আমরা দেখব না স্বপ্ন? (প্রথম পর্ব)

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় on

গভীর রাতে, উদাসীন ঘরগুলোর নির্লিপ্ত বিছানার পাশে… কারও পায়ের শব্দ শুনতে পেল নৈঃশব্দ্য। ঘুমে আচ্ছন্ন কোনও কাহিল চোখই দেখতে পেল না তাকে, অন্ধকার ঘরের ঘড়িগুলোও জানল না রাত কয় প্রহর। কোঁচকানো ভুরু আর ক্লান্ত চেষ্টার আড়ালে ঘুম। চোখের পাতার ওপারে কী আছে, তা দিনের আলোতেই বোঝা যায় না… আর এখন তো অন্ধকার, গভীর রাত! 

পা টিপে-টিপে ঘুমন্ত মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল সে, তাকিয়ে রইল সেই চোখের দিকে, যার এপারে ঘুম… ওর ওপারে রহস্য! তারপর, কোমরে বাঁধা একটা থলি থেকে এক-মুঠো বালি নিয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিল সেই চোখের পাতায়। ধবধবে সাদা, জ্যোৎসনা রঙের বালি… ঠিক যেন কোনও হোয়াইট স্যাণ্ড বীচ থেকে তুলে আনা! চোখের পাতায় ছোটো ছোটো দুটো বালির ঢিবির নীচে অজানারা চাপা পড়ে গেল। ঘুম পড়ে রইল, ঘড়ির টিকটিক পড়ে রইল, অন্ধকার পড়ে রইল… আরও কত কি পড়ে রইল, যেমন ছিল; শুধু সেই লোকটা জানলা থেকে একটা লাফ দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। 

বাতাসে-ওড়া পর্দাগুলো নেহাতই মূক… সাক্ষ্য দিতে অক্ষম। 

     দিনের আলো ফুটতেই চারিদিকে গোলমাল শোনা গেল। সকলের চোখে-মুখে উদ্বেগ! শহরের প্রত্যেকটা ঘরে নাকি অন্ততঃ একজনকে পাওয়া যাচ্ছে, যার ঘুম কিছুতেই ভাঙছে না! চোখের পাতায় সাদা বালির চুড়ো নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে… গভীর ঘুম। আশ্চর্যের বিষয়, চোখের ওপর থেকে বালি সরিয়ে দিলেও, আবার বালির দানাগুলো এসে জড়ো হয়ে চোখের পাতায় ঢিবি বানিয়ে ফেলছে। ধনীতম পরিবার থেকে ঝুপরি-বাসী, কারও রেহাই নেই… সব পরিবারে এমন কেউ না কেউ আছেই – যার ঘুম ভাঙছে না!

সংবাদ মাধ্যম, পুলিস, প্রশাসন, মন্ত্রী… সকলেই বেশ তৎপর হয়ে উঠল। অন্য সময়ের মত জলঘোলা কারবারটা কেউই করল না। করবে কী করে?! সবার নিজের ঘরেই যে কেউ না কেউ কাল–ঘুমে আচ্ছন্ন! পুলিশ কর্তার বউয়ের ঘুম ভাঙছে না, মন্ত্রীর মেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে, এক বড় শিল্পপতি নিজেই পড়ে আছে চোখে বালির পাহাড় নিয়ে। এমন অলৌকিক কারবার এর আগে কেউ দেখে নি। যারা জেগে আছে, তাদের মধ্যে থেকেই ডাক্তার, বৈজ্ঞানিক, তান্ত্রিক, ফকির, বাবা, মা… যে যাকে পারল জুটিয়ে আনল। কেউ বলল এসব যুগ পরিবর্তনের ইঙ্গিত। কেউ বলল তিথি বেছে, নির্জলা উপোস করে, শেখানো মন্ত্র যপতে যপতে গঙ্গায় ডুব দিতে। কেউ বলল সাগরের মন্ত্র–সিদ্ধ লোনা জল বালির ওপর ছড়িয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে। কিন্তু কেউই কেল্লা মারতে পারল না। 

বালিগুলো বড়ই অদ্ভুত। ঝুরঝুরে বালি, বাতাসের থেকেও হালকা… ফুঁ দিলে উড়ে যায়, ছড়িয়ে যায় শূন্যে। তারপর আবার ফিরে এসে নিজের জায়গা দখল করে নেয়। অন্ধকারে জ্যোৎস্নার মত উজ্জ্বল হয়ে যায়। এই বালির কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো যুক্তিবাদীরা… কিছুতেই তার অলৌকিকতা বা অস্বাভাবিকতার ব্যাখ্যা করে উঠতে পারল না কেউ। যারা একটু ডাক্তার বা বৈজ্ঞানিকদের ওপর আস্থা রাখে, তাদের দু’তিন জন ডাক্তার ভরসা করে বলল – “দেখো বাপু… এদের চোখের পাতার নিচে মণির নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে… এরা সবাই স্বপ্ন দেখছে!” এমন এক স্বপ্ন যার কোনও শেষ নেই। স্বপ্ন দেখতে দেখতে একেবারে অন্য জগতে চলে গেছে ওরা। অথচ কাউকে ডেকে তোলা যাবে না, কোমার মত অবস্থা। নিজে নিজে জ্ঞান না ফিরলে, বাইরে থেকে ঠেলাঠেলিতে উলটো বিপদ হতে পারে। কয়েক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর মস্তিষ্ক–স্নায়ুতন্ত্র সম্বন্ধীয় কিছু শব্দের সঙ্গে গম্ভীর হুম-হাম ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। 


যারা একা থাকে, অথবা যারা খোলা আকাশের নীচে ঘুমিয়েছিল সেই রাতে… অদ্ভুত ভাবে, তারা সকলেই রেহাই পেয়ে গেল। তাদের কারও চোখে বালির ঢিবি নেই, কেউ স্বপ্নরাজ্যের অবচেতনে হারিয়ে যায়নি। খুঁড়োও রাস্তায় ঘুমোয়… না ঠিক রাস্তায় নয়, চায়ের দোকানের বেঞ্চের ওপর। খুঁড়ো কারও কাকা নয়। সত্যি বলতে খুঁড়ো কারও কেউ-ই নয়। ও কেন এখানে, কী ভাবে এখানে… তাও কেউ ঠিক জানে না। ছোটবেলায় পোলিও হয়ে ডান দিকের পা’টা খানিক সরু হয়ে গেছে… তাই খোঁড়া নামটা পেতে অসুবিধে হয়নি। ডাকটা একটু নরম করে চায়ের দোকানের হরিদা, মুকুন্দ… ওটাকে ‘খুঁড়ো’ বানিয়ে দিয়েছে। 

 বছর বারো-চোদ্দ বয়সের এই ছেলেটা জেগে আছে … এটা আপাতত জানা জরুরি। অন্য সময়ে অনেক স্বপ্ন দেখলেও, এখন জেগে আছে। চোখে বালির পাহাড় নিয়ে হারিয়ে যায়নি পর্দার আড়ালে। ওই অদ্ভুতুড়ে বালি নিয়ে কেউ ওর চোখে কিছু ক্যারামতি করে যায়নি। ওর বেঞ্চির কাছেও কেউ আসেনি পা টিপে টিপে। বরং গভীর রাতে তলপেটে চিনচিনে ব্যথায় হঠাৎ ঘুম ভাঙতে, পিচুটি জড়ানো চোখেই দেখতে পেয়েছিল – সামনের বাড়ির জানলা দিয়ে একটা লোক লাফ মেরে রাস্তায় পড়ল। তারপর, কিছু দূরে এগিয়ে গিয়ে আর একটা বাড়ির পাঁচিল টপকে ভেতরে চলে গেল। রাস্তার হলুদ আলোয় মনে হয়েছিল – একটা বুড়ো মত লোক, সাদা লম্বা দাড়ি… একটা লম্বা আলখাল্লার মত পরা, রঙটা বোঝা যাচ্ছিল না দূর থেকে। লোকটা অত ওপর থেকে মাটিতে ঝাঁপ দিয়েও পড়ল না, কেমন একটা ভেসে ভেসে নেমে এলো… আর ভেসে ভেসেই অন্য বাড়িটার দিকে চলে গেল! “কিন্তু লোকটা জানলা গলে নামলো কী করে? ওই জানলায় তো লোহার গ্রীল লাগানো?” ভাবতেই তন্দ্রা ছুটে গেছিল খুঁড়োর, ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল কিছুক্ষণের জন্য। কিছুক্ষণ পর চোখের পাতা অল্প ফাঁক কর দেখল আলখাল্লা পরা বুড়োটা তেমনই রাস্তার ওপর ভেসে ভেসে এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে! পেটের চিনচিনে ব্যথা ভুলে বোবায় ধরার মত পড়ে রইল খুঁড়ো… নড়তে পারল না। বুড়োটা এক জানলা থেকে অন্য জানলা… দূরে যেতে যেতে আবছা হয়ে গেল… আর দেখা গেল না। তলপেটের চিনচিনে ব্যথাটা খুবই চেনা। কিন্তু এই ভেসে বেড়ানো বুড়োটাকে দেখার পর কিছুতেই সাহস হচ্ছিল না রাস্তা পার করে কদম গাছটার পেছনে যেতে। এদিকে দোকানের কাছাকাছি করলে হরিদা সকালে এসেই ক্যালাবে। কেমন শিরশির করছিল… কাঁটা ফুটে উঠছিল গায়ে। 

      সকাল থেকেই খুঁড়ো শুনছে লোকজনের মুখে – সবার ঘরে, কেউ না কেউ পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুম ভাঙানো যাচ্ছে না। কিন্ত তার সঙ্গে ওই বুড়োর কোনও সম্পর্ক আছে কি না বুঝতে পারছে না। গতবার ভোটের সময় হরিদা শিখিয়েছিল – ‘বোবার কোনও শত্রু নেই’। “একটা বুড়ো লাফ দিয়ে নেমে ভেসে ভেসে এদিক ওদিক ঘুরছিল… গ্রীল দেওয়া জানলা দিয়ে ঢুকে যাচ্ছিল!”… এ–সব হয়? কেউ বিশ্বাস করবে খুঁড়োর কথা? পাড়ার মাতব্বরগুলো ফালতু খিল্লি করবে। আর হরিদাও ক্ষেপে যাবে। 

তবে… ওই গ্রীল দেওয়া জানলা দিয়ে বুড়োটার গলে যাওয়ার ব্যাপারটা খুঁড়ো কিছুতেই বুঝতে পারল না। আর ওই ভাবে ভেসে বেড়ানোটাও… সব থেকে বড় গোলমাল, বুড়োটাই যদি এসব করেও থাকে, তাহ’লে গোটা শহর জুড়ে একই রাতের মধ্যে এত কিছু করল কী করে? একা বেঞ্চিতে শুয়ে ঘুমোতে এবার থেকে বেশ অসুবিধে হবে খুঁড়োর! 


ক্রমশ…


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

বর্তমানে হায়দ্রাবাদ নিবাসী  হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের শৈশব থেকে যৌবন সবটাই কলকাতার শহরতলী জুড়ে। জন্ম ২০শে আগস্ট, ১৯৮৬। বায়োটেকনলজিতে বি টেক শেষ করেই কর্মসূত্রে ২০০৮ সালে কলকাতা ছেড়ে বেঙ্গালুরু চলে যান, এবং তারপর হায়দ্রাবাদ। প্রায় দশ বছর হয়ে গেল, কলকাতার বাইরেই জীবন। বাংলা সাহিত্যের প্রতি নিবিড় ভালবাসা থেকেই একসময় লেখার ইচ্ছে জন্মায়। প্রায় সাত-আট বছর উনি একাধিক আন্তর্জাল পত্রিকা এবং মুদ্রিত পত্রিকায় লিখে চলেছেন গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য এবং কবিতা। ২০১৩ সালে 'আদরের নৌকা' প্রকাশনা থেকে প্রকাশ পায় ওনার প্রথম গল্প সংকলন 'প্রতিবিম্ব'। এর পর ২০১৫ সালে  'হাওয়াকল' প্রকশনা থেকে প্রকাশ পায় ওনার প্রথম উপন্যাস 'কৃষ্ণঘন যাম'। ২০১৭ সালে 'হাওয়াকল' প্রকশনা  থেকেই প্রকাশিত হয় প্রথম অণুগল্প সংকলন 'টিনিটাস'। ২০১৮ সালের কলকাতা বইমেলায় 'তবুও প্রয়াস' প্রকাশনা থেকে জয়দীপের প্রথম গদ্য সংকলন 'হৃদয়পুর কত দূর?' প্রকাশ পায়। এই লেখার মধ্যেই তিনি আনন্দ খুঁজে পান। আর প্রতিযোগিতামূলক এই জীবনে এই লেখাই তাঁর কাছে একটা রিফিউজ। লেখার প্রতি ভালবাসার টানেই উনি লিখতে চান... যতদিন পারেন।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।