চলচ্চিত্র সমালোচনা : Wake in Fright (1971)
Director: Ted Kotcheff
Screenplay: Evan Jones
Story by: ‘Wake in Fright’ by Kenneth Cook
Starring: Donald Pleasence, Gary Bond, Chips Rafferty, Sylvia Kay
Music by: John Scott
Cinematography: Brian West
Edited by: Anthony Buckley
বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাতা Martin Scorsese এই সিনেমাটি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন,
“Wake in Fright is a deeply… and I mean deeply… unsettling and disturbing movie. I saw it when it premiered at Cannes in 1971, and it left me speechless. Visually, dramatically, atmospherically and psychologically, it’s beautifully calibrated and it gets under your skin one encounter at a time, right along with the protagonist played by Gary Bond. I’m excited that Wake in Fright has been preserved and restored and that it is finally getting the exposure it deserves.”
Martin Scorsese
প্রসঙ্গত Nicolas Roeg পরিচালিত ‘Walkabout’ (১৯৭১) নামক ‘Survival Film’-টি এই ছবিটির অত্যন্ত নিকট আত্মীয়। মানুষ কি জানে, তাকে পুতুলের মতো করে নাচাচ্ছে অন্য কেউ? জানলেও কি সে বাঁধন ছিঁড়তে চায়? – ছবিটা দেখার পর এমন প্রশ্ন জাগবেই আপনার মনে।
প্রথমেই একটা জরুরী প্রসঙ্গের অবতারণা করা যেতে পারে। আমাদের দেশে গরু ধর্ম – ভাবনায় প্রায় জাতীয় পশুর মর্যাদা পায়। এখন তাকে ছুঁলে ছন্দ মিলিয়ে ছত্রিশ ঘা, সবাই জানে। অথচ, অস্ট্রেলিয়ার ছবি ‘ওয়েক ইন ফ্রাইট’-এ অস্ট্রেলিয়াবাসীদের জাতীয় পশু, ক্যাঙ্গারু শিকারের কী নির্মম ছবিই না ধরা আছে! এখানে হলেই হয়েছিল আর কী! (লোকে তো ভুলেই যায় বিষ্ণুর এক অবতার বরাহ। ব্রাহ্মণ মোড়লদের কখনও মনে পড়ে সে কথা?) এই ছবিটি প্রসঙ্গে অনেকেই ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে থাকেন, ‘toxic masculinity’ বা, পৌরুষের সদর্প ও বিষাক্ত উপস্থিতির কথা। অনেকে হেসে বলেন, ১৯৭১ সালটা ক্যাঙ্গারুদের জন্য ছিল দুঃস্বপ্নের। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন, বানিজ্যিক শিল্পের প্রয়োজনে শুধু ২০১৬ সালেই নাকি ১.৩৪ মিলিয়ন ক্যাঙ্গারু মারা হয়েছিল। অতি সম্প্রতি ওদেশে যে বিধ্বংসী দাবানল হল, তার পরেই নির্বিচারে কয়েক হাজার উট মেরেছিল ওরা। হ্যাঁ মানুষই এমনটা করতে পারে।
তবে, ছবিটা সত্যিই মাস্টারপিস। ভিস্যুয়ালি ছবিটা দেখতে লাগে ওয়েস্টার্ন গোত্রের ছবির মতো। আদতে এটি মিশ্র গোত্রের ছবি। ছবিতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ভিলেন নয়। অথচ ভিলেন আছে। বিষয়টা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। আমরা জানি, মানুষের শিক্ষা তার যাপনের অনুসারী না হলে তার ভিতরের আদিম প্রবৃত্তি জেগে ওঠে। গোষ্ঠীও এই আত্মবঞ্চনার বাইরে নয়। তাই ছবিটা অনেকটাই সাইকোলজিক্যাল বা, মনঃস্তত্ত্বিক হয়ে ওঠে। কিন্তু তা বলে থ্রিলার হয়ে ওঠে না। বরং একটা জটিল ও ক্যাওটিক দর্শনের প্রতিই ছবিটার আকর্ষণ বেশি জোরালো। নির্জন অন্তরীপ-তুল্য পরিবেশে মানুষের অন্তর্লোক সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারে। যাকে ব্যক্তি নিজেই চেনে না। তখন একজন স্কুল শিক্ষকও রেগে উঠতে পারে বই-পত্রের উপরে। ছুঁড়ে ফেলতে পারে বই ভর্তি বাক্স-প্যাঁটরা। নাকচ করতে পারে সভ্যতার মাত্রাবোধগুলোকে। তখন বিয়ারের গ্লাস নিমেষে শেষ হয়ে যায়। অথচ যখন তার যাত্রা শুরু হয়েছিল, সে অর্ধভুক্ত বিয়ারের গ্লাস নামিয়ে রেখেছিল। অস্বীকার করেছিল সহযাত্রীদের এগিয়ে দেওয়া বিয়ার-ক্যান গ্রহন করতে পরে সে-ই নেশাগ্রস্ত হয়ে উদভ্রান্তের মত লোকালয়ে ঘোরে ও দ্রুত জ্ঞান হারায়। কেন! কারণ অবদমিত অন্তর্গত ক্ষোভ! সে চেয়েছিল সিডনিতে যেতে। পারেনি। চেয়েছিল সমুদ্রসৈকত ও প্রিয় নারীর সংস্পর্শ। পায়নি। বরং আটকে পড়েছিল সভ্যতা-বিবর্জিত মরুশহরে। যেখানে শেরিফের উৎকণ্ঠার একমাত্র কারণ পরপর ঘটে যাওয়া একাধিক স্যুইসাইড! ‘Wake in Fright’ (১৯৭১)-ছবির নায়ক জন গ্রান্টের মত (অভিনয়ে Gary James Bond, ব্রিটিশ স্পাই ‘007’-এর সাথে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই) চরিত্র আধুনিক চলচ্চিত্রে সত্যিই বিরল। মধ্যবিত্ত জন গ্রান্ট যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র শশী। যে নিয়তি-র হাতের পুতুল। সে ছটফট করে, আত্মজিজ্ঞাসা বা আত্মবিরোধও তার আছে, সে মুক্তি চায় কিন্তু পথ পায় না বলে আত্মনির্যাতনের কবলে পড়ে। অর্থাৎ উক্ত উপন্যাসে যেমন গ্রামীণ পরিবেশে শশীর নাগরিক মনের সংকটই প্রকট হয়ে ওঠে, এখানেও তাই …। একলা হয়ে পড়া মানুষ শিকারের পর ক্যাম্পে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতে পারে, যদি তাদের ফেরার জন্য অপেক্ষায় থাকে একটা ঘর। আর, তা যদি না থাকে? তবে তারা বিয়ার গিলে মেতে ওঠে দায়হীন আত্মধ্বংসের খেলায়। পরস্পর পরস্পরকে আক্রমন করে। শিক্ষিত ডাক্তার গুলিতে টার্গেট করে আস্তানায় ঝুলন্ত বাল্বগুলিকে। দল বেঁধে যায় ক্যাঙ্গারু শিকারে। রাতের অন্ধকারে গাড়ির হেডলাইটের সঙ্গে সার্চলাইটের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া আলোয় বিমূঢ় মূক জন্তুগুলোকে পাশবিক নির্মমতায় গুলি করে মারে। অকারণে। তাতেও অসুস্থ চৈতন্য শান্ত হয় না। আহত ক্যাঙ্গারুর ধারালো থাবার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে কুস্তি লড়ে আর ছুরি দিয়ে ক্যাঙ্গারুর টুঁটি কেটে ফেলে অবলীয়ায়। সভ্যতার যা কিছু অহংকার, সেগুলোই যেন তখন মানুষের পিছু ধাওয়া করে প্রেতের মত। মদ্যপ উচ্চবিত্ত পিতার একমাত্র কন্যার প্রতি লম্পট পুরুষদের লাম্পট্যপূর্ণ আচরণের অর্থ তাই সহসা বদলে যায়। জানা যায়, সে অঞ্চল প্রায় রমণী-বিবর্জিত। ফলে যে মেয়ে-টিকে অসহায় মনে হচ্ছিল, সেই নিজের খুশি মত পুরুষগুলিকে ব্যবহার করে। নিয়তির হাতে অসহায় শিক্ষকটি সরাইখানার জুয়ার আড্ডায় দু পয়সা করে নিতে উন্মত্ত হয়ে পড়ে। অচিরেই সব খোয়ায়। জুয়ার দুটি কয়েন উপরে উঠে যায় আর লোকটির উত্তেজনা বোঝাতে তীব্র করে তোলা হয়, পারিপার্শ্বিক শব্দ অর্থাৎ অ্যাম্বিয়েন্স সাউন্ড। আবার যখন লোকটা সব হেরে বসেছে, তখন জুয়া চলে কিন্তু, আত্মমগ্ন লোকটির যে কিছুই শ্রবণগোচর হচ্ছে না, তা বোঝাতে দৃশ্য চলে দ্রতলয়ে …. অথচ কোনো শব্দ থাকে না। যেটা থাকে সেটা হল প্রকৃত চলচ্চিত্রপ্রেমীর নিখাদ বিনোদন। আর তারপর! লোকটি নগ্ন হয়ে পড়ে থাকে মলিন শয্যায়। বিনয়ের সঙ্গে পাঁচ সেকেন্ডে বোঝানো হয়ে যায়, লোকটি নিঃস্ব। এই হল সিনেমার নিজস্ব মাধুর্য। এরকম দৃশ্য আরো আছে ছবিটায়। শহরের নির্জনতম সরাইখানার রিশেপশনে, তপ্ত দ্বিপ্রহরে একা বসে থাকা তরুণীটি তার ঘর্মাক্ত চোখের পাতায়, কাঁচের গ্লাস থেকে আঙুলে তুলে নেওয়া জলের বিন্দু রাখে। তারপর সেই জলের ধারা গড়িয়ে নামলে, চাবির জন্য অপেক্ষারত ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত পথিককে দেখিয়ে দেখিয়ে শরীরে নামাতে থাকে সেই ধারা। খুলে যায় তৃষ্ণার ভিন্নতর অর্থদ্যোতনার গোপন কক্ষ – বোঝানো হয়ে যায় বিবর্ণ নিঃসঙ্গ তপ্ত মনে বিকৃতি আসে সহজেই।
ছবির শুরুর দৃশ্যে জনশূন্য মরূ-প্রান্তরে একটা মঞ্চ দেখতে পাই। ওটাই ওই জনবিরল এলাকার রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম। তিবুন্দা-র বিদ্যালয়ের অনিচ্ছুক ও শর্তাধীন শিক্ষকটি ক্রিস্টমাস হলিডে-তে যাবেন। অথচ ঘড়ির কাঁটা না মিললে তাঁর ছুটি নেই। ব্যগ্র অধীর নানা বয়সের ছাত্রছাত্রীগুলি হাঁ করে চেয়ে থাকে শিক্ষকের দিকে। ছবির পরিচালক Ted Kotcheff ঠিক ওইভাবেই গোটা ছবিতে আমাদের স্তব্ধ করে রাখেন। প্রতিটি দৃশ্যে হয় শব্দ, নয় দৃশ্য ও ক্যামেরার কোনো অভিনবত্ব আপনাকে সজাগ রাখবে, উত্তেজনার মৃদু আঁচে আপনাকে সেঁকতে থাকবে। ছবি শেষ হলে জন্ম হয় অদ্ভুত একটা বোধহীন বিস্ময়ের। ঠিক যেমন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ পড়ার পর বিমূঢ় হয়ে পড়ি, তেমনি ভাব হয় মনের। আর ফিল্মে কলুর চোখ ঢাকা বলদের মত ওই স্কুল মাস্টারটি বাক্স গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায় ওই একচিলতে রেল প্লাটফর্মটায়। আর কখনো ফিরবে না ভেবে। মুখের কোলে চিলতে হাসি (অনেকটা হিচককের ‘সাইকো’র নর্ম্যান বেটস্-এর মতো হাসিটা)। অথচ বেচারাকে সেই Bundanyabba হয়ে ফিরতে হয় Tiboonda-র স্কুলে। অমোঘ নিয়তি। তার সানগ্লাসটি হয়তো ছিল তার স্বপ্নের প্রতীক! চলন্ত ট্রেনে যার সান্নিধ্যে সে স্বপ্ন দেখেছিল, লবণ-দেহে, সমুদ্রোত্থিতা বান্ধবী রবীনের। সে স্বপ্নও তার অজান্তেই কখন যেন চুরমার হয়ে যায়। দুর্দান্ত অভিনয়, আবহ নির্মাণ আর আশ্চর্য স্মার্ট সাউন্ডট্রাকের ত্রিবেণী সংগমে এ ছবি অর্জন করেছে ‘cult’ reputation, কালজয়ী ছবির সম্মান – Australia’s great “Lost film” হিসেবে। ছবিটি একবার দেখলেই আপনার হৃদয়ে ক্যাঙ্গারুর থাবার ছবিটি চিরতরে আঁকা হয়ে যাবে এটা নিশ্চিত। জানি না, জন গ্রান্ট-এরও শশীর মত কোনো প্রিয় মুহূর্ত উপভোগের বাসনা চলে গেল কী না! যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অন্তত ছবির শেষে প্রযোজকের বার্তা জানিয়ে দেয়, লুপ্তপ্রায় ক্যাঙ্গারু শিকারের নির্মম অভিলাষ যাতে উল্লাস-প্রিয় অজি-দের কখনো না হয়, তার জন্যই ছবির মধ্যে ক্যাঙ্গারু-নিধনের অমন ভায়োলেন্ট দৃশ্যাবলী সংযোজন। চারপাশে এত নির্যাতন ও গণহত্যার দৃশ্যাবলী আমাদের যে কেন বদলে দেয় না, কে জানে! সমালোচক রজার এবার্ট যথাযথ বলেছিলেন, “It’s not dated. It is powerful, genuinely shocking, and rather amazing. It comes billed as a “horror film,” and contains a great deal of horror, but all of the horror is human and brutally realistic.”।