নিউরন

মানবেন্দ্র সাহা on

neuron

মনে হলো একটা চাবুক দরকার আমার। সারাদিন ফুটো চালা দিয়ে এই টুপটাপ বৃষ্টিপাত আর ভালো লাগেনা, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর আদিখ্যেতাও আর ভালো লাগেনা। ক্লান্ত চাকার মত অবসাদগ্রস্ত, বসে থাকি ভিজে দেওয়ালে গা লাগিয়ে। যেন  অস্তিত্বহীনতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। একদিন আড়মোড়া ছেড়ে বাবাকে বলেছিলাম একখান চাবুক চাই আমার। বাবা একটা কঞ্চির ডগায় নাইলনের দড়ি বেঁধে আমার হাতে দিল। বলল এই হল গিয়া চাবুক, তা তুই কারে মারবি চাবুক দিয়া? আমি বললাম কানের কাছে কারা যেন ভনভন করে সারাক্ষণ, পচা গন্ধ আসে নাকে।

আমাদেরই পূর্বজ যারা, তারা অনেকদিন আগে কিছু ধাতব মুদ্রা লুকিয়ে রেখেছিল পাললিক শিলার ভিতর। পড়াশোনায় কাজে লাগবে বলে সেগুলি ভাঙেনি আমাদের বাবা। একদিন আকাশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে একটা তারা দেখালো। বলল অইটা হল গিয়া তোর দাদুর গ্রহ। অইখানে একখান হিলিয়ামের সুমুদ্দুর আছে খোকা। শান্ত একখান হিলিয়ামের সুমুদ্দুর। তার নিচে এরম অনেক পাললিক শিলা জমানো আছে তোর লগ্যা। ভালো করে পড়াশোনা কর। লাগলে পর লইয়া আনবো একদিন।

তারপর পড়তে পড়তে একদিন মায়ের গরম পায়েসের বাটির উপর পড়লাম। মা বলল সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরিস খোকা? আমি বললাম আজকে কি মা? মা বলল তোর জন্মদিন, পাঁচ হাজারতম জন্মদিন। বাবা তখন দুইহাতে আমার নিউরনের জটগুলো খুলছিলো আপনমনে আর আমি একটা কক্ষচ্যুত গ্রহাণুর মত ক্রমশ নীল পায়েস বাটির থেকে আবার ছিটকে যেতে লাগলাম একটা অচেনা আলোর বিন্দু লক্ষ্য করে। বাবা দুইহাতে আমার নিউরনের দড়িগুলোকে ঘোরাতে লাগল প্রাণপণে। আর মা বলল খোকা আবার কই যাস? বস এইখেনে।

কানের কাছে কারা যেন ভনভন করে সারাক্ষণ, পচা গন্ধ আসে নাকে। একবার একটা নদী দেখেছিলাম স্বপ্নে। স্নিগ্ধ গোলাপি রঙের নদী। নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে নাচতে নাচতে এসে আমার হাত ধরেছিল। একটানা নূপুরের শব্দ শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে ছিলাম। খেয়াল করিনি মেঘ করেছে। আর তখনই সে আমার কাছে লুকিয়ে রাখা একটা পাললিক শিলা নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল একটা জঙ্গলের ভিতর। আমি চাইলেই তাড়া করে ধরে ফেলতে পারতাম তাকে। কিন্তু তখন ঝমঝমে বৃষ্টি পৃথিবীর বুকে। বৃষ্টির ভিতর আমি রাস্তা ঠিক করতে পারিনা বলে ঝিম ধরে বসে রইলাম একটা গাছের নিচে। তখনই আবার সেই পচা গন্ধটা নাকে এলো। বাবা তখন ডেনড্রনের নিউক্লিয়াসে বসে বনবন করে চাবুক ঘোরাচ্ছে চারিদিকে, আর মা একবাটি নীল পায়েস হাতে এক্সনের নিচে ব’সে আমায় ডাকছে খোকা পায়েস খাইয়া যা, আজ তোর জন্মদিন। আমি বললাম না মা আমার একখান চাবুক দরকার। কারা যেন সারাক্ষণ ভনভন করে কানের কাছে। পচা পচা গন্ধ আসে নাকে।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


মানবেন্দ্র সাহা

কবি মানবেন্দ্র সাহার জন্ম ১৯৮১ সালের ১৫ই জুন বীরভূমের আমোদপুর সংলগ্ন সাহাপুর গ্রামে। পেশায় অধ্যাপক, নেশায় কবি। মানবেন্দ্র সাহার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ' রাত্রির কথা ক্লান্তির কথা' এবং ' সান্ধ্যভাষার রহস্যনির্মাণ'।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।