একজন টিকটিকি (পর্ব – ১৫)
মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হল নিজের চেহারা।
মিথ্যে বলার সময় চেহারা বিদ্রোহ করে বসে। ভয় পেলে তা প্রকাশ করে ফেলে। গলায় খুশির ঝলক থাকলেও চেহারা ফুটে তোলে দুশ্চিন্তার ছাপ। আবার কথা দিয়ে মানুষ যখন প্রতারণা করতে চায়, ঠিক তখন কথা কমে যায়। একটা প্রশ্নের উত্তর কিছুতেই শেষ হয় না। মিথ্যা থেকে যত সে দূরে পালাতে চেষ্টা করে। যেতে পারে না। নিজের স্বপক্ষে যা বলতে চায় তাতে কখনই আমি কিংবা আমার শব্দগুলো থাকে না। আমরা হয়ত প্রকাশ্যে খুঁজি সত্য, গোপনে বিক্রি করি মিথ্যা।
লিলি স্পষ্ট বুঝতে পারছে জানলার সামনে দাঁড়ানো যুবকটি মিথ্যে বলছে তবু সে কিছুই বুঝতে দিতে চাইছে না। এর কারণ মানুষটার কাছ থেকে সব না জেনে ছেড়ে দেওয়া ভুল হবে। তাই কিছুই না বোঝার ভান করে লিলি বলল, বাবাকে খুব জরুরি চিঠি দিতে এসেছেন? তাই বললেন তো?
—-হুম, একটা হাতচিঠি পাঠিয়েছে আমার মালিক। বলেছে খুব জরুরি চিঠি। যতটুকু আমায় বলা হয়েছে ততটুকুই বললাম।
—–আরও বললেন যে, চিঠিখানা যিনি পাঠিয়েছেন তাকে আমি চিনব না। না চিনতেই পারি, বাবার পরিচিত সবাইকে তো আর চিনি না। যাইহোক, আপনি চিঠিটা আমায় দিতে পারেন।
—মাফ করবেন। আমি এটা করতে পারব না। আমায় বলা হয়েছে চিঠিটা যেন জগদীশবাবুর হাতেই দিই। অন্য কাউকে দিলে আমি এবং আমার মালিক বিপদে পড়ব। এর বেশি কিছু জানতে চাইবেন না।
লিলি ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। সামনে দাঁড়ানো মানুষটার এতে কিছু হেলদোল নেই। সে এক মনে উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে উঠোনে শুকোতে দেওয়া জামা কাপড় নয় সে তাজমহল দেখছে।
লিপি কড়া গলায় বলল, কিছু না মনে করলে আপনি বারান্দায় বসতে পারেন। অপেক্ষা করুন। বাবা আজকাল তাড়াতাড়িই ফিরছে। আর হ্যাঁ আপনার নামটা আরেকবার বলুন। আমি খুব ভুলে যাই।
— আমার নাম যোগেন।
—- কোথায় থাকেন?
—- ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের পাশের গলি। মুখুজ্জে মেস বাড়ি বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।
— কী কাজ করেন?
—- এটা বলা বারণ আছে। মালিকের বারণ।
—- আপনার মালিক কী এমন করে যে তাকে এত কিছু গোপন রাখতে হয়? নিশ্চয় সোজা পথে কিছু করেন না! এখন মনে হচ্ছে আপনাকে বসতে বলা আমার ভুল হয়েছে।
— তবে চলে যাচ্ছি।
— দাঁড়ান।আমার বাবাকে কেন দরকার আপনার স্যরি আপনার মালিকের?
— বললাম তো এসব কিছু বলা যাবে না। আমার হাতে মালিক একটা হাতচিঠি পাঠিয়েছে। বলেছে পড়া হলে যেন আমি চিঠিখানা ফেরত নিয়ে যাই। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কতটা জরুরি চিঠি।
লিপির চোখ স্থির, ভ্রু আরও কুঁচকে গেছে। মনে হচ্ছে সে এক্ষুণি রাগে ফেটে পড়বে। এটাই চেয়েছিল দীনবন্ধু। বলেছিল, মেয়েটিকে রাগিয়ে দিবি। মানুষ যা জানতে চায় তার সব উত্তর পেতে থাকলে জানার ইচ্ছে দৌড়তে থাকে। পাওয়াটা অভ্যেস হয়ে যায়। ঠিক তখনই ব্রেক কষে বলতে হয় এটা বলা যাবে না, ওটা কিছুতেই বলব না। এতে ভাল কাজ হয়। মানুষটি না বলা উত্তরটি জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ছলে বলে কৌশলে সে সব জানতে চায়। তখন ধীরেধীরে কায়দা করে সব জেনে নিতে হয়। যেন দুজন দুজনকে সাহায্য করছে।
লিপি আগের মতই কড়া গলায় বলল, আপনি যাবেন না। বাবা না আসা অব্দি যাবেন না। আর চলে যেতে চাইলে চিঠিটা আমায় পড়তে দিতে হবে।
যোগেন মিনমিন করে কিছু উচ্চারণ করল সেটা লিলির কানে এসে পৌছল না। তবু সে অবাক চোখে দেখতে লাগল মানুষটাকে চক্কর কেটে উত্তরে চলে যাচ্ছে একটা ফড়িং।আবার ফিরে আসছে। এমন কেন হচ্ছে? এটা কি সত্যিই হচ্ছে? না তার কল্পনা? নাকি আধকপালি মাথাব্যথা ফিরে আসার লক্ষ্মণ ! ব্যথা শুরুর আগে চোখের সামনে মাঝেমধ্যেই আলোর ঝলকানি হয়। কখনও দৃষ্টিবিভ্রম হয়। হাতে পায়ে ঝিম ধরে। কারুর সংগে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না অথচ মনে প্রশ্নের পাহাড় জমছে!
যোগেন চাপা গলায় বলল, একটা ফড়িং আমার কাছে আসছে যাচ্ছে। চক্কর খাচ্ছে। এটা দেখে অবাক হয়েছেন, তাইনা?
লিলি মাথা ঝাকিয়ে বলল, বারবার আসছে আর চারটে পাক খেয়ে উড়ে যাচ্ছে সেই উত্তরে। অবাক হব না?
দীনবন্ধু বলেছেন, মেয়েটির সাহায্য নিতে হবে। জগদীশ মানুষটা সম্পর্কে না জেনে আমাদের ছোটাছুটি করা ঠিক হচ্ছে না যোগেন। চোখকান খুলে চলবে।
—আমার মনে হয় লোকটা খুব সাধারণ। আমাদের গ্রামে এমন কুঁড়া মানুষ অনেক আছে। এরা সারাদিন ঝিমায় মানে ঘুমঘুম লাল টকটকে চোখে ড্যাবড্যাব করে তাকায়ে থাকে।
—- চোখ লাল হয় কখন?
—- রাত জাগলে।
—-জাগে কেন? এটা জানতে না পারা অব্দি সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না। যা বলছিলাম, লিপি মেয়েটির সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে সহজ হবে। বিশ্বাস না করলে সে খুব সাধারণ কথা গুলো বলবে না। আমাদের জানতে হবে জগদীশের রোজকার জীবন। কী করে? কী করত? বন্ধু বান্ধব থাকলে তারা কারা? আড্ডা দেয় কোথায়? এইসব।
—একখানে যেতে দেখেছি। থানার সামনের রাস্তায় বিশ্বাস লন্ড্রিতে গিয়ে বসে। চা খায়। গল্প গুজব করে।
দীনবন্ধু হাসল, দোকানদারের নাম অন্তিম সাহা। কাজের সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাক্ষণ শব্দছক নিয়ে বসে থাকে। ডান কানের উপরে রাখে কলম বাম কানের উপরে বিড়ি।
—শব্দছক কী?
—- এটা হল ভাষার সঙ্গে খেলা। মজাটা হল যার সঙ্গে খেলছ তাকে দেখতে পাবে না। কেউ আড়াল থেকে বেশ কিছু ধাঁধাঁ পাঠিয়ে দিয়েছে। তাঁর ছুঁড়ে দেওয়া রহস্য উদ্ধার করতে পারলেই আসে জয়। শব্দছক করলে চিন্তাশক্তি বাড়ে।
—তবে ডানকানে কলম সবদিন থাকে না। আমি বাম কানেও কলম রাখতে দেখেছি।
— লেখে তো ডানহাতে?
—- হুম।
— ডান হাতে লিখলে বামকানের উপরে কলম রাখবে কেন? এটাতে খটকা লাগছে যোগেন। খুব ভাল করে দেখবে বিষয়টা। জগদীশের বাড়িতে ঠিক কতজন থাকে?
—- তিনজন।
— দিনে তুমি যা দেখছ তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে না। ভুলে যেও না মানুষটা রাত জাগে। রাতে কী করে?
—রাতে গিয়ে দেখব?
—তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। দিনেও খেয়াল করে দেখতে পার।
— কেমন করে?
—- একটা বাড়িতে কতজন থাকে তার হদিশ প্রকাশ্যে টাঙিয়ে রাখা হয়। ও থেকে বুঝে নিতে হয়। আমায় এমন করেই কাজ শিখিয়েছিল পুলিশ অফিসাররা। জামা কাপড় কেচে রোদে দিলে তা ভাল করে খেয়াল করবে। দিনে যাদের দেখতে পাও তাদের সাথে মেলাবে। খটকা লাগলে সেটা মাথায় রাখবে। এমন হতেই পারে বাড়িতে ধুতি পরবার মত কেউ নেই। তবু মাঝে মধ্যেই একটা ধুতি শুকোতে দেয়। কিংবা জিন্স পরার মত কেউ নেই তবু জিন্স শুকোচ্ছে উঠোনে। এবার যখন যাবে ভাল করে উঠোনটা দেখবে। মনে থাকবে?
যোগেন উঠোনের দিকে তাকিয়েই বলল, ঝড় আসছে। মিনিট বিশেকের মধ্যে বড় ঝড় আসবে।
লিপি ঝড়ের বিষয়টা পাত্তা না দিয়ে বলল, আপনি প্লিজ চিঠিটা আমায় পড়তে দিন।আমার খুব টেনশন হচ্ছে।
কিছু না বলে উঠোনে নেমে গেল যোগেন। সে গিয়ে দাঁড়াল পেপে গাছটার নীচে। এমন ভাবে এগিয়ে গিয়ে মাটিতে উবু হয়ে বসল যাতে মনে হয় পেঁপে গাছের তলায় সদ্য বেগুনি ফুলে ভরা লজ্জাবতী গাছটা দেখতেই ছুটে এসেছে। যোগেনের চোখ ঘুরছে উঠোনে শুকোতে দেওয়া ফ্যাকাশে হয়ে আসা আকাশি রঙের ফতুয়ার উপরে। ফুতুয়াটার গায়ে ছোপছোপ কালচে দাগ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দাগ তুলবার আপ্রান চেষ্টা করা হয়েছে। কাজ তেমন হয়নি। কাছ থেকে দেখতে পারলে ভাল হত। কিন্তু সে মাথা ঘুরিয়েও স্পষ্ট বুঝতে পারছে অসম্ভব সুন্দর অবাক চোখের এক মেয়ে তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
যোগেন খুব কায়দা করে দুটো ফুল তুলল লজ্জাবতীর। তবু হাতে বেগুনি রেণু ভরল। হাত মুছতে মুছতে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ফতুয়াটার পাশে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে পিচকারি দিয়ে রঙ ছুড়েছিল কেউ! আবার আগের মত এগিয়ে গিয়ে লিলির জানলায় দুটো লজ্জাবতী ফুল রেখে বলল, এই ফুলের দিকে বেশিক্ষণ তাকালে দুশ্চি, ভয়, টেনশন সব হারায়ে যায়। এটা আমার গ্রামের চালু কথা। পরীক্ষা করে দেখেছি। ফল দেয়। আপনি আমার উপরে রাগ না ফুলের দিকে তাকান।
লিলি ফুলের দিকে না তাকিয়ে যোগেনের মুখের দিকে তাকাল। মানুষটাকে আর আগের মত খারাপ লাগছে না। তবে কি সত্যিই রাগ উধাও হয়েছে?
পড়ুন, এই ধারাবাহিক উপন্যাসের আগের পর্ব।
0 Comments