চন্দ্রানী গোস্বামীর কবিতা
(১)
আদমশুমারি
রোজ সন্ধ্যা হলে বিনা অভ্যর্থনায় শহরের সকলে নিজের বাড়ি ফেরে।
সুখের আদমশুমারি করে দেখা গেছে ফেরার পর কপালে হাত দিয়ে ঘামের তাপমাত্রা, হৃদয়ের গোপন সুরঙ্গপথ, সদর দুয়ারে কোন চাবিতে খুলে যায় স্বপ্নে দেখা স্বপ্নপার…
কিম্বা ঠোঁট আর বুকের কত্তোটা মিল হলে
ঘন্টার মতো বাজে শরীর-ব্রহ্ম— ইত্যকার তার গোপন খবর কেউ রাখে না।
তারপর শহরে সরু সুতোর মতো সন্ধ্যা নেমে এলে
দেখা যায় বাইকে, ট্রেনে, বাসে ফিরতি মুখগুলোর
শতকরা নব্বই শতাংশ সকলেই সুখী সংসারী।
অথচ দুঃখের আদমশুমারিতে উঠে এলো
একটা তথ্য….
এই শহরে একলা আমি ছাড়া
দ্বিতীয় পাগলি বা প্রেমিকা
আর কেউ নেই।
(২)
এর’ই নাম প্রেম
সে একআশ্চর্য ঘাম মাখা কবিতার গন্ধ ঘুমায় বুকের মাঝে
হেমন্তের মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি আমারই রাত পাহারায়
আমার ঠোঁট ছুঁয়ে আছে চাঁদের কলম, মনটা ডুব দেয় কোন অতলে
জ্যোৎস্না নদী হয়ে বুকের খাঁজে জমে থাকা কবিতা বয়ে নিয়ে যায় বিষন্ন মোহনায়
আমি কথার ভিড়ে আলগা করি আমার একলা ডিঙা, আমার মন কেমনের ঘর
নিবিড় বাতাসে গন্ধ পাই, আমার নিঃসঙ্গ কান্নার আনাকানিই আমার প্রেমের গোপন আভাস।
(৩)
ব্যক্তিগত তুমি
তুমি আসছো না আমার শহরে, বহুদিনই আসছো না
অথচ তোমায় নিয়ে আমি ভাবি,
যখন তোমায় আঁকি এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছবি তুলি ছুঁয়ে যায়
ভালোবাসা ঘিরে ধরে আমায় কিন্তু ক্যানভাসে ভালোবাসার কোনও রং নেই,
তিলফুলের থেকে শুয়োপোকা বেড়িয়ে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়
টের পাই ঘামে জবজবে আমার মুখটা মুছে দেয় এক পাখি
ব্যাধ, যতোই তূনে তীর সাজাও না কেন
ডারউইন ফিরেছিলো, পাখিও একদিন ফিরবেই
জানি পাখিরা নীচু হয়ে কখনোই বাঁচতে পারে না।
আমি এখনো আঁকি তোমার মুখ আমার শহরে,
আজও পাখির অপেক্ষা প্রশান্তি হয়ে ছুঁয়ে যায়
আমি আদ্যন্ত ফকির এক কবিতা প্রেমিক হয়ে উঠি।
(৪)
প্রেমিক তুমি
অবিকল তুমি প্রেমিক, জাদু নগরী থেকে এক রাতে
ঘুমাতে এসেছ তিস্তারই গায়ে, ছোট্ট এক ঘরে…
ঐ খানে শুয়ে আছো… সব শেষ হবার আগে
আমারও প্রেমিক শুয়েছিল বিছানার পাশে—-
চাঁদ-ফালি নেমে আসে তোমার চিবুকে, যেভাবে
প্রবাল আলো লালন করেছে আমার প্রেমিক-সুখ শীতঘুমে
সেইভাবে আলুথালু হই সে আলোর উৎসব মেখে
জানলা দিয়ে মেঘ বিজড়িত রাতের আতর আকাশ জানে—
তোমার রুক্ষ্ম ঠোঁটে আমার নিজস্ব চাঁদের কুমকুম
এবারে যে গালে ভাঙবে ঘুম
প্রেমিকার মতো বরবাদ হয়ে
সেই গালে আমিও রয়ে যাব চোখ বুজে…
(৫)
ঈর্ষার অক্ষরগুচ্ছ
তোমাকে বলা হয়নি অরণ্যে আমার একটা নিজস্ব বাড়ি আছে।
প্রতিজ্ঞা করেছি, তাকাবো না বর্ষার লোভনীয় ফলের মতো।
তুমি যখন উরু এলিয়ে বসে রোদ্র পোহাও চৈত্র পোড়া গন্ধ এবং শ্রাবণময় তোমার সঙ্গ-কাল জুড়ে।
তুমি অন্য কারুর সঙ্গে কথা বলতেই পারো। আজকাল হুলরা
গর্তে ঘুমায়। আমিও ঘুমিয়ে পড়েছি আরেক শ্বাপদের গর্তে।
অবশেষে স্বেচ্ছামৃত্যু নেবার আগে বলে রাখি, বাড়ির জানালা
খোলা আছে, দরজার বাইরে মৃদু কড়া নেড়ো। চিলেকোঠার চাল
কতোটা পুড়ে যাবে, খেয়াল রাখবো না।
0 Comments