং লেটার পাঠালো।  ওরা লিখেছিল দুদিনের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে আমায় ডিসমিস করা হবে ।  বাবা-মা আমাকে অনেক বোঝালো ।  ওরা বলল,” এটা তোর ছোটবেলার স্বপ্ন তুই এই স্বপ্ন নিয়েই বাঁচ ।  পরে যদি ইচ্ছে হয় অন্য কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিস ।  আমরা তোকে জোর করব না ।”  মনে হল কিসের স্বপ্ন? এরকম স্বপ্ন দেখি নি ।  আমি গেলাম না।  চাকরিটা চলে গেল ।  বাবা-মা খুব কষ্ট পেলেন।  এই চাকরির উপযুক্ত করার জন্য বাবা-মাকেও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে ।   মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল আমাদের ।  তার মধ্যে আমাদের দুই ভাই বোনের পড়াশোনা ।  বাবা-মা কোন কিছু ত্রুটি রাখেননি ।  ভেবে দেখলাম আমাকে এইভাবে সব সময় চোখের সামনে দেখলে বাবা মা  তিলে তিলে মরে যাবে ।  মনে হল এমন কোথাও চলে যাই যেখানে আমাকে কেউ চেনে না ।  যেখানে কেউ আমাকে ওর কথা বলবেনা আমি বাড়ি ছাড়লাম ।  একদিন ভোরবেলা কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লাম ।  কিছু টাকা ছিল আমি ট্রেনে করে সোজা দিল্লি চলে এলাম ।  ও দিল্লিতে অনেকদিন ছিল ।  এখানে রাস্তাঘাটে আমি ওকে অনুভব করি অনুভব করি ।  যা টাকা ছিল তাতে টেনেটুনে দুদিন চলল ।  তারপর টাকা ও শেষ  খাবার ও নেই ।   থাকার জায়গা নেই ।  ফুটপাতে শুয়ে রাতটা তো কেটে যায় কিন্তু  পেট তো মানে না ।  কখনো কখনো ভিক্ষেও করেছি জানেন শুধু এই পেটটার জন্য ।  শুধু খেতে চায় ।  থাকতে পারিনা ।  সব যেন কেমন হয়ে গেল ।  একদিন মন্দিরের বাইরে কাঙাল ভোজন হচ্ছিল  আমি খেতে বসেছি আব্দুল মিয়ঞা সেদিন  ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল যাবার সময় ও আমাকে দেখে ছিল ।  তারপর একদিন ফুটপাতে আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে আমাকে নিয়ে যায়। ওরও একটি কম পয়সার কর্মচারী দরকার ছিল আর আমারও একটু খাবারের ।  চলে যাই আমিও ওর সাথে ।
–  ও তোমাকে খেতে দিত না?
–  দুবেলা খেতে দেবে বলেছিল।  কিন্তু আমি যেহেতু একটা করে গোলাপ ফ্রিতে দিতাম ভাই একবেলা খেতে দিত আর এক বেলার টাকাটা কেটে নিতো ।  সকালে কাজে আসার সময় দুটো রুটি আর এক কাপ চা ব্যাস আমার সারাদিনের খাবার ।
–  তাও তুমি কেন সকলকে  ফ্রিতে গোলাপ দিতে?  আহা!  আমি তো আগে জানতাম না তাহলে কোনদিন তোমার ফ্রির গোলাপটা নিতাম না ।  তুমি তোমার খাবারের টাকা থেকে ওটা দিতে?  ইসস !  আমার নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে ।  কেন তুমি এটা করতে করতে ?
–  ও যে খুব ফুল ভালবাসত ।   বিশেষ করে গোলাপ ।  নানান রঙের  গোলাপ ।  আমি যখন কাউকে গোলাপটা দেই আমার মনে হয়  আমি ফুলটা ওকে দিচ্ছি ।  প্রতিটা গোলাপের মধ্যে  যে আমি ওকে দেখতে পাই।  মনে হয় ঠিক কারো না কারো হাত দিয়ে আমার গোলাপ টা ওর কাছে পৌঁছে যাবে ।
–  তুমি এখনো ওকে এতো ভালোবাসো?  ওর উপরে তোমার রাগ হয় না?
– নাঃ।  হয় না ।  ও ভালো থাকুক ।
–  তোমার মনটা অনেক বড় ।  সত্যি বলছি ওসমান যদি কোনদিন তোমার প্রেমিকাকে খুঁজে পাই আমি ওকে তোমার কাছে নিয়ে আসব ।  আচ্ছা কোথায় বাড়ি তার?  আর নামটাই বা কি ?  ওসমান তোমার আসল নামটা কি ? 
–  আজ উঠি ।  বাড়ি যান ।   অনেক দেরি হয়ে গেল ।
             কেমন একটা ব্যস্ত হয়ে উঠল সে আমারও মনে হলো তুমি চিন্তা করছ ।  তাই আমিও তাড়াতাড়ি চলে এলাম ।  কিন্তু মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল জানো ।  এ কি মধু তুমি কাঁদছো ?  আমি আগেই বলেছিলাম তোমার মন খারাপ হবে তুমি শুনতে চেও না ।
–  আচ্ছা শুভ ছেলেটির আসল নামটা কি ।  আর ওর বাড়ি বা কোথায়  তোমায় কি কিছু বলেছে ?
– নাঃ ।  কেন বলতো ?
– না  এমনি  জিজ্ঞেস করছিলাম ।
–   ওসব তো কিছুই বলল না ।  এমন কি যার জন্য আজ ওর এই অবস্থা তার নামটিও একবারের জন্যও মুখে আনলো না ।
–  আমায় কালকে একবার ছেলেটির কাছে নিয়ে যাবে?
–   কি ব্যাপার বলতো ?
–  আরে এমনি ।  কি আবার ব্যাপার।
–  আরে আমি তো মজা করলাম  । জানি তো  আমার মধুর ফুলের মত নরম মন ।  সে তো ছুটে যাবেই ।  নিশ্চয়ই নিয়ে যাব ।  এখন ঘুমাও।
                  শুভ ঘুমিয়ে পড়ে ।   মধুরিমার ঘুম আসেনা ।  ওর জীবনটা দু বছর পিছিয়ে গেল।  যেদিন সন্দীপনের বাবা মা ওদের বাড়িতে এসেছিল ।  তাহলে কি এটা সন্দীপন  ?   মধুরিমা কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না ।  এও কি সম্ভব ?  সত্যি তো সেদিনের পর তো আর সন্দীপনের কোন খোঁজ নেয়নি ।  বাবা মার কথা শুনে কি কারো অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল ?  একপ্রকার অনিদ্রায় মধুরিমার রাত কাটল ।  পরেরদিন শুভ অফিসে বেরিয়ে যাবার পর মধুরিমা ওর এক পুরনো বান্ধবী কে ফোন করল সন্দীপনের খোঁজ নেবার জন্য ।  সে বললো সন্দীপন দেড় বছর হলো নিখোঁজ ।  ওর বাবা-মা প্রায় পাগল হয়ে গেছে ।  বোন বিয়ে করেনি ।  বাবা-মার দেখাশোনা করে । সঙ্গে এটাও বললো ,” তুই খুব খারাপ কাজ করেছিস মধু ।একটা পরিবার তোর জন্য শেষ হয়ে গেল ।  সন্দীপন সত্যি তোকে খুব ভালোবাসতো ।  এখন আর খোঁজ নিয়ে কি করবি ? যা সর্বনাশ হওয়ার তা তো হয়েই গেছে  । তুই ভালো থাক ।”  কথাগুলো যেন মধুর শরীরে বিদ্যুতের মতো আঘাত করলো ।  যেন বুকের মধ্যে কেউ ছুরি বসিয়ে দিলো ।  কোন কথা না বলে ফোনটা রেখে দিল মধু ।  মনে মনে ভাবল এ সন্দীপনই হবে । একবার সে ভাবলো শুভকে সব খুলে বলবে ।  আবার ভাবলো শুভ যদি ওকে ভুল বোঝে ।  সারাদিন সাতপাঁচ ভেবে দিনটা পার হয়ে গেল ।  শুভ অফিস থেকে ফেরার আগেই মধুরিমা তৈরি হয়ে নিল ।  শুভ ফিরলে ওরা দুজনে সন্দীপন ওরফে ওসমানের দোকানে যায়।  কিন্তু একি এ যে অন্য একটি বাচ্চা ছেলে দোকানে বসে ।   শুভ জিজ্ঞেস করল ,  ” কিরে তুই?  ওসমান কোথায়? “
–  ওসমান দাকে সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ।  আবার কোন শহরে পালিয়ে গেল  কে জানে ।
– সে কি ? কোথায় গেল ?  এই শহরে থাকলেও তো তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।  এতবড়  শহর ,  কত রাস্তা, কত গলি  কোথায় খুজবো তাকে ।
       নিরাশ হয়ে শুভ আর মধুরিমা বাড়ি ফিরে আসে ।  মধুরিমা কাপড় ছাড়তে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় ।  কান্নায় ভেঙে পড়ে সে ।  কাছে পেয়েও সন্দীপন কে সে ধরতে পারল না ।  মনে মনে সন্দীপন এর কাছে ক্ষমা চায়।  মনে করতে থাকে সেই ফ্রি গোলাপ গুলোর কথা  যেগুলোতে সন্দীপনের হাতের ছোঁয়া ছিল ।  বলতে থাকে সন্দীপন তোমার গোলাপগুলো আমি পেয়েছি।
       


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


বর্ণালি বসাক বোস

বর্ণালি বসাক বোস একজন পুরপুরি গৃহবধূ । রাষ্ট্র বিজ্ঞানে মাষ্টার ডিগ্রি করেছেন বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে । ছাত্রজীবন থেকেই লিখতে ভালোবাসেন । স্বামীর উতসাহে, ছেলের উদ্দীপনায় ও ভাগ্নির আব্দারে আবার লেখার জীবনে ফিরে আশা । সংসারের কাজের ফাঁকে গান আর লেখা তার সঙ্গী । সমাজের চারিপাশের বিভিন্ন রকম চরিত্র যেটা তার মনকে নাড়া দেয়, তাই নিয়েই তিনি লিখতে ভালোবাসেন । এসবের পাশাপাশি সংসারের সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন । এতদিন স্বামীই ছিলেন তার লেখার একমাত্র পাঠক তারই অনুপ্রেরণায় আজ এই লেখা সকলের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য প্রকাশিত । বাবা, মা এবং শাশুড়ি মায়ের আশীর্বাদকে ও ছোট বোনের ভালোবাসাকে জীবনের পাথেয় করে চলতে চান ।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।