মা এবং একটি উনুন
আমাদের শৈশবে মায়ের ছিল অভাবের সংসার। শাশুড়ি ননদের সঙ্গে প্রাত্যহিক বাকবিতন্ডার পর ঘুপচি রান্নাঘরে উনুন জ্বালাতেন মা। ধোঁয়ায় জেরবার হতে হতে বিড়বিড় করে যেতেন, একা একা। আমি দেখতাম সাদা ধোঁয়ার মধ্যে একটি আবছায়া মূর্তির ক্রমাগত নড়ে যাচ্ছে ঠোঁট, আর আগুনে ভরে যাচ্ছে মাটির উনুন।
ওভাবে কার সঙ্গে কথা বলো, মা? কী বলো ওমন করে?
জিজ্ঞেস করলে সামান্য হেসে জবাব দিতেন, কিছু না রে। কারো সঙ্গেই না। যা এখান থেকে।
আবহমান গ্রাম-বাংলার শাশ্বত মায়েদের এ আসলে এক চিরন্তন সংস্কার। সমস্ত কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা, অভিমান, অভিযোগ, কোথাও যা জানানোর উপায় নেই, সব ডালখড়ির সঙ্গে গুঁজে দেওয়া উনুনে; ছাই হয়ে, ধোঁয়া হয়ে লীন হয়ে যাওয়া। একদিন, প্রতিদিন।
মায়ের এখন ঈর্ষনীয় ভরা সংসার। স্বামী, সন্তান, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনির কলকাকলি — ভরপুর সুখের আবহ। এই যে আমরা শক্ত করে নিয়েছি নিজ নিজ পায়ের তলার মাটি, কাঁচা ঘর ভেঙে মাথা তুলেছে পাকা দালান, মাটির উনুন বদলে ঠাঁই নিয়েছে গ্যাসের চুলা,
এসব সত্ত্বেও উঠোনের এক কোণে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো, নিজের জন্য মা রেখে দিয়েছেন একটা উনুন। রোজ তাতে ডালপাতা গুঁজে দেন। আগুন জ্বালেন। ধোঁয়ায় ভরে যায় সারা বাড়ি। আমাদের চোখ জ্বালা করে। জল ছলছল চোখে আমি মায়ের ক্রমাগত ঠোঁট নড়া দেখি; দেখি অনন্ত ধোঁয়ার কুন্ডলীতে ক্রমে ঘন হয়ে উঠছে আমাদের অযুত আকাশ।
0 Comments